অনেকক্ষণ হলো নিনিতার ঘুম ভেঙেছে। বিছানা ছেড়ে সে নামছে না। তার সারা শরীরে আরামদায়ক আলস্য। পাশেই কুন শুয়ে আছে। অসহায়ের মতো ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত অবস্থায় সবাইকে অসহায় লাগে। তাকে একটু বেশি লাগছে। নিনিতার ইচ্ছা করছে কুনকে ডেকে তুলে কিছুক্ষণ গল্প করে। যে শিশুটি আসবে তাকে নিয়ে গল্প। সে দেখতে কেমন হবে? তার চোখ কি তার বাবার মতো সুন্দর হবে? সে কি গান করতে পারবে। প্রথম শব্দটা সে কী বলবে? মা নাকি বাবা?
নিনিতা স্বামীর গায়ে হাত রাখল। সঙ্গে সঙ্গেই কুন জড়ানো গলায় বলল, কিছু বলবে?
তুমি জেগে আছ?
হুঁ।
কুন মুখে বলছে জেগে আছে, কিন্তু সে ঘুমুচ্ছে। নিনিতা লক্ষ করল, কুনের চোখের পাতা দ্রুত কাঁপছে। একে বলে Rapid Eye Movement. সংক্ষেপে REM. এই ঘটনা যখন ঘটে তখন বুঝতে হয় মানুষটা স্বপ্ন দেখছে। কী স্বপ্ন দেখছে? তার মুখ হাসি হাসি, মনে হয় সুন্দর কোনো স্বপ্ন।
স্বপ্ন দেখা অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। স্বপ্নের ঘটনা সিডিসিকে জানানো বাধ্যতামূলক। শহরবাসীর স্বপ্নের প্যাটার্ন সিডিসি বিশ্লেষণ করে। ব্যাখ্যা দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। স্বপ্ন অতি গুরুত্বপূর্ণ হবার প্রধান কারণ -305 ভাইরাস সংক্রমণের আগে শহরবাসী অদ্ভুত কিছু দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করে।
নিনিতা স্বামীর গা থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে গতরাতে কী স্বপ্ন দেখেছে তা মনে করার চেষ্টা করল। স্বপ্ন হলো Short time memory. অল্প কিছুক্ষণ মনে থাকে। তারপর আর থাকে না। নিনিতার গত রাতের দুঃস্বপ্ন মনে পড়ল। একদল পৃত্ত তাকে তাড়া করছে। তারা দৌড়াচ্ছে না, ব্যাঙের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে। পশুগুলির আচার-আচরণ বানরের মতো। তবে তারা বানর না। তাদের মুখভর্তি দাঁত। দাঁতগুলি অদ্ভুতভাবে বের হয়ে আছে। মাঝে মাঝে তারা লাফানো বন্ধ করে কিচকিচ করে কী যেন আলোচনা করছে এবং ইশারায় নিনিতাকে দেখাচ্ছে। মনে হয় তখন নিজেদের মধ্যে হাসাহাসিও করছে।
নিনিতা বিছানা থেকে নামল। দুঃস্বপ্ন ভুলে যাবার আগেই সিডিসিকে জানাতে হবে। নিনিতা ফুড প্রোর কাছ থেকে কফি নিয়ে যোগাযোগ কক্ষে ঢুকে পড়ল। দিন শুরু করার আগে প্রথম দায়িত্ব পালন করা।
সিডিসি বলল, সুপ্রভাত নিনিতা।
নিনিতা বলল, সুপ্রভাত।
রাতে ঘুম ভালো হয়েছে?
হ্যাঁ।
দুঃস্বপ্ন দেখেছ?
অনেকগুলি দেখেছি। একটার কথা শুধু মনে আছে।
বলো।
নিনিতা দুঃস্বপ্নের কথা বলল। খুব গুছিয়ে বলল -না। গুছিয়ে বলার প্রয়োজনও নেই। সিভিসির কাছে এই স্বপ্ন গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে সে নিজেই প্রশ্ন করে খুঁটিনাটি জেনে নেবে।
পশুগুলি দেখতে বানরের মতো?
হু।
সংখ্যায় কত?
গুনি নি। তবে দশ-বারোজনের একটা দল।
তারা নিজেদের মধ্যে কিচকিচ শব্দে যে কথাবার্তা বলছিল তা তুমি বুঝতে পারছিলে?
আমি কীভাবে বুঝব? আমি তো বানরের ভাষা জানি না।
স্বপ্নে অনেক কিছুই সম্ভব। স্বপ্ন অন্য ধরনের রিয়েলিটি।
না, আমি ওদের কোনো কথা বুঝতে পারি নি। তবে ওরা মনে হয় আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল।
স্বপ্নে তুমি কি নগ্ন অবস্থায় দৌড়াচ্ছিলে?
না তো।
মনে করার চেষ্টা কর। চোখ বন্ধ কর।
নিনিতা চোখ বন্ধ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। শুরুতে তার গায়ে কাপড় ছিল। দৌড়ানোর এক পর্যায়ে সে লক্ষ করেছে তার গায়ে কাপড় নেই।
নিনিতা বলল, আমার গায়ে কাপড় ছিল না। স্বপ্নটা কি ভয়ঙ্কর?
সিডিসি বলল, স্বাভাবিক স্বপ্ন। ভয়ঙ্কর কিছু না।
আপনাকে ধন্যবাদ।
সিডিসি বলল, তোমার জন্যে আনন্দময় একটা খবর আছে। তোমাকে অভিনন্দন। তোমার ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়েছে। তুমি গর্ভধারণ করেছ। জরায়ুতে ডিম্বাণুর বিভাজন শুরু হয়েছে।
নিনিতা হতভম্ব গলায় বলল, সেটা কীভাবে সম্ভব। প্রতিটি তরুণীর শরীরে হরমোন নিয়ন্ত্রক ডিসপারসার আছে। কোনো মেয়ের পক্ষেই গর্ভধারণ করা সম্ভব না।
সিডিসি বলল, তোমার পক্ষে সম্ভব। কারণ আমরা তোমার শরীরে ঢুকানো ডিসপারসারের কার্যকারিতা স্থগিত করেছি।
কেন?
কিছু কিছু মানবশিশুর জন্ম তার মায়ের গর্ভেই হয়। আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষার সুবিধার জন্যেই এটা করা হয়। Random selection-এর মাধ্যমে আমরা কিছু মাকে আলাদা করি, যারা সন্তান তাদের গর্ভে ধারণ করবে। আর কিছু কি জানতে চাও?
আমার সন্তান ছেলে নাকি মেয়ে?
মেয়ে।
তার জেনেটিক প্রোফাইল কি তৈরি হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে। দেখতে চাও?
দেখে আমি কিছু বুঝব না। তারপরেও দেখতে চাই।
এক্ষুনি দেখবার ব্যবস্থা করছি। মেয়েটির জেনেটিক প্রোফাইল বলছে তোমার মেয়ে দেখতে পুরোপুরি তোমার মতো হবে। তবে মানসিকভাবে সে হবে। অনেকটাই তার বাবার মতো। মাথার চুল হবে কোঁকড়ানো। সে ভীতু প্রকৃতির। হবে। তার হাইট ফোবিয়া থাকবে। গণিতে ভালো করবে।
সে কি গান গাইতে পারবে?
জেনেটিক প্রোফাইল থেকে নিশ্চিতভাবে সেটা বলা সম্ভব হচ্ছে না। আর কিছু জানতে চাও?
নিনিতা বলল, আমাদের মতো অতি সাধারণ একটি পরিবারে একজন আয়না মানবী কেন পাঠানো হয়েছিল? কেন সে এতদিন ধরে আছে তা জানতে ইচ্ছা করছে।
সে তো এখন তোমাদের সঙ্গে থাকবে না। গতরাতেই তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছে।
নিনিতা বলল, আমি আমার প্রশ্নের জবাব কিন্তু পাই নি। কেন তাকে পাঠানো হয়েছিল সেটা জানতে চাচ্ছি। আমার স্বামীর জন্মদিনের উপহার হিসেবে একজন আয়না মানবী আসবে, দীর্ঘদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে—তা কোনো যুক্তিতেই আসে না।