বিশ্বদীপ কথা বলে চলে। মিঠু এখন কারওকে কিছু বলবে না। কিন্তু প্রয়োজন হলে বলবে। তার বাড়ি থেকে যদি জোর-জবরদস্তি করে তবে চলেও আসতে পারে এখানে।
সত্যিকারের প্রেমিক, স্ত্রীর মর্যাদা-কথাগুলো ভদীপের ব্রহ্মতালুতে ঠোক্কর মারে। তার খুলি ভেদ করে অন্দরে যেতে চায়। যদি মিঠু নিরুপায় হয় আর চলে আসে এখানে তবে মিঠু আর বিশ্বদীপ শোবে কোথায়?
তাঁর ভাবনায় একটি প্রেম এবং প্রেমের পর কুলীন এক উপার্জন অন্তে সত্যিকারের প্রেমিক হয়ে বিয়ে করে ফেলা ও স্ত্রীর মর্যাদার পরই শয্যার প্রশ্ন আসে। দাম্পত্যর অধিকারে অন্তত রাত্রির নিভৃতিটুকু পাওয়া চাই।
শুভদীপ এই হিসেব বরাবর করেছে। যতবার বিয়ের প্রসঙ্গ এসেছে ততবার। সত্যিকারের প্রেমিক হওয়ার আগে সে বরং শয্যা নিয়েই ভাবিত হয়েছে বেশি।
গামছায় মাথা-গাবুক-পিঠ ঘষতে ঘষতে সে মনে মনে সাজিয়ে নেয়–মিঠু যদি চলেই আসে তো সে তার জায়গা মিঠুকে দিয়ে দেবে। নিজে বড় ঘরের মেঝেয় বিছানা পেতে নেবে। বড় স্যাঁতসেতে মেঝে। তার ওপর দেওয়ালের জায়গা বাড়াবার জন্য ঘরের দুটি জামালার একটি খোলা হয় না।
হয়ে যাবে। কোনও ভাবে হয়ে যাবে। তার আগে বিশ্বদীপের চাকরিও নিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। তারা দু’ভাই খুব পরিশ্রম পারে। সুতরাং তারা গলাগলি বেরিয়ে পড়বে রাস্তায়। সে বিজ্ঞাপন ফিরি করবে। বিশ্বদীপনামী সংস্থার পণ্যবস্তু।
বিশ্বদীপ একটি শুকনো পাঞ্জাবি শুভদীপের দিকে এগিয়ে দেয়। মা রান্নাঘর থেকে তাড়া দিতে থাকে। মায়ের গলা পেয়ে সে আবার সেই অমোঘ প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত হয় এবং অত্যন্ত সতর্কতায় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে। উচ্চকণ্ঠে সে দেবনন্দনের প্রসঙ্গ তোলে আবার। বিশ্বদীপ জানায় দেবনন্দনের প্রস্তাবে তার কোনও আপত্তি নেই। বরং দেবনন্দনের মহত্ত্বকে সে সহায়তা দেবে। শুভদীপ এই বিবাহ-সম্মতিকে এক ধরনের প্রবঞ্চনা বলে ব্যাখ্যা করে কারণ শুচু এক রোগগ্রস্ত মেয়ে। বিশ্বদীপ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর একটি সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দেয়। সিগারেটের আগুন ধামাকা হয়ে জ্বলে। সেই জ্বলুন দ্বারা নীরবতাকে পোড়াতে থাকে বিশ্বদীপ। আর শুভদীপ সেই আগুনে গা সেঁকে নেয়। নিজের শৈত্য সেঁকে তাপ নেয় আর সময়কে গভীর রাতের দিকে ঠেলে দিতে চায়। মার চোখ ঘুমে ঢুলে আসুক এমনই সে আকাঙ্ক্ষা করে। কিন্তু মা খাবার আগলে বসে আছে।সারাদিন যা কিছু ভেবেছে মা, আশঙ্কা করেছে, সংসারে যা-যা ফুরিয়েছে, যা-কিছু প্রয়োজন, সব না বললে মার ঘুম আসবে না আদৌ।
সে গামছা মেলে দিয়ে হাত দিয়ে চুল ঝাড়তে থাকে। পাঞ্জাবি পরে নেয়। বোতাম লাগাতে গিয়ে দেখে বোতামের পাশ দিয়ে বিনুনির মতো নেমে গিয়েছে সরু সুতোর নকশা। তার অন্য এক বিনুনি মনে পড়ে। আজ বিজ্ঞাপন থেকে নেমে এসেছিল মেয়েটি তার। তাকে ছাড়িয়ে আরও একটি বিনুনি। চওড়া ও কোমর-ছাপানো। রাশি-রাশি সেই চুলের সম্ভার যে-কোনও শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন হতে পারত। সেই চুলকে তার মেঘরাশি বলতে ইচ্ছে করে হঠাৎ। কিংবা রেশমের অন্ধকার। ঝলকে উপলব্ধি হয় তার। সে যে মৃত্যুর দেবীকে কল্পনা করেছে আর তার মাথায় বসিয়ে দিয়েছে চুল–যে চুল বিস্তৃত হয় আর অন্ধকারকে ঘনায়মান করে, সে চুল অবিকল চন্দ্রাবলীর। সে বিবশ বোধ করে। অসহায় লাগে তার।
তখন বিশ্বদীপ কথা বলে আবার। ভারী ও গভীর কথা বলে, যেন কোন অতল থেকে উঠে আসছে বাণী। সে ব্যাখ্যা করতে চায়। মানুষের পাওয়া না-পাওয়ার হিসেবকে চুলচেরা বিশ্লেষণের প্রয়াস নেয়। সে মনে করে, এই হিসেব খুব সহজ নয়, তুচ্ছও নয়। প্রত্যেক মানুষেরই চাওয়া ও তৃপ্তিবোধ একজনের অন্যের চেয়ে আলাদা। দেবনন্দন শুচুকে জীবনে গ্রহণ করবে, এ সিদ্ধান্ত তারই। কেউ তার ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি। কেউ অনুরোধও করেনি। অতএব, এর মধ্যে কোথাও কোনও বঞ্চনা লুকিয়ে থাকতে পারে না।
তখন মা উঠোনে পা রাখে। বলতে থাকে বাবারও এমনকী সম্মতি আছে, শুধু শুভদীপের আপত্তির কোনও অর্ধ সে খুঁজে পায় না।
মা এগিয়ে এসে মাঝ-উঠোনে দাঁড়াচ্ছে। দুই ছেলের মাঝ বরার এসে থামছে সে সম্পূর্ণ। মাঝরাতের হিম হাওয়া উঠোনে ঘুরপাক খেতে শুরু করে দেয় তখন। বিশ্বদীপ সিগারেট লুকোয়। আকাশে গাঢ় কুয়াশার ঘোমটা পড়েনি। ঝিকমিক তারাগুলি দৃশ্যমান। কোথাও কোনও শব্দ নেই। এই নৈঃশব্দ্যকে বড় কড়া, বড় অসহ লাগে শুভদীপের। হয়তো বিশ্বদীপ তা টের পেয়ে যায়। আর শুধুমাত্র নীরবতা খাতেই বহুবার বলা স্বপ্নের কথা বলতে থাকে আবার। চাকরি পেলেই উঠোনের কোণে একটি স্নানঘর বানাবেই সে। শুধু তাদের জন্য।
তখন মাকে অসহিষ্ণু লাগে। শুভদীপের দিকে মা সরাসরি তাকায়। জোর গলায় বলে, দেবনন্দন শুভদীপেরই বন্ধু। আর প্রস্তাবটাও তারই। সুতরাং দেবনন্দনের সঙ্গে শুচুর বিয়ে দিলে কোথাও কোনও অন্যায় নেই। বলে এবং ভুট্টাদানার মতো উঠোনে ছড়িয়ে দেয়।
শুভদীপ তার পরও তার অমতই প্রকাশ করে শুধু। সে প্রবঞ্চনার কথা বলে। পরিবারের অসম্মানের কথা বলে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মনের গভীরে জেনে যায়, কারও পক্ষে শুচুকে বিয়ে করতে পারার সম্ভাব্যতা সে বিশ্বাস করতে পারছে না।
এ তারই অক্ষমতা, নাকি এমনই পৃথিবীর মহাসত্য–সে সঠিক ধরতে পারে না। এবং মা তখনই তাকে এই গৃঢ় অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি দেয়। স্বর নিচু করে, চোখ শূন্যে মেলে, প্রায় আত্মগতভাবে তিন সন্তানের জননী ঘোষণা করে–শুভদীপের এই আপত্তি অবান্তর। অকারণ। ন্যায়-অন্যায়, মানবিকতা-অমানবিকতা, পাপ-পুণ্য ইত্যাদি ছাড়াও এই বিবাহের একটি বাস্তব দিক আছে। দেবনন্দন শুচুকে বিয়ে করে নিয়ে গেলে সংসারে একটি পেট তত কমবে। সেই সঙ্গে শুচুর জন্য নিয়মিত ওষুধ, ডাক্তার, হাসপাতাল করার ঝঞ্চাট ও প্রভূত ব্যয়ভারের হাত থেকেও কি মুক্তি পাবে না তারা! দেবনন্দনের পরিবারে এমন কেউ নেই যে শুচুর সঙ্গে বিয়েতে বাধা দেবে। অর্থের অভাবও তার হবে না কারণ দেবনন্দনের বাবা-মা তার জন্য গচ্ছিত রেখে গেছে প্রচুর অর্থ এবং একখানি গোটা বাড়ি। শুচুকে সে ভালভাবেই রাখতে পারবে। হয়তো সে আরও ভাল চিকিৎসা করাতে পারবে, যা তারা নিজেরা পারছে না।