বেশি জ্ঞানী হয়ো না। চুপ করে থাক।
আমি তো আগেই বলেছি, আজ আমি চুপ করে থাকব না। আপনার আনন্দে আমার অংশ আছে। এখন আমি মোসার্টের অতি বিখ্যাত অপেরা সঙ্গীত দিচ্ছি।
মোৎসার্ট বাজতে শুরু করেছে। নিনিতা বিছানা ছেড়ে নামল। কুনের পেছনে এসে দাঁড়াল। নরম গলায় বলল, এসো কিছুক্ষণ নাচি।
কুন বলল, চন্দ্রমাতাকে চুমু খাওয়া হয় নি।
নিনিতা হাসছে। কিন্তু তার চোখভর্তি পানি। এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকাতে বলা আছে—মানব সম্প্রদায় নানান বিপরীতমুখী স্বভাবের মিশ্রণ। তারা দুঃখে অশ্রু বর্ষণ করে। আনন্দেও অশ্রু বর্ষণ করে।
সভ্যতা
সভ্যতার দুটি ধারা। একটি ধারা ঊর্ধ্বমুখী। বসতি গ্রহে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা তৈরি করা তার লক্ষণ। অন্য ধারা নিম্নমুখী। সেই ধারায় ভূগর্ভে প্রবেশ করা হয়। সভ্যতা গড়ে উঠে গ্রহের গভীরে। দ্বিতীয় ধারার সভ্যতা (নিম্নমুখী সভ্যতা) শ্রেষ্ঠ সভ্যতা বলে বিবেচনা করা হয়।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা, পৃষ্ঠা ১০০৩
চার হাজার নয়ের পৃথিবী অসংখ্য ছোট ছোট শহরে বিভক্ত। শহরগুলির কোনো নাম নেই। তাদের জন্যেও পিন নাম্বার। নিনিতারা যে শহরে বাস করে তার নাম
শহর ০০৩০০৭০০১/৫৫২
পিন নাম্বারগুলির একেকটির একেক অর্থ। এই অর্থ সাধারণ শহরবাসীর জানা নেই। জানার প্রয়োজনও নেই। শহরের পরিচালক একজন মেয়র। তিনি মানুষ নন, Humonoid Robot. শহরবাসীরা যে-কোনো সময় তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে শহরবাসীর সমস্যার সমাধান করেন।
শহরগুলির প্রধান বৈশিষ্ট হলো—সবই মাটির নিচে। শহরবাসীর মাটির নিচ থেকে বাইরে আসার নিয়ম নেই। আসতে হলে বিশেষ ধরনের সৌর স্যুট পরে আসতে হবে। এবং কেন বাইরে আসতে চায়, তার জন্যে মেয়রের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে। দিনেরবেলা বাইরে আসতে না দেয়ার প্রধান কারণ সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি। পৃথিবীর আয়ানোস্ফিয়ার নষ্ট হয়ে যাবার কারণে মহাজাগতিক রশ্মি মানুষের জন্যে অতি বিপদজনক হয়ে পড়েছে।
জীবাণুমুক্ত পরিবেশ এবং অতি উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণে মানুষ তিনশ থেকে চারশ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। মানুষকে এতদিন বাঁচিয়ে রাখা শহরের জন্যে কষ্টকর। ফুড প্রো সব তৈরি করতে পারছে, বিশুদ্ধ পানি তৈরি করতে পারছে না। প্রতিটি শহরের জন্যে বরাদ্দ করা পানি শহরবাসীকে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হয়। একশ বছর পার হবার পর পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরেও মানুষ খাবারে ব্যবহৃত পানি চা-কফি খেয়ে যত দিন ইচ্ছা বেঁচে থাকতে পারে। অনেকেই তা চায় না। তারা স্বেচ্ছামৃত্যুর জন্যে আবেদন করেন। শহরের মেয়র তা মঞ্জুর করেন।
গত তিনশ বছর ধরে মানুষকে সর্ব কর্ম থেকে মুক্ত করা হয়েছে। তাদের সব কাজ করছে রোবটরা। মানুষের প্রধান কাজ আনন্দে সময় কাটানো। মাটির নিচে অসংখ্য ফান সেন্টার আছে। কিছু কিছু যৌনপল্লী আছে। যৌনপল্লীতে পতিতা হিসেবে আছে হিউমনয়েড রোবট। এরা অপরূপ রূপবতী। মানুষের মতো ছলাকলায় সিদ্ধ। নৃত্য-গীতে পারদর্শী।
মাটির নিচে কৃত্রিম বন তৈরি করা আছে। বনে প্রাচীন পৃথিবীর প্রাণী বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা দেখতে অবিকল প্রাচীনকালের জীবজন্তুর মতো হলেও সবই রোবট। শহরবাসী ইচ্ছা করলেই এইসব প্রাণী শিকারে যেতে পারেন। তবে তাদের যথেষ্ট সাবধান হতে হয়। কারণ এইসব রোবট জন্তু হিংস্র এবং এরা রোবটের মূলনীতি মানে না। রোবটের মূলনীতি হলো—আমরা মানুষের ক্ষতি করব না। আমরা মানুষের অনিষ্ট হবে এমন কিছু হতে দেব না।
শিকারে যেতে হলে মেয়রের কাছ থেকে লাইসেন্স এবং অস্ত্র সংগ্রহ করতে হয়।
স্ট্যাটিসটিকস বলে, শতকরা ৭০.২১ ভাগ মানুষ শিকার থেকে জীবিত ফেরে না। যারা ফিরে তাদেরকে পুরস্কার হিসেবে একশ ক্রেডিট দেয়া হয়।
বিনোদনের জন্যে আগ্নেয়গিরি ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। তাপ নিরোধক পোশাক পরে জীবন্ত আগ্নেয়গিরির লাভার কাছাকাছি যাওয়া এবং ফিরে আসা। এই ভ্রমণও অত্যন্ত বিপদজনক। কারণ আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাতের কোনো নিয়মশৃঙ্খলা নেই। যে-কোনো সময় অগ্নৎপাত ঘটতে পারে।
স্ট্যাটিসটিকস বলে, শতকরা ৬০,৭৩ ভাগ অ্যাডভেঞ্চার পিপাসু মানুষ জীবিত ফিরতে পারে না। যারা ফিরে তারা একশ ক্রেডিট পায়।
শহরগুলি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। কারণ কোনো শহরের সঙ্গেই অন্য কোনো শহরের যোগাযোগ নেই। এক শহরের মানুষ জানে না অন্য শহরে কী হচ্ছে। তার পেছনেও কারণ আছে। মহাজাগতিক রশ্মির কারণে হঠাৎ হঠাৎ কিছু ভাইরাসের মিউটেশন হয়। এমন এক ভাইরাসের নাম V-305, যার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা রোবট বিজ্ঞানীরা এখনো নিতে পারে নি। V-305 ভাইরাসে শহরের যে-কোনো একজন আক্রান্ত হলে অতি দ্রুত ভাইরাস পুরো শহরে ছড়িয়ে পড়ে। শহরের সব মানুষের মৃত্যু ঘটে। শহর পরিত্যক্ত হয়। নতুন শহর তৈরি করা হয়।
মোট কতগুলি শহর পরিত্যক্ত হয়েছে তার পরিসংখ্যান সরকারের কাছে আছে। কোনো মানুষের কাছে নেই। এই তথ্য মানুষের কাছে নিষিদ্ধ।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়ে পৃথিবীর বাইরে কিছু কিছু জায়গায় মানুষ বসতি স্থাপন করেছে। যেমন মঙ্গল এবং বুধ গ্রহ। বৃহস্পতির দু’টা চাঁদ। এবং শনির বলয়ের ভেতরে তিনটি চাঁদ। এরা সেখানে কী করছে বা সেখানে কী হচ্ছে শহরবাসীর কাছে সেই তথ্যও নিষিদ্ধ।