জানি। দুই মিলিয়ন ক্রেডিট। ওরা আমার কাছ থেকে পছন্দের তালিকা চেয়েছে। দামের কথা জিজ্ঞেস করে নি। তোমার পছন্দ কী বলো তো?
নিনিতা বলল, আমার আর যাই পছন্দ হোক রিরি পছন্দ না।
ফুড প্রো অবাক গলায় বলল, ম্যাডাম, রিরি কেন পছন্দ করবেন না? রিরি একমাত্র পশু যে সব পশুর ভাষা বুঝে সেই ভাষায় কথা বলতে পারে।
নিনিতা বলল, আমার ভাষাবিদ পণ্ডিতের কোনো প্রয়োজন নেই। তারচেয়েও বড় কথা, আমাদের কথার মধ্যে নাক গলাচ্ছ কেন?
ফুড প্রো বলল, হঠাৎ রিরির প্রসঙ্গ উঠল তো। নিজেকে সামলাতে পারলাম। পেট (Pet) রাখার অনুমতি আমাকে দেয়া হলে আমি একটা রিরি পুষতাম। তাকে নানান ধরনের খাবার বানিয়ে খাওয়াতাম।
অনেক কথা বলে ফেলেছ। আর না।
আপনাদের খাবার কি শেষ? টেবিল সরিয়ে ফেলব।
হ্যাঁ।
নিনিতা এবং কুন সরে দাঁড়াল। খাওয়াদাওয়া শেষ হবার পর খাবার ঘর গোছানোর দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে! এই দৃশ্য অসংখ্যবার দেখা, তারপরেও মনে হয় প্রথমবার দেখা হচ্ছে।
ফুড প্রোর ময়লা নিষ্কাশন প্যানেল খুলে গেল। সেখান থেকে দু’টা হাত বের হয়ে টেবিলের ওপর থেকে থালাবাসন, মোমবাতি, অবশিষ্ট খাবার টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল। খটখট শব্দ হচ্ছে। চেয়ার এবং টেবিল ভাজ হচ্ছে। এখন চেয়ার টেবিল ঢুকে যাচ্ছে সার্ভারের ভেতর। ভ্যাক কাজ করতে শুরু করছে। ভ্যাক চেয়ার-টেবিলের নিচের জায়গাটা নিমিষে ঝকঝকে করে ফেলবে। তারপর সেখানেই পাতা হবে ঘুমানোর আরামদায়ক বিছানা। লোবিড় সুপার পাউডার ভর্তি তোষক, চাদর এবং বালিশ চলে আসবে। যে বিছানায় শোবে তার শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে খাপ খাইয়ে লোবিড সুপার পাউডার তার তাপমাত্রা বদলাতে থাকবে।
নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি ঘুমাবে কখন?
বুঝতে পারছি না। ঘুম পাচ্ছে না। পে চ্যানেলে কিছু দেখবে?
অযথা ক্রেডিট নষ্ট করে লাভ আছে?
কুন বলল, ঘরের ভেতর কেন জানি দমবন্ধ হয়ে আসছে।
নিনিতা বলল, রাস্তায় হাঁটতে যাবে?
কুন বলল, রাস্তায় বের হলেও তো একশ ক্রেডিট করে লাগবে।
ফুড প্রো বলল, আজ রাত এগারোটা পর্যন্ত বাইরে বের হলে ক্রেডিট খরচ করতে হবে না।
নিনিতা বলল, না কেন?
আপনাদের দুজনের কারোরই মনে নেই–আজ সেই বিশেষ রাত। আজ রাত বারোটায় ভাগ্যবান তরুণীদের তালিকা ঘোষণা করা হবে। যারা সন্তান নিতে পারার লাইসেন্স পাবেন।
নিনিতা শুকনো গলায় বলল, ও আচ্ছা।
এই বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। কারণ তার বয়স একচল্লিশ। সন্তান নেবার লাইসেন্স চল্লিশের পরের কোনো মহিলাকেই দেয়া হয় না।
নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, চল বের হই। বিনা ক্রেডিটে কিছুক্ষণ ঘুরে আসি।
কুন বলল, এখন কেন জানি বের হতে ইচ্ছা করছে না।
ফুড প্রো বলল, সুযোগ নষ্ট করা ঠিক হবে না স্যার। আজ বাইরের আবহাওয়া অত্যন্ত আরামদায়ক। তাপমাত্রা ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাস। বইছে। চেরীগাছে ফুল ফুটেছে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে কনসার্ট হচ্ছে।
নিনিতা বিরক্ত গলায় বলল, এই খবরগুলি আগে কেন বলো নি?
বেশ কয়েকবার বলতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি আমাকে বেশি কথা বলতে নিষেধ করেছেন বলে বলি নি। তাছাড়া আপনারা দুজনের কেউই বাইরে যাবার বিষয়ে কখনো আগ্রহী না।
নিনিতা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল, যাবে?
কুন হতাশ গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।
ফুড প্রো বলল, ফিফথ রোডের মোড়ে মহান শিল্পী আহান গান করবেন। তাঁর বিখ্যাত চন্দ্রগীতি। এই সুযোগ হারানো ঠিক হবে না।
নিনিতা বলল, চন্দ্রগীতি আমার কাছে খুবই ফালতু মনে হয়।
কুন বলল, ফালতু মনে হলেও চন্দ্রগীতি শোনার সময় তুমি কেঁদে বুক ভাসাও। চল যাওয়া যাক।
.
ফিফথ রোড লোকে লোকারণ্য। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ফিসফিস করেও কেউ কিছু বলছে না। মাঝে মাঝে দমকা বাতাসে চেরীগাছের পাতা নড়ছে। সেই শব্দ দূরাগত সঙ্গীতের মতো কানে বাজছে।
মহান শিল্পী আহানের জন্যে ছোট্ট একটা স্টেজ করা হয়েছে। চন্দ্ৰবৃক্ষের গোল চত্ত্বরের মাঝখানে রিটো-পলিমারের তৈরি স্টেজ। মনে হয় পাথরের বেদি। যেখান থেকে নরম আলো বের হচ্ছে। স্টেজের নাম আহান বেদি। এই বেদিতে তিনি ছাড়া কেউ গান করেন না। শহরে চন্দ্ৰবৃক্ষের তিনটি গাছ শুধু এখানেই আছে। যদিও বলা হয় চন্দ্ৰবৃক্ষ, কিন্তু এই বৃক্ষ বৃহস্পতির চাঁদ টিটান থেকে আনা। বৃক্ষের ফসিল থেকে জেনেটিক পদ্ধতিতে নতুন জীবন দান করে। পাতাশূন্য এই বৃক্ষ একসময় তার ডালপালা ছড়িয়ে দেয়, যার রঙ গাঢ় নীল। আহান দলবল নিয়ে গান করেন না। একা গান করেন। ছোট্ট স্টেজ তার জন্যে যথেষ্ট। গানের মাঝে মাঝে তিনি শিস দেন। বলা হয়ে থাকে, আহানের শিসের সুরের জন্ম এই পৃথিবীতে না। অন্য কোনো সুরলোকে, যার সন্ধান মানুষ এখনো। পায় নি।
নিনিতা স্বামীকে নিয়ে এগুচ্ছে। কুন বলল, আর কাছে যাবার দরকার কী? এখান থেকে উনাকে পরিষ্কার দেখা যাবে।
নিনিতা ফিসফিস করে বলল, এত শব্দ করে কথা বলছ কেন?
সরি।
তারা বড় একটা চেরীগাছের নিচে দাঁড়াল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মহান শিল্পী আহান স্টেজে ঢুকলেন। স্টেজের মাঝখানে নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকদের সম্মান প্রদর্শন করলেন।
বেদির আলো এসে পড়েছে তার চোখেমুখে। কী সুন্দরই না লাগছে দেখতে। বালক বালক চেহারার একজন মানুষ। বড় বড় চোখ। সেই চোখের দৃষ্টিতে গভীর দুঃখবোধ। যেন তিনি কিছুক্ষণ আগেই তার অতি প্রিয়জনকে হারিয়েছেন। যার সঙ্গে এ জীবনে আর দেখা হবে না।