আহান নতজানু হবার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকরা সবাই নতজানু হয়েছিল। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। দর্শকরাও উঠে দাঁড়াল। কুন স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি জানো অনেকের ধারণা আহান এই গ্রহের মানুষ না? অন্য গ্রহের।
নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, অতি বিখ্যাতদের নিয়ে নানান গল্প প্রচলিত থাকে।
কুন বলল, তাও ঠিক।
আহান কথা বলা শুরু করেছেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট এবং সুরেলা। নিনিতার মনে হলো এই মানুষটা গান না করে শুধু যদি কথা বলেন, তাও মানুষ ঘণ্টার পর ঘন্টা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে শুনবে।
আজ রাত অতি আনন্দের রাত। কিছু মা সন্তান ধারণের লাইসেন্স পাবেন। আহা, তাদের হৃদয়ে আজ কত না আনন্দ। আমি এক অতি অভাজন আহান। তাদের আনন্দ আমাকে স্পর্শ করছে। আমার চোখও তাদের আনন্দে সিক্ত।
আহান চোখ মুছলেন। দর্শকদের বেশিরভাগ চোখ মুছল। আহানের কথা শুনে তাদের চোখও ভিজে উঠেছে।
আহান বললেন, আজকের চন্দ্রগীতি ভাগ্যবতী মায়েদের উদ্দেশে নিবেদিত।
সঙ্গে সঙ্গে গান শুরু হলো—
(চন্দ্রগীতি)
হে চন্দ্র! আজ রাতে তোমাকে বিদায়।
আলো নেই অন্ধকার।
চন্দ্ৰবৃক্ষে হাহাকার।
অশ্রুর কারাগার।
আমরা কাঁদিতেছি গভীর মায়ায়
হে চন্দ্র! আজ রাতে তোমাকে বিদায়।
গানের প্রথম অন্তরা শেষ হয়েছে, আহান শিস দিতে সুর করেছেন। সুরের ওঠানামায় সবার মনে হচ্ছে, গভীর বিষাদের সমুদ্রে সবাই ভাসছে। বিষাদ আরো তীব্র হবে। একসময় সবাই ডুবে যাবে বিষাদ সমুদ্রে।
নিনিতা স্বামীকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কুন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছে। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না।
রাত বারোটা পার করে নিনিতা ঘরে ফিরল। ঘরে কফির গন্ধ। ফুড প্রো আগেভাগেই কফি বানিয়ে রেখেছে। ফুড প্রো আগেভাগে কিছু কাজ করে, যা নিনিতার পছন্দ না। অথচ তার কফি খেতে ইচ্ছা হচ্ছে। নিনিতা বলল, কফি নষ্ট করে দাও। কফি খাবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
ফুড প্রো বলল, ম্যাডাম, শ্যাম্পেনের একটা বোতল কি খুলব?
নিনিতা বলল, শুধু শুধু শ্যাম্পেনের বোতল কেন খুলবে?
ফুড প্রো বলল, ন্যাশনাল ইনফরমেশন সার্ভিস জানিয়েছে আপনি সন্তান গ্রহণের লাইসেন্স পেয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। টেলিভিশন চালু করুন। সুরের মহান জাদুকর আহান প্রতিটি লাইসেন্স পাওয়া মাকে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছেন। নতুন সব কে তিনি চন্দ্রমাতা সম্বোধন করছেন।
নিনিতা ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তার কাছে মনে হচ্ছে সবকিছু দুলছে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা লাগছে। শরীর ঘামছে। নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল, টিভি চালু করছ না কেন?
কুন ছুটে গিয়ে টিভি চালু করল। পর্দায় আহানের আনন্দময় মুখ। তিনি বললেন, চন্দ্রমাতা, তোমাকে অভিনন্দন। তোমার কোল আলো করে যে চন্দ্ৰশিশু আসছে তাকেও অভিনন্দন।
কুন ফুড প্রোর দিকে তাকিয়ে বলল, এই গাধা! শ্যাম্পেনের বোতল খুলছ না কেন?
ফুড প্রো শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে খুলতে বলল, গাধা নামক প্রাণী পৃথিবী থেকে কত আগে extinct হয়ে গেছে, অথচ তাকে জড়িয়ে গালিটা রয়ে গেছে। এটা অবশ্যই একটা বিস্ময়কর ঘটনা।
নিনিতা বলল, আমাকে শুইয়ে দাও। আমি এই আনন্দ নিতে পারছি না।
ফুড প্রো বলল, শুয়ে শুয়ে শ্যাম্পেন কীভাবে খাবেন ম্যাডাম?
নিনিতা বলল, সেটা আমার বিষয়। গাধার গাধা!
টিভি পর্দায় টুনটুন ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে। এর মানে সরকারি জরুরি নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। নিনিতা তাকালো।
হবু মা’দের প্রতি নির্দেশমালা
একের পর এক নির্দেশ প্রচারিত হচ্ছে। নির্দেশগুলির দিকে তাকিয়ে থাকাও আনন্দের ব্যাপার। নিনিতার চোখে একটু পরপর পানি এসে যাচ্ছে। সে নির্দেশ ঠিকমতো পড়তে পারছে না।
চন্দ্রমাতাদের প্রতি নির্দেশ
ক) নিজের পছন্দের সব খাবার এখন থেকে বন্ধ। আপনাকে যে খাবার খেতে দেয়া হবে তাই খাবেন।
খ) নিউজ চ্যানেলে ভিন গ্রহের প্রাণীদের নিয়ে অনুষ্ঠান দেখা বন্ধ। প্রাণীদের অবয়ব এবং আচার-ব্যবহার চন্দ্রমাতাদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করতে পারে।
গ) পৃথিবীতে উৎপন্ন হয় না এমন সব খাদ্য যেমন Martian salad খাওয়া নিষিদ্ধ।
ঘ) ভূগর্ভের দ্বিতীয় স্তরে চলে যেতে হবে। মহাজাগতিক রশ্মির হাত থেকে বাঁচার জন্যেই এই ব্যবস্থা।
নিনিতা চন্দ্রমাতাদের প্রতি নির্দেশ পড়ছে না। সে বিছানায় বসে আছে। দুই হাতে তার মুখ ঢাকা। সে কেঁদেই যাচ্ছে। ফুড প্রো বলল, আপনার আনন্দ দেখে এত ভালো লাগছে! রোবটদের সন্তান ধারণের ক্ষমতা থাকলে আমি একটা সন্তান নিতাম। তাঁর নাম দিতাম সুশীন। সুশান নামটা কেমন?
চুপ কর।
না, আমি চুপ করব না। আপনি যেমন আনন্দ করছেন আমিও আনন্দ করছি। আজ আমি মানুষদের মতো বেশি কথা বলব। আপনি কান্না না থামানো পর্যন্ত বকবক করতেই থাকব।
নিনিতা বলল, কুন কোথায়? সে কী করছে?
ফুড প্রো বলল, হা করে পর্দায় চন্দ্রমাতাদের নির্দেশ পড়ছে। আপনার এখন উচিত স্বামীর কাছে যাওয়া। তার কোমর জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ নাচানাচি করা। আমি নাচের একটা প্রাচীন মিউজিক দিচ্ছি। এই মিউজিক প্রাচীন পৃথিবীর একজন মহান সুরকার কম্পোজ করেছিলেন। তার নাম মোৎসার্ট। দেব?
না। আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই।
মানব সম্প্রদায়ের স্বভাবের মধ্যে একা থাকার বিষয়টি নেই। সে একা থাকতে পছন্দ করে না। যখন সে বাধ্য হয়ে একা থাকে, তখনো তার কল্পনায় থাকে অনেক মানুষ।