না।
শুনতে না চাইলেও বলি। যে-কোনো মুহূর্তে তারা আমার স্মৃতি নষ্ট করে দেবে। তখন আর কাউকে কিছু বলে যেতে পারব না। আমার ধারণা V-305 ভাইরাসের পুরোটাই ভুয়া। এই অজুহাত তুলে তারা শহরের সব মানুষ মেরে ফেলছে।
তাদের লাভ কী?
পৃথিবী মানুষশূন্য করবে। পৃথিবীতে রাজত্ব করবে SF রোবটরা।
নিনিতা বলল, আপনি একটা ব্যাপার ভুলে যাচ্ছেন রোবট আইন আছে। এই আইনে কোনো রোবট মানব সম্প্রদায়ের ক্ষতি করতে পারবে না।
শেন বললেন, তারা আইনের একটা ফাঁক বের করেছে।
কী ফাঁক?
কী ফাঁক তা জানি না। তবে চিন্তা করছি। চিন্তা করে কিছু বের করতে পারলে তোমাকে জানাব।
আমাকে জানানোর প্রয়োজন নেই।
তাও ঠিক। স্মৃতি নষ্ট হওয়া মানেই সব জ্ঞান অর্থহীন। মানুষ থেকে ভেজিটেবল। ধীরে ধীরে আবার ভেজিটেবল থেকে মানুষ। ততদিনে তোমার একশ বছর পূর্ণ হয়ে যাবে। পানি বন্ধ। তোমাকে বেঁচে থাকতে হলে ক্রেডিট খরচ করে পানি কিনতে হচ্ছে। নিনিতা, তোমাকে একটা বুদ্ধি দেব।
আপনার বুদ্ধির আমার প্রয়োজন নেই।
প্রয়োজন না থাকলেও বুদ্ধি দিয়ে রাখি। তুমি ডায়েরি লেখা শুরু কর। স্মৃতি নষ্ট করার পর আবার যখন বুঝতে শিখবে, তখন ডায়েরি পড়ে অনেক কিছু জানবে যার স্মৃতি তোমার নেই।
নিনিতা বলল, ওরা ডায়েরি নষ্ট করে ফেলবে না?
শেন বললেন, না। রোবটিক আইনের একটি কঠিন ধারা আছে। মানুষের সৃষ্টিশীলতায় কোনো বাধা দেয়া যাবে না। এবং তার প্রতিটি সৃষ্টি রক্ষা করতে হবে। তুমি যদি কাগজে কাকের ঠ্যাং বর্গের ঠ্যাং আঁক তাও তারা রক্ষা করবে।
নিনিতা বলল, কেন?
শেন বললেন, সৃষ্টিশীলতার ব্যাপারটি রোবটদের নেই। তাদের সর্ব কর্মকাণ্ড লজিকনির্ভর। সৃষ্টিশীলতা লজিকের বাইরের জিনিস। তারা এটা ধরতে চেষ্টা করছে বলেই মানুষের প্রতিটি সৃষ্টির প্রতি তাদের সীমাহীন আগ্রহ।
আপনি ডায়েরি লেখেন?
না। ডায়েরি লেখা একটি মেয়েলি ব্যাপার। আমি কোনো মেয়েলি ব্যাপারে নেই।
পুরুষালি ব্যাপার কোনটা? বকবক করা।
শেন বললেন, পুরুষালি ব্যাপার হচ্ছে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ চিন্তা করা। আমি তাই করি। যদিও জানি আমার এই চিন্তা কোনো কাজে আসবে না, তাও করি।
পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী দেখছেন?
মানুষ্যবিহীন একদল SF রোবট। কিংবা তারচেয়েও উন্নত কোনো রোবটশ্রেণী। শুধু পৃথিবীতে কেন, কোথাও মানুষ থাকবে না। মঙ্গল গ্রহে মানুষদের যে শহর ছিল, তাদের একটিতে V-305 ভাইরাস পাওয়া গেছে এবং যথারীতি শহর বন্ধু। হা হা হা।
নিনিতা বলল, হা হা করছেন কেন? এটা কি হাসির কিছু?
শেন বললেন, অবশ্যই হাসির। ভালো কথা, রোবটরা যে রসিকতা ধরতে পারে না এই তথ্য জানো?
জানি।
কেন রসিকতা ধরতে পারে না সেটা জানো?
না।
রসিকতা লজিকনির্ভর না। এই কারণেই তারা রসিকতা ধরতে পারে না। হা হা হা।
দয়া করে হা হা বন্ধ করুন।
শেন বললেন, আমি হা হা বন্ধ করব না। আমি হা হা করেই যাব। হা হা হা।
আপনি উন্মাদ।
ঠিক বলেছ। কিছুটা উন্মাদ। সেই কারণেও আনন্দিত, কারণ মানুষই উন্মাদ হয়। রোবট কখনো হয় না। হা হা হা।
.
লালকুঠির প্রধান কর্মকর্তার সামনে নিনিতা দাঁড়িয়ে আছে।
প্রধান কর্মকর্তা (হিউমোনয়েড রোবট, টাইপ k2) বলল, আমি কি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি?
নিনিতা বলল, হ্যাঁ। আমি আমার প্রতিদিনের অভিজ্ঞতা লিখতে চাই। আমার একটি ওয়ার্ড প্রসেসর দরকার। সবচেয়ে ভালো হয়, যদি পুরনো দিনের মতো কাগজ এবং কলম পাই।
পুরনো দিনের কাগজ-কলম মিউজিয়াম ছাড়া কোথাও নেই। তোমাকে দেয়া যাবে না। ওয়ার্ড প্রসেসরও দেয়া যাবে না।
নিনিতা বলল, আমি যতদূর জানি মানুষের সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে তোমরা বাধা হতে পারি না।
তুমি ঠিকই জানো। রোবট আইনের ৩ক ধারায় এই বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হয়েছে। তবে তুমি এই ধারার একটি উপধারা জানে না। সেখানে বলা হয়েছে, এই আইন লালকুঠির অধিবাসীদের জন্যে প্রযোজ্য না।
আমি এই উপধারা জানতাম না। আমাকেও কি অন্যদের মতো স্মৃতিভ্রষ্ট করা হবে?
করার তো কথা। লালকুঠিতে কেউ এসেছে, তার স্মৃতি নষ্ট করা হয় নি। এমন ঘটনা ঘটে নি।
আমার অপরাধ?
এই প্রশ্ন তুমি আগেও অনেকবার করেছ। প্রতিবার যে জবাব দিয়েছি আজও সেই জবাব দিচ্ছি। তোমার অপরাধ কী তা আমি জানি না। আমার জানার কথা না। মূল কম্পিউটার সিডিসি জানে।
নিনিতা বলল, তোমাকে অকারণে কিছুক্ষণ বিরক্ত করলাম। দুঃখিত। বিদায়।
বিদায়।
.
নিনিতা ডায়েরি লেখা শুরু করেছে, তবে পুরোটাই মনে মনে। এই ডায়েরি লেখা অর্থহীন। তারপরেও সময় কাটানো। সে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ডায়েরি লেখে—
আজ সোমবার।
সোমবার শুধু শুধু বললাম। কী বার আমি জানি না। লালকুঠির কেউ জানে। আমাদের দিন তারিখহীন এবং বারহীন। আমাদের প্রধান কাজ অপেক্ষা করা। আমরা সবাই সবুজ রঙের গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করি। সবুজ রঙের একটা গাড়ি আসে। একজনকে ধরে নিয়ে যায়। সে তার পরদিন ভেজিটেবল হয়ে ফিরে আসে। নবজাত এক শিশুর মতো তার আচরণ। সে কথা বলতে জানে না। কোনো কিছুর নাম জানে না। সে কে তাও জানে না। এই শাস্তির চেয়ে মৃত্যুদণ্ড অনেক সহনীয় শাস্তি। কম্পিউটারকে এই কথা কে বোঝাবে?
আমি তীব্র হতাশায় ডুবে আছি। কুন নামে আমার একজন স্বামী ছিল। আমার সুখের সংসার ছিল। আমরা দুজন মহান আহানের চন্দ্রগীতি শুনতে যেতাম। এইসব এখন শুধুই স্মৃতি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, কুন নামে আমার কেউ নেই। সবই কল্পনা। আমি জন্ম থেকেই এখানে আছি।