রোবট তরুণী বলল, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করবেন না। এই চেষ্টা কারো জন্যেই সুফল বয়ে আনে না।
শেন ক্ষিপ্ত গলায় বলল, সুফল আমি তোর… ঢুকিয়ে দেই।
রোবট তরুণী বলল, আপনি খেতে বসুন। উত্তেজনা পরিহার করুন।
শেন বলল, চুপ কুত্তি। তুই রোবট, তুই উত্তেজনা পরিহার করবি। আমরা মানুষ। আমরা উত্তেজনা পরিহার করি না। তুই তোর সুন্দর হাসিমুখ নিয়ে বিদেয় হ। নয়তো আমি তোর মুখে পিশাব করে দেব।
আপনি নামি বিজ্ঞানীদের একজন। মহান আবিষ্কারক। আপনার কাছ থেকে ভদ্র ভাষা আশা করছি।
হা করে কথা বলবি না কুত্তি। আরেকবার মুখ খুললে তোর মুখে আমি হেগে দেব।
রোবট তরুণী নিনিতাকে নিয়ে বের হয়ে গেল।
.
গাড়ি দ্রুতবেগে চলছে। নিনিতা দুহাতে মুখ ঢেকে আছে। তার আশেপাশের কিছুই দেখতে ইচ্ছা করছে না। গাড়ি চালাচ্ছে রোবট তরুণী। সে বলল, আমার নাম এলিতা। তোমার নামের সঙ্গে মিল আছে। তোমার নামের শেষে আছে। আমার নামের শেষেও তাঁ।
নিনিতা জবাব দিল না। এলি বলল, আজকের ডাইনিং হলের ঘটনাটা ভাবছি। তোমর মানুষরা যে এত দ্রুত উত্তেজনার শেষ সীমায় পৌঁছতে পার আমার জানা ছিল না।
নিনিতা বলল, তোমার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে আমার ভালো লাগছে না।
এলিতা বলল, ডাইনিং হলে আমি হাসছিলাম। কাজটা ঠিক হয় নি। আমার উচিত ছিল গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা। আমি মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট। আমি যেহেতু জানি তুমি খুবই আনন্দময় একটা ঘটনার মুখোমুখি হবে—আমি আমার আবেগ লুকাতে পারি নি।
স্মৃতি নষ্টের প্রক্রিয়াটা যে আনন্দজনক তা জানতাম না।
আচমকা গাড়ি থামল। পুরোপুরি থেমে গেল। এলি বলল, আমি তোমাকে তোমার স্বামীর কাছে নিয়ে যাচ্ছি। ঘটনাটা কি যথেষ্ট আনন্দজনক না?
নিনিতা বলল, ঠাট্টা করছ?
এলিতা বলল, ঠাট্টা ব্যাপারটা আমরা ঠিক বুঝি না। উদ্ভট কিছু বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলাটা না-কি ঠাট্টা! আমি উদ্ভট কিছু বলছি না। তোমাকে আমি তোমার ঘরের সামনে নামিয়ে দেব। তুমি আচমকা ঘরে ঢুকে তোমার স্বামীকে চমকে দেবে। পেছনের সিটে একটা গিফট বক্স আছে। গিফট বক্সে চারটা টিটান ড্রিংসের বোতল এবং মঙ্গলগ্রহের রেড নাটস আছে। রেড নাটস কখনো খেয়েছ?
না।
অতি স্বাদু জিনিস। তবে সামান্য হেলুসিনেশন হতে পারে। সবার হয় না। কারো কারো হয়।
যা বলছ সত্যি বলছ?
এলি বলল, SF রোবটদের মিথ্যা বলার ক্ষমতা আছে। তবে আমি যা বলছি সত্যি বলছি। তুমি গিফট বক্স হাতে নিয়ে স্বামীর কাছে যাচ্ছি।
আমাকে এতদিন আটক রাখা হয়েছিল কেন?
তোমার ওভারীতে Eggs তৈরি হচ্ছিল না। এরকম পরিস্থিতিতে প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করা হলে শরীর Eggs তৈরি করে। শরীর যখন ধরে নেয় সে মারা যাচ্ছে তখন সে চেষ্টা করে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রেখে যেতে, তখনি Eggs তৈরি হয়।
সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে।
গাড়ি কি স্টার্ট দেব? না-কি আরো কিছু জানতে চাও?
আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ কাঁদতে চাই।
এলিতা বলল, মানুষের আবেগের ধারেকাছে যাওয়া কোনো রোবটের পক্ষে কখনো সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। তুমি কি সত্যি সত্যি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে চাও?
নিনিতা ফোঁপাতে ফোপাতে বলল, চাই।
কে কাঁদে গো
কে কাঁদে গো?
কেউ না।
কে কাঁদে গো?
কেউ না।
মানুষ না-কি।
না না না।
(জনৈক আয়না মানবের রচনা)।
নিনিতা বসে আছে কুনের পাশে। তার চোখ ভেজা। দৃষ্টি বিষণ্ণ। কেন বিষণ্ণ কে জানে! তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি পাশে বসে আছে। হাত বাড়ালেই তাকে ছোঁয়া যায়। কিন্তু ছুঁতে ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে আরো কিছুক্ষণ কাঁদতে।
মীন বলল, আমার মনে হয় তোমাদের দুজনের উচিত কিছুক্ষণ হাত ধরাধরি করে চুপচাপ বসে থাকা।
নিনিতা বলল, আমরা কী করব বা না করব তা তোমাকে বলে দিতে হবে। তোমার থ্যাবড়া নাক সবকিছুতে গলাবে না।
মীন বলল, প্রবল আবেগের সময় মানুষ বুঝতে পারে না সে কী করবে। মানুষের ব্রেইনে শর্ট সার্কিটের মতো হয়। নিওরন ঝড় উঠে। তখন বাইরের কেউ উপদেশ দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারে।
নিনিতা বলল, তোমার উপদেশের আমাদের প্রয়োজন নেই। আমি খুশি হব যদি তুমি আমাদের আলাদা থাকতে দাও। প্লিজ।
মীন উঠে চলে গেল। নিনিতা কুনের হাত ধরল। তার হাত কাঁপছে। হাতের আঙুল কাঁপছে। বুকের ভেতরটায় প্রবল চাপ বোধ হচ্ছে। এই বুঝি বুক ফেটে যাবে। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সামনে বসে থাকা কুনকে অচেনা মানুষ বলে মনে হচ্ছে। তার হাত ধরে বসে থাকতেও লজ্জা লাগছে।
কুন বলল, তোমার হাত কাঁপছে কেন? শান্ত হও। কথা বলো।
নিনিতা বলল, কী কথা?
কুন বলল, যা ইচ্ছা বলো।
নিনিতা বলল, বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি কথা বলো।
কুন বলল, আমিও বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
নিনিতা বলল, আমি ভাবি নি তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে। সব কেমন এলোমেলো লাগছে। তুমি কি ভেবেছিলে আমার সঙ্গে দেখা হবে?
না।
আমি যদি ফিরে না আসতাম তাহলে তুমি কী করতে?
জানি না।
নিনিতা বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি ফিরে না এলে মীন নামের থ্যাবড়া নাকের রোবটটার সঙ্গে তুমি সুখেই বাকি জীবন কাটাতে।
কুন বলল, তুমি খুব ভালো করেই জানো তা সম্ভব না। SF রোবট আমার মতো অতি নগণ্য একজনের জন্যে না। কোনো এক বিশেষ দায়িত্ব পালনের জন্যে তাকে জুটানো হয়েছে। দায়িত্ব পালন শেষ হলেই তাকে সরিয়ে নেয়া হবে।