নিনিতা বলল, কী দায়িত্ব?
কুন বলল, জানি না।
তারা দুজন বসেছে বারান্দায়। বারান্দাগুলি এমনভাবে বানানো যে, ইচ্ছা করলেই বোতাম টিপে জানালার বাইরের দৃশ্য বদলানো যায়। দৃশ্যগুলি এতই বাস্তব যে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই ভুলে যায় জানালার বাইরে যা দেখা যাচ্ছে সবই মায়া।
জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। পানির রঙ গাঢ় নীল। পানির ওপরের আকাশও নীল। আকাশে শাদা মেঘের স্তৃপ। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে বিশাল ঢেউ আসছে। তখন জানালার কাছে পানি ছিটকে পড়ছে।
মীনকে বারান্দায় ঢুকতে দেখা গেল। তার দুহাতে দু’টা কফির মগ। টাটকা কফির গন্ধ আসছে। নিনিতা কঠিন গলায় বলল, আমরা কফি চাই নি। কফি কেন এনেছ?
মীন বলল, খেতে না চাইলে খেও না। মগ দু’টা সামনে থাকল। দীর্ঘ সময়। হাত ধরাধরি করে বসে থাকা বিরক্তিকর ব্যাপার। হঠাৎ করে হাত ছাড়িয়ে নেয়াও অস্বস্তিকর। কফির মগ সামনে থাকা মানে হাত ছাড়িয়ে নেয়ার অজুহাত তৈরি করে দেয়া। কফি খাবে এই অজুহাতে যে-কোনো সময় হাত ছেড়ে কফির মগে হাত রাখতে পারবে।
নিনিতা বলল, তোমার জ্ঞানী জ্ঞানী কথা শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না। দয়া করে আমাদের একা থাকতে দাও।
মীন বলল, একটা আনন্দ সংবাদ তোমাদের দিতে এসেছি। সংবাদটা দিয়েই চলে যাব।
কী সংবাদ?
মীন বলল, আমি তোমাদের জন্যে দু’টা পাস জোগাড় করেছি। পাস নিয়ে তোমরা আজ সারাদিন চন্দ্ৰবাগানে ঘুরতে পারবে।
নিনিতা বলল, চন্দ্ৰবাগানে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখতেই আমাদের ভালো লাগছে।
মীন বলল, তাহলে সমুদ্র দেখ। তবে মহান আহান প্রায়ই চন্দ্ৰবাগানে একা একা হেঁটে বেড়ান। তার সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে। আমার পরামর্শ চাইলে আমি বলব চন্দ্ৰবাগানে যেতে।
নিনিতা বলল, তোমার উপদেশের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা নিজেরাই আমাদের পরিকল্পনা ঠিক করব।
মীন বলল, যদি বেড়াতে যাওয়া ঠিক কর তাহলে খাবার নিয়ে যেও। তারচেয়ে বড় কথা, তোমার জন্যে দুটি টিটান ড্রিংসের বোতল আলাদা করে রাখা আছে। বোতল দু’টা নিতে ভুলে যেও না।
নিনিতা বলল, আমরা চন্দ্ৰবাগানে যাব না। তুমি দয়া করে তোমার থ্যাবড়া নাক নিয়ে দূর হও।
.
নিনিতা কুনের হাত ধরে বাগানে হাঁটছে। এই বাগানে আগেও অনেকবার এসেছে। আজকের মতো কখনো লাগে নি। বাগান ফকী। কেউ নেই। বিশাল সব গাছ। শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে। চারদিক অস্বাভাবিক নীরব বলেই পাতা ঝরার শব্দও কানে আসছে। হালকা বাতাস দিচ্ছে। বাতাস বেশ শীতল। শরীরে কাপন লাগে।
কুন স্ত্রীর হাত ধরে বাগানে সাজানো মূর্তি দেখে বেড়াচ্ছে। মূর্তিগুলো ভিনগ্রহের সুসভ্য প্রাণীদের। অবিকল তাদের মতো তৈরি করা। ভিনগ্রহের প্রাণের বিবর্তনের ধারা। সভ্যতা মাপকাঠির সূচক। গ্যালাক্সিতে তাদের অবস্থান, জীবনযাত্রা পদ্ধতি সবই দেয়া আছে।
এখন তারা দাঁড়িয়ে আছে অতি সুসভ্য সম্প্রদায় টেরা মূর্তির সামনে। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ ভেদাভেদ নেই। এদের অল্পকিছু হঠাৎ নারীতে রূপান্তরিত হয়। গর্ভধারণ করে সন্তানের জন্ম দিয়েই তার মৃত্যু। তাদের সভ্যতা সূচক ৮.২১, যেখানে মানব সম্প্রদায়ের সভ্যতা সূচক ৬,০১। সভ্যতার মাপকাঠিতে এদের অবস্থান অনেক উঁচুতে।
নিনিতা বলল, এদের চোখ দেখতে আমাদের চোখের মতো।
কুন বলল, হু।
নিনিতা বলল, কত লম্বা দেখেছ?
কুন বলল, হু।
নিনিতা বলল, এরা কি কথা বলতে পারে?
কুন বলল, এদের বিষয়ে সব তথ্য লেখা আছে, পড়ে দেখ।
নিনিতা বলল, কিছু পড়তে ইচ্ছা করছে না। অন্য আরেকদিন এসে পড়ব। চল আজ শুধু মূর্তি দেখে বেড়াই।
কুন বলল, চল যাই। এদের বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে মীনকে জিজ্ঞেস করলেও হবে। সে সুন্দর করে বলবে।
নিনিতা বলল, আমি মীনের কাছ থেকে কিছু জানতে চাই না। আমার যা জানার তোমার কাছ থেকে জানব।
আমি তো তেমন কিছু জানি না।
তুমি না জানলে আমিও জানব না।
নিনিতা হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। চল্লিশ-পঞ্চাশ গজ দূরে পাথরের বেদি। সেখানে মূর্তির ভঙ্গিতে যিনি বসে আছেন, তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। তবে তিনি যে মহান আহান—এই বিষয়ে নিনিতার মনে কোনো সন্দেহ নেই। নিনিতা চাপা গলায় বলল, উনি আহান না?
কুন বলল, দূর থেকে সেরকমই মনে হচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখবে?
নিনিতা বলল, উনি বিরক্ত হবেন।
বিরক্ত হলে হবেন।
নিনিতা বলল, তাঁকে বলব কী?
কুন বলল, তাকে বলব আজ আমাদের বিশেষ একটি দিন। আমরা দুজন দুজনকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ খুঁজে পেয়েছি। আপনার সামনে আমরা দুজন যদি কিছুক্ষণ বসে থাকতে পারি, তাহলে আমাদের জীবন ধন্য হবে।
উনি যদি না বলেন?
না বললে চলে আসব। যাবে?
নিনিতা অস্পষ্ট গলায় বলল, বুঝতে পারছি না।
কুন বলল, তোমার মন না চাইলে যাব না। নিজেরা নিজেরা ঘুরে বেড়াই।
কুন উল্টোদিকে হাঁটতে শুরু করেছে। নিনিতা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। অস্পষ্ট গলায় বলল, চল উনার কাছেই যাই। এত কাছে এসেও কথা না বলে চলে যেতে ইচ্ছা করছে না।
আহান পায়ের শব্দে মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। সামান্য হাসলেন। চাপা গলায় বললেন, কী সুন্দর দিন। তাই না? যদিও সবই কৃত্রিম। তারপরেও সুন্দর।
নিনিতা বলল, আমরা দুজন কি কিছুক্ষণ আপনার পায়ের কাছে বসে থাকতে পারি?