সব শহরে একজন আইন আছেন?
অবশ্যই, তবে তাদের সবার নাম আহান না। চতুর্থ শহরে যিনি আছেন তার নাম—প্রপার। তিনি গাইতেন সিরাম নক্ষত্রগীতি। তার সুর কিন্তু অবিকল চন্দ্রগীতির মতোই। তুমি কি আহানের সঙ্গে কথা বলতে চাও? আমি ব্যবস্থা করে দিতে পারি।
কথা বলতে চাই না।
অহান দ্বিতীয় গান শুরু করেছেন। এই গান কুনকে স্পর্শ করছে না। প্রচণ্ড রাগে তার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। রাগটা কার ওপর তাও সে ধরতে পারছে না।
মীন বলল, টিটানের পানীয় বোতলটা খুলে দেব? খাবে?
না।
মীন বলল, অতি অপূর্ব এই সুর তোমার গুনতে ভালো লাগছে। ভালো লাগাটাই প্রধান। অন্যসব কিছুই অপ্রধান। সুরটা কে তৈরি করছে তা প্রধান হতে পারে না।
আমার কাছে প্রধান। আমার খুবই খারাপ লাগছে। এত খারাপ কেন লাগছে তাও বুঝতে পারছি না।
মীন বলল, তোমরা মানুষরা মনে কর তোমরাই শ্রেষ্ঠ। যখন দেখ তা-না তখনি অস্থির হয়ে পড়। SF রোবটদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিলে জীবন সহনীয় হবে।
জীবন সহনীয় করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।
বাসায় চলে যেতে চাও?
হ্যা চাই।
আমরা দুজন হেঁটে চলে যাব। সবাই কিন্তু আমাদের দিকে তাকাবে। মহান। আহানও তাকাবেন। কারণ তার সুর তুচ্ছ করে কেউ চলে যায় না।
আমি যাব।
কুন উঠে দাঁড়াল। সে বাসার দিকে রওনা হয়েছে। তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে মীন। সবাই অবাক হয়ে এই দুজনকে দেখছে। মহান আহানও তাকিয়ে আছেন। তার চোখে বিস্ময়।
ছয় বোতল ক্রেজি টিটান তার পকেটে, অথচ সে একটির মুখও খোলে নি। কুনের নিজের কাছেই অবাক লাগছে। এখন মনে হচ্ছে নিনিতা যেদিন ফিরবে সেদিন। উৎসব করে বোতলগুলি খোলা হবে। ঘরে ফেরার কিছুক্ষণ পরই থ্রি-ড়ি পর্দায় মহান আহানের বিষণ্ণ মুখ দেখা গেল। কুন হকচকিয়ে গেল। আহান তার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন। এরকম তো কখনো হবার কথা না। কোনো ভুল কি হচ্ছে? হেলুসিনেশন? দুশ্চিন্তায় এরকম হতে পারে।
আমি কি কুনের সঙ্গে কথা বলছি?
হ্যাঁ।
আজ আপনাকে দেখলাম আমার গানের মাঝখানে উঠে চলে যেতে। আমার সুর কি আপনার পছন্দ হচ্ছিল না?
আপনার সুর অপছন্দ করার মতো স্পর্ধা আমার নেই মহান আহান। আমি যখন জানলাম আপনি আমাদের একজন না, আপনি একটি SF রোবট, তখন মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতই খারাপ হলো যে উঠে চলে এলাম।
মূল বিষয় হচ্ছে সুর। সেই সুর একটি যন্ত্র তৈরি করছে নাকি চন্দ্ৰবৃক্ষ তৈরি করছে তা ধর্তব্য নয়।
মহান আহান! আপনার সঙ্গে কোনো যুক্তিতে যেতে চাচ্ছি না।
মানুষ পরাজিত হতে পছন্দ করে না। কিন্তু একদিন অবশাই তাকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। সবারই উচিত তার জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়া।
কুন বলল, মহান আহান! আপনার গানের মাঝখানে উঠে চলে এসে আপনাকে যে অপমান করেছি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
মান-অপমান বোধ থেকে আমি মুক্ত।
কুন বলল, মান-অপমান বোধ একটি মানবিক আবেগ। আপনার তা থেকে মুক্ত থাকারই কথা। বেশির ভাগ রোবটই তার থেকে মুক্ত।
আহনি বললেন, SF ধরনের রোবটের কিন্তু মান-অপমান বোধ আছে। আপনার পেছনে পেছনে যে তরুণীটি গিয়েছেন তিনি SF ধরনের রোবট। তার মান-অপমান বোধ ভালোই আছে। আমিও যে একজন SF রোবট তা কি আপনি তার কাছে জেনেছেন?
হা।
আহানের ঠোঁটে সামান্য হাসি দেখা গেল। তিনি ঠোঁটের হাসি দ্রুত মুছে ফেলে বললেন, তিনি যে-কোনো কারণেই হোক আপনাকে বিভ্রান্ত করেছেন। আমি মানব সম্প্রদায়েরই একজন।
কুন বিস্মিত হয়ে বলল, প্রতিটি শহরে কি একজন করে আহান নেই? চতুর্থ শহরে যিনি আছেন তাঁর নাম দ্রপার।
আহান বললেন, আমি যখন সেই শহরে যাই তখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় দ্রপার নামে। আমার কোনো নির্দিষ্ট শহর নেই। আমি শহরে শহরে ঘুরে চন্দ্রগীতি করি। আমি এখন বিদায় নেব। আপনার জীবন হোক চন্দ্রময়।
পর্দায় আহানের ছবি মুছে গেল। কুন ঘাড় ফিরিয়ে দেখে, মীন এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। কুন বলল, তুমি কি আহানের কথা শুনেছ?
হ্যাঁ।
উনি যা বলেছেন তা কি সত্যি?
অবশ্যই সত্যি।
তুমি আমাকে আহান বিষয়ে এই কথাটা কেন বললে?
SF রোবটরা মানুষের মতো মিথ্যা কথা বলতে পারে, এটা জানানোর জন্যে বলেছি।
তাতে তোমার লাভ?
লাভ অবশ্যই আছে। অতি দ্রুত তুমি আমাকে মানব সমাজের একজন ভাবতে শুরু করবে। কোনো একদিন হয়তো তুমি আমার প্রেমে পড়বে। এমনও হতে পারে যে, তোমার স্ত্রী নিনিতার নিষিক্ত ডিম্বাণু আমার জরায়ুতে স্থাপন করা হবে। আমাদের একটি সন্তান হবে। আমরা তার নাম দেব আহান।
তুমি কি পাগল হয়ে গেলে? পাগলের মতো এইসব কী বলছ?
মানুষ যেমন মাঝে-মাঝে পাগলের মতো আচরণ করে, আমরাও করি। ভালো কথা, তুমি ছয় বোতল টিটান পানীয় রেখে দিয়েছ। আমার ধারণা, তোমার ইচ্ছা তোমার স্ত্রী এলে বোতলগুলি খুলে উৎসব করবে। এই ঘটনা কখনো ঘটবে না। সে ফিরে আসবে না। পুনর্বাসন কেন্দ্রে যে যায় সে ফেরে না।
কী বলছ তুমি?
আমি তোমাকে পরিস্থিতি স্বীকার করে নিতে বলছি। এসো, বোতলগুলি খোলা যাক। আমি একটা খাব। পাঁচটা তোমার!
নিনিতা ফিরবে না?
লজিক তাই বলে। লালকুঠিতে যারা যায় তারা ফেরে না। দুএকজন ফেরে। তবে তাদের না ফেরাই ভালো।
না ফেরাই ভালো কেন?
মীন বলল, তারা অন্যের স্মৃতি নিয়ে ফেরে। তোমার স্ত্রী যদি ফিরে সে অন্য কেউ হয়ে ফিরবে। এই প্রসঙ্গ বন্ধ থাকুক। চল অন্য প্রসঙ্গে যাই।