গত পরশু সবুজ গাড়ি এসে একজনকে নিয়ে গেছে। তার বয়স অল্প। চেহারা কঠিন, কিন্তু চোখ মায়াময়। সে ঠান্ডাগলায় গাড়ির সঙ্গে আসা SF রোবটকে বলল, তোমাদের একটি আইন আছে, ৩ক ধারা। এই ধারা বলছে, কোনো অবস্থাতেই মানুষের সৃষ্টিশীলতা ক্ষস্তি হয় এমন কিছু করা যাবে না। মানুষের মস্তিষ্ক হচ্ছে তার সৃষ্টিশীলতার আধার। তোমরা তোমাদের আইনেই তা নষ্ট করতে পার না।
SF রোবট (সে একজন তরুণী) মিষ্টি হেসে বলল, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে, এই আইন লালকুঠির অধিবাসীদের জন্যে প্রযোজ্য না।
লোকটি বলল, একমাত্র হত্যা অপরাধের শাস্তি হচ্ছে স্মৃতিবিনাশ। আমি কাউকে হত্যা করি নি।
SF তরুণী রোবট বলল, তুমি একটি SF রোবট নষ্ট করেছ। SF রোবট হত্যা এবং মানুষ হত্যা একই ধরনের অপরাধ।
মানুষ এবং রোবট এখন সমান সমান?
মানুষ এবং SF রোবট সমান সমান।
তাহলে আমার বলার কিছু নেই। আমাকে কোথায় নিয়ে যেতে চাও নিয়ে যাও।
সবুজ গাড়ি যাদের নিয়ে যায়, তাদের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফেরত দেয়। ঐ লোকটিকে এখনো ফেরত দেয় নি। এর মানে কী কে জানে! অন্যের কথা ভেবে কী হবে? আমাকে ভাবতে হবে আমার নিজের কথা।
সবুজ গাড়ি আমাকে নিয়ে যাবে, চব্বিশ ঘণ্টা পর ফেরত দেবে। আমি বড় হব শিশুর মতো। তখন যদি কুনের সঙ্গে আমার দেখা হয়, আমি কি তাকে চিনতে পারব? মস্তিষ্কের কোনো গভীর অতলে তার কোনো ছায়া থাকবে না?
খাবারের ঘণ্টা বাজছে।
লালকুঠির নিয়ম সবাইকে একসঙ্গে খেতে হবে। আমি আমার পছন্দের খাবার খাব তা হবে না। প্রতিদিন একই মেনু। কোনোরকম বেশকম নেই।
এক বাটি স্যুপ।
এক বাটি সালাদ। ফিস সালাদ।
দুপিস রুটি।
এক বাটি মাংস।
এক গ্লাস ফলের রস।
খাবারের সময়টা আমার কাছে অসহ্য লাগে। কারণ খুঁজে খুঁজে আমার পাশের একটা জায়গা দখল করেন শেন। সারাক্ষণ বকবক করেন। আমি অপেক্ষা করে আছি, কবে এই মানুষটাকে নিতে সবুজ গাড়ি আসবে। ছি, কী ভয়ঙ্কর চিন্তা। আমি বদলে গেছি। ভয়ঙ্কর সব চিন্তা ক্লোজই আমার মাথায় আসে। রাতে বিকট সব দুঃস্বপ্ন দেখি।
গত রাতে দেখা দুঃস্বপ্নটা বলি। আমি দেখলাম, আমাকে নেবার জন্যে সবুজ গাড়ি এসেছে।
গাড়ি আমাকে নিয়ে ঝড়ের গতিতে চলছে। গাড়ির চালক SF তরুণী রোবট বলল, ম্যাডাম, আপনার কি কোনো শেষ ইচ্ছা আছে? আমি বললাম, হ্যাঁ। আমি আমার স্বামীর সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাই।
অন্তরঙ্গ সময়ের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। আমরা শিশু পালনের লাইসেন্স পেয়েছি। আমি গর্ভধারণ করতে চাই।
SF রোবট বলল, অনুমতি দেয়া হলো।
সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নে আমি চলে গেলাম আমার ঘরে। গিয়ে দেখি কুন সংসার করছে মীন নামের SF রোবটের সঙ্গে। তাদের একটা সন্তান হয়েছে। মীনের কোলে সেই সন্তান। কুন আমাকে দেখে বলল, তুমি কে?
আমি বললাম, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি নিনিতা।
কুন বলল, নিনিতা বলে কাউকে আমি চিনি না।
মীন বলল, যাকে চেন না তার সঙ্গে কথা বলছ কেন? ওকে ঘর থেকে বের করে দাও।
ওরা দুজন মিলে জোর করে আমাকে বের করে দিল। এই দৃশ্য দেখে মীনের কোলের সন্তানটা মহাখুশি। হাততালি দিচ্ছে এবং বলছে—মা নাই। মা চলে গেছে।
অসুস্থ মানুষের দুঃস্বপ্নগুলিও হয় অসুস্থ। আমি প্রতিরাতে দুঃস্বপ্ন দেখি। আমি এই দুঃস্বপ্নের হাত থেকে মুক্তি চাই।
.
নিনিতার মনে মনে ভায়েরি লেখা বন্ধ করতে হলো। তার দরজার পাশে সবুজ গাড়ির SF তরুণী দাঁড়িয়ে।
নিনিতা বলল, কী ব্যাপার?
আপনাকে যেতে হবে।
এখন?
হ্যাঁ এখন।
তোমরা তো ভোরবেলায় আস। এখন কেন?
রোবট তরুণী মিষ্টি করে হাসল।
নিনিতা বলল, শেষ ইচ্ছা পূরণের কোনো ব্যবস্থা কি তোমাদের আছে? স্মৃতি নষ্ট করার আগে আমার একটা শেষ ইচ্ছা কি পূরণ হবে?
ম্যাডাম! এমন কোনো ব্যবস্থা আমাদের নেই।
আমি বিশেষ কিছু চাচ্ছি না। আমি শুধু আমার স্বামীকে একবার হ্যালো বলব।
সম্ভব হবে না।
আমি কি এখানে যারা আছে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি? সবাই ডাইনিং রুমে আছে।
হ্যাঁ পার।
নিনিতা বলল, তোমাকে ধন্যবাদ।
ডাইনিং রুমে নিনিতাকে নিয়ে ঢুকল SF তরুণী। সবাই খাওয়া বন্ধ করে চমকে তাকাল। নিনিতা বলল, আমাকে নিতে সবুজ গাড়ি এসেছে। আমি সবার কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি যদি আমার ব্যবহারে কাউকে আহত করে থাকি, তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। বিদায়। আবার হয়তো আপনাদের সঙ্গে দেখা হবে, তখন আমি কাউকে চিনতে পারব না।
নিনিতার গলা ধরে এল। শেন উঠে দাঁড়ালেন। কঠিন গলায় বললেন, এখানে যারা উপস্থিত তাদের বলছি এবং হাস্যমুখী SF রোবট তরুণীকে বলছি–নিনিতা নামের যে মেয়েটিকে আজ তারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবার জন্যে সে কোনো অপরাধ করে নি। কেন তাকে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে তা সে জানে না। আমরা মানুষ। যেহেতু লালকুঠিতে বাস করছি আমরা জানার অধিকার হারিয়েছি। আপনারা সবাই রোবট তরুণীর দিকে একটু তাকান। দেখুন সে হাসছে। সবাইকে বলা হয় SF রোবট মানবিক আবেগসম্পন্ন রোবট। এই কি আবেগের নমুনা? একজন নিরপরাধ তরুণীকে সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে সে নিয়ে যাচ্ছে, অথচ তার মুখভর্তি হাসি। ধিক রোবট শাসিত পৃথিবী। ধিক ধিক।
এই পর্যন্ত বলেই শেন আচমকা তার খাবারের প্লেট ছুঁড়ে দিল রোবট তরুণীর দিকে। রোবট তরুণী দ্রুত মাথা নিচু করায় কিছু হলো না। ঝনঝন শব্দে খাবারের প্লেট ভাঙল। চারদিকে খাবার ছড়িয়ে পড়ল।