আহান বললেন, না। আমার আশেপাশে কেউ থাকলে আমার ভালো লাগে না।
নিনিতা আহত গলায় বলল, আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত।
আহান বললেন, তুমি মনে হয় রাগ করেছ? কেউ আমার ওপর রাগ করলেও আমার ভালো লাগে না। তোমরা পায়ের কাছে কতক্ষণ বসতে চাও?
কুন বলল, যেই মুহূর্তে আপনি চলে যেতে বলবেন, আমরা চলে যাব। আজ আমাদের বিশেষ একটি দিন। আমরা দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ খুঁজে পেয়েছি।
আহান বললেন, আমার হারিয়ে ফেলার কেউ নেই। কাজেই খুঁজে পাওয়ারও কেউ নেই। আমি মাঝে মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলি, আবার খুঁজে পাই। তোমরা বসো। পায়ের কাছে বসতে হবে না। বেদিটার ওপর বসো।
নিনিতা বলল, আমরা দুজন কি আপনার দুপাশে বসব?
তোমাদের যেভাবে বসতে ইচ্ছা করে সেইভাবে বসো। শুধু খুব খেয়াল রাখবে, আমার গায়ের সঙ্গে তোমাদের গা যেন না লাগে। আমি মানুষের স্পর্শ সহ্য করতে পারি না।
তারা আহানের দুপাশে না বসে সামনে ঘাসের ওপর বসল। আহান বললেন, তোমরা মানুষ, না SF রোবট?
নিনিতা বলল, আমরা মানুষ।
আহান বললেন, মৃত্যুঘণ্টা বাজছে এমন এক সম্প্রদায়?
মৃত্যুঘণ্টা বাজছে কেন বলছেন?
আহান বললেন, ঘণ্টার শব্দ শুনছি বলেই বলছি। মানুষ আশ্চর্য এক সম্প্রদায়, যার প্রধান কাজ অপেক্ষা করা। তারা অপেক্ষা করে আছে ভাইরাস সংক্রমণের।
নিনিতা বলল, এইসব শুনতে ভালো লাগছে না। আপনি আনন্দময় কিছু বলুন।
আহান বললেন, ভাইরাস সংক্রমণ কিন্তু ভাইরাসের জন্যে আনন্দময়। আমি নির্জনে এসে প্রায়ই কী ভাবি জানো? আমি ভাবি ভাইরাসের জীবনেও কি সুখ দুঃখ আনন্দ-বেদনা আছে? সঙ্গীত আছে? চিত্রকলা আছে?
কুন বলল, আপনার কি মনে হয় আছে?
আহান বললেন, আমার মনে হয় আছে। তাদের মতো করে আছে। তারা যেমন আমাদের আনন্দ-বেদনা বুঝতে পারে না, আমরাও তাদেরটা পারি না। অনেকক্ষণ কথা বলে ফেলেছি, এখন আমাকে একা থাকতে দাও।
কুন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। নিনিতা উঠল না। বসে থেকেই বলল, আমার ছোট্ট একটা প্রশ্ন ছিল। প্রশ্নটা করেই আমি চলে যাব। উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করব না।
প্রশ্ন করবে, তারপর উত্তর না শুনেই চলে যাবে?
নিনিতা বলল, হ্যাঁ। কারণ আপনার কাছে প্রশ্নটার উত্তর নেই।
প্রশ্ন কর।
নিনিতা বলল, রোবটরা ইচ্ছা করে ভাইরাস সংক্রমণ ঘটাচ্ছে। তারা চেষ্টা করছে মানব সম্প্রদায় ধ্বংস করে দিতে। এটা কি ঠিক?
আহান কোনো জবাব দিলেন না। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললেন।
নিনিতা বলল, অনেকক্ষণ আপনার কাছাকাছি থাকতে পেরেছি। আমাদের জীবন ধন্য।
আহান দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। মনে হচ্ছে এদের তিনি চিনতে পারছেন না।
.
সন্ধ্যা মিলিয়েছে।
কুন তার স্ত্রীকে নিয়ে বারান্দায় বসেছে। সমুদ্রের দৃশ্য বদলে দেয়া হয়েছে। এখন পর্বতমালার ছবি। তুষারঢাকা পর্বতমালা। চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গ ঝলমল করছে।
নিনিতা বলল, আমরা নকল এক জগতে বাস করি, তাই না?
প্রশ্ন করা হয়েছে কুনকে, জবাব দিল মীন। সে কোন ফাঁকে বারান্দায় এসেছে। তা কেউ লক্ষ করে নি। মীন বলল, নকল জগতে বাস করছ বলেই জগতটা বোতাম টিপে বদলানো যাচ্ছে। আসল জগৎ বদলাতে পারতে না।
নিনিতা বলল, তোমাকে আমি কোনো প্রশ্ন করি নি। তুমি জবাব দিচ্ছ কেন?
তোমাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করছি। এটা ভব্যতা। আমাকে তুমি অপমান করার চেষ্টা করেই যাচ্ছি—এটা অতা।
নিনিতা বলল, যন্ত্রের কাছে আমি ভব্যতা, অসভ্যতা শিখব না।
মীন বলল, যন্ত্র না ভেবে আমাকে বুদ্ধিমান সত্তা ভাবলে তোমার সমস্যা মিটে যেত।
নিনিতা বলল, আমার সমস্যা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। তুমি কেন বারান্দায় এসেছ?
চলে যেতে বলছ?
হ্যাঁ, চলে যেতে বলছি। তুমি শুধু যে বারান্দা থেকে চলে যাবে তা না। আমাদের এখান থেকে পুরোপুরি চলে যাবে। তোমাকে আমার বা কুনের প্রয়োজন নেই।
মীন বলল, তোমার প্রয়োজন নেই তা মানতে আমি রাজি আছি। কুনের প্রয়োজন নেই তা বলছ কীভাবে? তুমি এবং কুন আলাদা সত্তা।
কুন বলল, আলোচনা বন্ধু থাকুক। মীন, তোমাকে দেখে নিনিতা বিরক্ত হচ্ছে। এবং তোমার ভাবভঙ্গি দেখে আমার মনে হচ্ছে, তুমি নিজেও চাচ্ছ সে বিরক্ত হোক। কেন?
মীন বলল, তোমার স্ত্রী যেমন আমাকে ঈর্ষা করছে, আমিও তাকে ঈর্ষা করছি—এটাই একমাত্র কারণ।
নিনিতা বলল, তুমি আমাকে ঈর্ষা করবে কেন? তুমি যন্ত্র! যন্ত্রের আবার ঈর্ষা কী?
যে অর্থে আমি যন্ত্র সেই অর্থে তুমিও যন্ত্র। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্র। আমি অনেকাংশে ত্রুটিমুক্ত।
নিনিতা বলল, এই মুহূর্তে তুমি বারান্দা থেকে চলে যাবে। আমি এক থেকে চার গুনব, তার মধ্যে যাবে। এক-দুই-তিন-চার।
মীন বলল, তুমি এক থেকে শুরু করে চার বিলিয়ন পর্যন্ত গুনে যাও। আমি যাব না।
নিনিতা কঠিন গলায় বলল, যাবে না?
মীন বলল, না।
সে জানালার বাইরে পর্বতমালার দিকে মুখ করে মেঝেতে বসতে বসতে বলল, আমি শুধু যে বারান্দা থেকে চলে যাব না, তা-না। তোমরা দুজন যখন বিছানায় শুতে যাবে, তখন আমিও তোমাদের সঙ্গে শোব। তোমাদের যদি কোনো জৈবিক কর্মকাণ্ডের ইচ্ছা থাকে তাহলে জানিয়ে রাখছি—আমি ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে সেই হাস্যকর দৃশ্য দেখব। তোমরা যদি বাতি নিভিয়ে দাও, তাতেও লাভ হবে না। আমার চোখ ইনফ্রা রেড সেনসেটিভ। আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।