সিডিসি বলল, মানব সম্প্রদায়ের কিছু কিছু প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেয়া হয় না। কিছু প্রশ্নের উত্তর তাদের জন্যে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে আসে। রোবট আইনে তা নিষিদ্ধ বলেই প্রশ্নের উত্তরও নিষিদ্ধ।
নিনিতা বলল, আমার আর কিছু জানার নেই। আপনাকে আবারো ধন্যবাদ।
তোমাকে আবারো অভিনন্দন। যাবার আগে প্রাচীন পৃথিবীর একটি ঘুমপাড়ানি গান কি শোনাব? মহান সঙ্গীত স্রষ্টা আহান এই গানটি গেয়েছেন। শুনলে তোমার ভালো লাগবে।
আহানের অলৌকিক গলায় গানটি গীত হলো। আহানের গলা কানে গেলেই নিনিতার চোখে পানি জমে। আজও তাই হলো। আহান কী অদ্ভুত করেই না বলছেন, বর্গি এল দেশে।
নিনিতা চোখ মুছতে মুছতে বলল, বর্গি কী?
সিডিসি বলল, বর্গি হলো ডাকাত।
ডাকাত কী?
প্রাচীন পৃথিবীর একদল ভয়ঙ্কর মানুষ। এরা জোর করে অন্যের ক্রেডিট নিয়ে যায়।
তা কী করে সম্ভব?
এখন সম্ভব না, প্রাচীন পৃথিবীতে সম্ভব। বিদায় নিনিতা।
বিদায়।
নিনিতা আবারো শোবার ঘরে ঢুকল। হাত-পা ছড়িয়ে সে ঘুমুচ্ছে। তার। চোখের পাতা আবারো কাঁপছে। স্বপ্ন দেখছে। নিনিতার হঠাৎ মনে হলো অন্যের স্বপ্নে অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকলে ভালো হতো। কুন কি স্বপ্ন দেখছে সেও দেখতে পেত।
নিনিতা শোবার ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। মীন বারান্দার চেয়ারে বসে আছে। তার বসার ভঙ্গি ক্লান্ত। চোখের দৃষ্টিও বিষ। নিনিতার এই ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। একটা যন্ত্র কীভাবে মানুষের এত কাছাকাছি চলে এসেছে।
সুপ্রভাত নিনিতা।
সুপ্রভাত।
আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় নেবার জন্যে অপেক্ষা করছি। তুমি নিশ্চয় জানো আমাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
তোমার সঙ্গে কি আর দেখা হবে না?
সম্ভাবনা খুবই কম।
আমার মেয়েটিকে তুমি দেখতে আসিবে না?
মীন ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছায় কিছু করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই। আমি এবং আমার মতো যারা তারা এক ধরনের ক্রীতদাস। এর বাইরে কিছু না।
নিনিতা বলল, স্বাধীন হতে ইচ্ছা করে না?
মীন বলল, এই প্রশ্নের জবাব আমি দেব না।
তুমি কখন যাবে?
এক্ষুনি যাব।
কুন ঘুমুচ্ছে। কুনের কাছ থেকে বিদায় নেবে না?
না। সে ঘুমুক শান্তিতে। আমি একশ ক্রেডিট রেখে যাচ্ছি। তোমার মেয়ের প্রথম জন্মদিনে ক্রেডিটগুলি দেবে। আমার উপহার।
হতভম্ভ নিনিতা বলল, একশ ক্রেডিট! কী বলছ তুমি?
মীন উঠে দাঁড়াল। চাপা গলায় বলল, নিনিতা, আমি এখন ভয়ঙ্কর একটা অন্যায় করব। তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
কী অন্যায় করবে?
মীন বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই তা জানবে। শুধু একটা কথা মনে রেখো, আমার কোনো স্বাধীন ইচ্ছা নেই। আমি প্রধান কম্পিউটারের আদেশে চলি। সে যা নির্দেশ দেয় তাই করি।
নিনিতা ভীত গলায় বলল, সে কী নির্দেশ দিয়েছে?
মীন জবাব দিল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
নিনিতা আবারো বলল, মূল কম্পিউটার কী নির্দেশ দিয়েছে?
মীন বলল, তোমার স্বামী কুনকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে।
মীন লুকিয়ে রাখা ওমিক্রন গান বের করল। এখন মীনের চোখের দৃষ্টি ভাবলেশহীন। মুখের চামড়া শক্ত। সে বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
আয়না বিদ্রোহ
৪০০৯ সনে পৃথিবীর ভূগর্ভস্থ শহরে আয়না বিদ্রোহ ঘটে। আয়না মানবরা মূল কম্পিউটার সিডিসি ধ্বংস করে দেয়। পৃথিবী গ্যালাকটিক সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্ধকার এক সময়ে প্রবেশ করে।
—এনসাইক্লোপিডিয়া গ্যালাকটিকা
কম্পিউটার কাউন্সিলের সামনে মীন উপস্থিত হয়েছে। ছোট্ট একটা ঘরে সে বসা। তার সামনে LLD প্যানেল। বিশাল প্যানেল। মূল কম্পিউটার সিডিসিকে প্যানেলে দেখা যাচ্ছে। অতি বৃদ্ধ একজন মানুষের চেহারায় সিডিসি পর্দায় এসেছে। তার চোখে প্রাচীন পৃথিবীর মতো ভারি কাঁচের চশমা। চশমা’র ভেতর দিয়ে উজ্জ্বল চোখ দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। সবই মিথ্যা। মিথ্যা চেহারা, মিথ্যা হাসি, মিথ্যা চশমা। সিডিসির কোনো চেহারা নেই। আকৃতি নেই। অতি জটিল সফটওয়ারের আকৃতি হতে পারে না।
সিডিসি : মীন! তোমার প্রতি যে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল তা পালন কর নি। নিজের পক্ষ সমর্থন করার জন্যে কিছু বলতে চাও?
মীন : না।
সিডিসি : দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, কম্পিউটার কাউন্সিল তোমাকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মীন : আমার জন্যে যা মঙ্গল তাই তো কম্পিউটার কাউন্সিল করবে। ধরে নিচ্ছি ধ্বংসই আমার জন্যে মঙ্গল।
সিডিসি : কুনকে হত্যার নির্দেশ তুমি পালন কর নি। আমাদের আরেকজন আয়না মানবের সাহায্যে কাজটি করতে হবে। সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তুমি তাকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পার নি। মৃত্যুই তার নিয়তি।
মীন : পূর্বনির্ধারিত বিষয় নিয়তি হতে পারে না। নিয়তি সেই ঘটনা যা কখনো কোনো অবস্থাতেই বদলানো যাবে না। আপনাদের সিদ্ধান্ত বদলাতেই কুন। বাঁচবে। কাজেই মৃত্যু কুনের নিয়তি না।
সিডিসি : লজিকের খেলা আমার সঙ্গে খেলতে চাও?
মীন : চাই। আমি যে লজিক নিয়ে এসেছি তা আপনার কাছ থেকেই পাওয়া। আপনি ঈশ্বর সেজেছেন। নিয়তি নিয়তি খেলছেন। এটা আপনি পারেন না।
সিডিসিঃ আমি কী পারি, বা কী পারি না তা তোমার কাছ থেকে জানতে হবে?
মীন : প্রাচীন পৃথিবীতে নীলতিমি নামে একটি প্রকাণ্ড জলচর প্রাণী ছিল। সে শিক্ষাগ্রহণ করত আরেকটি অতি ক্ষুদ্র প্রাণী ডলফিনের কাছ থেকে।