ছেলেটি উঠে দাঁড়ায়। জল চায় এক গ্লাস সে জলের বোতল এগিয়ে না দিয়ে কুঁজো থেকে ঠাণ্ডা জল ঢেলে এনে দেয়। খায় ছেলেটি। গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে তার কাছাকাছি এগিয়ে আসে। আলতো হাত রাখে তার গালে। দু’চোখ দিয়ে কী যেন খুঁজে বেড়ায়। বিড়বিড় করে। ব্যাগ টেনে নিয়ে রওনা দেয় দরজার দিকে।
সে ডাকে। এবং পিছু ডাকল বলে আরও একবার বসে যেতে অনুরোধ করে। ছেলেটি ব্যাগ কাঁধে নিয়েই বসে পড়ে তার কথামতো। সে তখন পঞ্চাশ টাকা এগিয়ে দেয়। ছেলেটি নিতে অস্বীকার করে উঠে দাঁড়ায় আবার। সে তখন হাত টেনে টাকা গুঁজে দেয়। কবে, কোন তেরো বছর বয়সে হারিয়ে ফেলা আবেগ এত দিন পর আবার তাকে ক্ষণিকের জন্য অধিকার করে। সে বলে বসে, দিদি হয়ে ভাইকে এটুকু তো দিতেই পারে সে।
ছেলেটি প্রতিবাদ করে না। টাকা পকেটে খুঁজে বেরিয়ে চলে যায়।
সে তখন খানিক দূরত্ব রেখে ছেলেটিকে অনুসরণ করে। রাত হয়েছে। জায়গা ভাল নয়। বড় রাস্তা পর্যন্ত সে সঙ্গে যাবে।
ছেলেটি থমকে দাঁড়ায় একবার। কী যেন দেখে। তারপর বড় বড় পদক্ষেপে চলে যেতে থাকে।
১৮. এক-একটি দিল-বড় তীব্র
এক-একটি দিল-বড় তীব্র অভিঘাতে মানুষের ঘুম কেড়ে নেয়। উত্তেজিত স্নায়ুসমূহ বিশ্রাম নিতে চায় না। সে কেবলই জেগে থাকে আর পাশে ঘুমন্ত বিশ্বদীপের ভারী নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনতে পায়।
আগে তারা দু’জন অনেক রাত অবধি জেগে জেগে কথা বলত। বিশ্বদীপ কাজে যোগ দেবার পর থেকে কথা থেমে গেছে। কথা বলত বিশ্বদীপই বেশি। সে শুনত। এখন সে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে থাকে খেতে খেতেই কথা জড়িয়ে আসে। ঘুমে বন্ধ হয়ে আসে চোখ। বিছানায় শোয়া মাত্রই সে তলিয়ে যায়।
ছুটছে বিশ্বদীপ। লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করার জন্য ছুটছে। পিয়ে পড়াকে পরোয়া করছে না। শীর্ণতর হয়ে ওঠাকে তোয়াক্কা করছে না। তার সামনে সুদূরতম নক্ষত্রের মতো ঝুলে ছিল চাকরি। এই তিন মাসে সেই নক্ষত্রকে একটু একটু করে বড় করেছে সে। বাকি ৰ্ত্তিন মাস টিকে থাকলেই আর ভাবনা নেই। আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ সে হাতে পেয়ে যাবে। চাকরি। ভাল বেতনের চাকরি আর প্রচুর সুবিধা।
গত তিনমাস ধরে সে সফল থাকতে পেরেছে। চোখের তলায় অসম্ভব পরিশ্রমের ছাপ। কিন্তু ঔজ্জ্বল্য দৃষ্টিময়। এ ভাবেই সে সাফল্যের সংবাদ প্রতি মাসে পরিবেশন করেছে শুভদীপকে। এবং সহাস্যে জানিয়েছে, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল যারা, তার মধ্যে টিকে আছে অল্পই। পারছে না, এই পরিশ্রম পারছে না আলুভাতে খাওয়া বাঙালির ছেলে।
বলার সময় আত্মগর্বে তার মুখ টসটসে। সঙ্গে সঙ্গে মায়েরও। শুনতে শুনতে একটি চমকদার চাকরি এবং একটি সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন মাকেও অধিকার করে বয়ে আছে।
আর সব সুসংবাদের শেষে একটি আশ্চর্য কথা বলেছে বিশ্বদীপ। এই সব সংস্থা, পণ্যবিক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত হলে যা হয়, তার থেকে বাড়িয়ে রাখে সব সময়। যদি লক্ষ্যমাত্রা চূড়ান্ত হয় তেরো, তারা দেবে তেইশ। কারণ তারা চায় তাদের পণ্য বিক্রয় হোক, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হোক চায় না।
এর দু’রকম ব্যাখ্যা আছে। সে সিগারেট ধরিয়ে বলেছিল। এই কৃত্রিম লক্ষ্যমাত্রার দার্শনিক দিকটি সহজ। কোন লক্ষ্যের চুড়ান্ত কী, তা কে বলে দেবে! চূড়ান্ত বস্তুটি কেবলই সরে সরে যায়। ধরতে গেলেই পিছলে যায় পারদ কণিকার মতো।
বলতে বলতে হাসছিল সে, যেমন তার স্বভাব, হাসির দমকে কঠিনকে সহজ করে তোলে, আর হাসতে হাসতে দ্বিতীয় ব্যাখ্যার কথা বলেছিল।
গাধার সামনে গাজর ঝুলিয়ে দুটিয়ে নেবার মতো খুডাের কলে ফেলে দেওয়া হবে ছেলেমেয়েদের। চাকরির টোপ নিয়ে তারা ছুটবে। লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ করার জন্য চূড়ান্ত অভিনিবেশে চূড়ান্ত পরিশ্রম করবে এবং পৌঁছবে সেখানেই যেটা প্রকৃত লক্ষ্যমাত্রা। কিন্তু.. এই কিস্তুলই সব। কৃত্রিম লক্ষ্যমাত্রা পর্যন্ত পৌঁছল না কেউ, তাই চাকরিও দিতে হল না। বেতনও দিতে হল না ছ’মাস। কিন্তু সামান্য বাস ভাড়ার বিনিময়ে কোটি টাকার পণ্য বিকিয়ে গেল! একদল ছেলেমেয়ে না পেরে ছেড়ে দিল একমাস দু’মাস পর, অন্য একদল এল। বিক্রি অব্যাহত রইল।
হঠাৎই, ছোটবেলায় যেমন ভাইকে আদর করত, তেমনই ইচ্ছে হয়েছিল তার। সে বোঝে, বুঝতে পারে, তার নিজের চেয়ে তার ভাইয়ের দৃষ্টিতে অনেক বেশি স্বচ্ছ। আর ভাই তখন দু’আঙুলে জ্বলতে জ্বলতে ছাই ওগড়ানো সিগারেটের শেষাংশ ধরে দু’হাত ছড়িয়ে শুনিয়েছিল ব্যান্ডের গান। সে শোনে না যেসব, সেই ব্যান্ডের গান–
সকালে উঠে দেখি
দেখি এক মুমূর্ষ গাধা
চোখ দুটো ঢুলুঢুলু তার
ঠোঁট দুটো সাদা
এম বি এ করে যায়
ল্যাজে গিট বাঁধা
গাধার অবস্থা কী করেছেন
কী করেছেন দাদা
গাধাটাকে জল দাও…
সে, হাস্যবিরল মানুষ হয়ে যেতে থাকা, সে-ও শুনে হেসে উঠেছিল শব্দ করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হাসির কিছু ছিল না। বিদেশ পাড়ি দেওয়া গাধারা তবু অর্থমূল্য পেয়ে যায়। যে-গাধারা দেশি থেকে গেল তাদের ভঁড়া শূন্য।
তা হলে প্রশ্ন ওঠে সে পারছে কী করে? কী করে পারল তিন মাস!
সাধ্যাতিরিক্ত করে। সাধ্যাতিরিক্ত করে সাধ্যাতীতকৈ সে আয়ত্ত করেছে।
সে আপত্তি করেছিল। অতিরিক্ত পরিশ্রমে হিতে বিপরীত হতে পারে বলেছিল। মা তখন ঝাঝিয়ে ওঠে তার ওপর। বলে, উপার্জন বাড়ানোর চেষ্টা করাই পুরুষমানুষের কর্তব্য। এবং এই বয়সই পরিশ্রমের উপযুক্ত!