রূপা!
জি।
তোর কী হয়েছে বল তো?
কিছু হয় নি।
আমার তো মনে হয় কিছু-একটা হয়েছে। তুই কারো কথাই মন দিয়ে শুনছিস না। তোর মধ্যে একটা ছটফটানি ভাব চলে এসেছে। আগে তো তুই এমন ছিলি না।
মানুষ তো বদলায় ভাইয়া।
অবশ্যই–বদলায়–এমনভাবে বদলায় না। তুই মাকে ডেকে আন তো, মাকে জিজ্ঞেস করি।
তাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে?
ডেকে আনতে বলছি, ডেকে আন।
রূপা মাকে ডেকে নিয়ে এলো। নিজে সামনে থাকল না। থাকতে ইচ্ছা করল না। সে লক্ষ করেছে তাকে নিয়ে বাড়িতে ঘনঘন বৈঠক হচ্ছে। বৈঠকে এমন কিছু আলোচনা হচ্ছে যেখানে তার উপস্থিতি কাম্য নয়। সবাই নিচু গলায় কথা বলছে–সে কাছে এলেই থেমে যাচ্ছে। এর মানে কী?
রূপা বাগানে নেমে গেল। সাত দু বাজতে বেশি বাকি নেই। রূপা নিশ্চিত আজ স্যার আসবেনই। আজ ছতারিখ। ছতারিখ তার জন্যে খুব লাকি। ক্লাস এইটো বৃত্তি পাবার খবর সে পেয়েছিল ছতারিখে। মবিনুর রহমান স্যার প্রথম এ বাড়িতে এসেছিলেনও ছতারিখে। রূপা লক্ষ করল ভাইয়া মার সঙ্গে কথা বলছে এবং আড়চোখে তাকে দেখছে। রূপা এমন ভাব করল যেন সে বাগানের গাছগুলি দেখছে। যদিও গাছপালার প্রতি তার তেমন মমতা নেই।
বারান্দায় জেবা এসে দাঁড়িয়েছে। সে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপার দিকে। এই মেয়েটির চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে যে অস্বস্তি বোধ হয়। মনে হয় এই মেয়েটার দুটা চোখের ভেতরও কয়েকটা চোখ আছে। এক সঙ্গে অনেকগুলি চোখ যেন তাকে দেখে। রূপা জেবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাগান দেখবে জেবা?
জেবা হ্যাঁ-না কিছু বলল না, তবে বাগানে নেমে এলো।
রূপা বলল, এই বাগানের নাম কী জানো? জংলি বাগান। কোনো যত্ন নেই–গাছপালায় জঙ্গল হয়ে আছে। তাই জংলি বাগান।
জেবা কিছু বলল না। এই মেয়েটা একেবারেই কথা বলে না।
আমাদের এই জংলি বাগান তোমার কাছে কেমন লাগছে জেবা?
জেবা নিশ্চুপ। যেন সে পণ করেছে কোনো কথা বলবে না। রূপা হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি কারো সঙ্গেই কথা বলো না?
জেবা হাসল। ঠিক হাসিও না। তার ঠোঁট বাকাল না, তবে চোখে হাসি ঝিলিক খেলে গেল। সে এবার স্পষ্ট গলায় বলল–তুমি কার জন্য অপেক্ষা করছি ফুপু?
রূপা চমকে উঠে বলল, কারো জন্যে অপেক্ষা করছি না তো! আমি কারো জন্যে অপেক্ষা করছি এটা তোমার মনে হলো কেন?
জেবা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাগান থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেল। রফিক হাসিমুখে বলল, কী মা বাগান ভালো লাগল না? জেবা জবাব দিল না। রফিক আবার বলল, আমাদের এই বাড়ি তোমার পছন্দ হয়েছে তো মা? জেবা এ প্রশ্নের উত্তরেও কিছু বলল না। তাকে আরো প্রশ্ন করা হতে পারে এই ভয়েই হয়তোবা বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
রফিকের মা বললেন, তোর এই মেয়ে বোধহয় আমাদের কাউকে পছন্দ করছে না। কারো কোনো কথার জবাব দেয় না। রফিক বলল, ও এ রকমই মা। কথা বলার ইচ্ছা! হলেই কথা বলবে। ইচ্ছা না হলে বলবে না। খুব সমস্যা করছে। ঢাকায় নিয়ে ডাক্তাব দেখাব।
ডাক্তার কী করবে? সাইকিয়াট্রিষ্ট, ওরা এইসব ব্যাপার জানে। বাচ্চারা থাকবে বাচ্চাদের মতো। ওকে দেখ কেমন বড়দের মতো ভঙ্গি করে ঘুরে। ওর কথা বাদ দাও মা। এখন রূপার ব্যাপারটা বলে। ওর হয়েছে কী?
কিছু হয় নি তো!
আগেও তো বললে কিছু হয় নি। ভালো কবে ভেবে বলো ও কারো প্ৰেমে-ট্রেমে পড়ে নি তো?
কী বলিস তুই।
আজগুবি কোনো কথা বলছি না মা, রূপার ভাবভঙ্গি আমার ভালো লাগছে না বলেই বলছি। শেষটায় বিয়ে ঠিকঠাক হবার পর দেখা যাবে সে বেঁকে বসেছে।
এরকম কিছু নাই।
জানো তো ভালোমতো?
জানি।
কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। রূপাকে দেখ কেমন মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। আগে তো। এ রকম ছিল না।
রফিক ঘরের ভেতরে চলে গেল। ছোট মেয়ে রুবাবা তারস্বরে চিৎকার করছে। সে ছাড়া এই মেয়েকে কেউ সামলাতে পারে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এত চিৎকারেও রূপার কোনো ভাবান্তর নেই। যেন সে কিছু শুনছে না। এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছে।
রূপা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত বাগানে বসে রইল। বাঁধানো বকুল গাছের নিচে বসার ব্যবস্থা আছে।
রফিক বাইরে বেরোতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে বিবক্ত। গলায় বলল, এখনো বাগানে বসে আছিস কেন?
মাথা ধরেছে ভাইয়া। ফ্রেশ বাতাস নিচ্ছি।
বর্ষার সময়, সাপখোপ বেরোবে। উঠে আয়।
রূপা উঠে এলো। রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, তুই কি কাঁদছিলি না-কি?
কাঁদব কেন শুধু শুধু?
তোর গাল ভেজা, এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
কাঁপা শাড়ির আঁচলে গাল মুছতে মুছতে বলল, হ্যাঁ কাঁদছিলাম। মাথার যন্ত্রণায় কাঁদছিলাম। মাঝে মাঝে এমন যন্ত্রণা হয়। মাথাটা কেটে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে।
সে কী যন্ত্রণা খুব বেশি?
হুঁ।
ডাক্তাব দেখিয়েছিস?
না।
তোদের নিয়ে বড় যন্ত্রণা। অসুখ-বিসুখ হবে, ডাক্তাব দেখাবি না? দেশে ডাক্তার আছে কী জন্যে? আচ্ছা। আমি বিধুবাবুকে নিয়ে আসব।
কাউকে আনতে হবে না।।
যা ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক। বাতে তোর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।
এখন বলো।
না এখন না। রাতে বলব। এখন একটা কাজে যাচ্ছি। আর শোন, তোর যদি বিশেষ কোনো কথা বলার থাকে যা আমাকে বা মাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছিস তাহলে তোর ভাবিকে বলবি।
আমার আবার বিশেষ কী কথা…
থাকতেও তো পারে। এই জন্যই বলছি।
রূপা নিজের ঘরে এসে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল। তার এখন সত্যি সত্যি মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। অসম্ভব কষ্টও হচ্ছে। আজ ছ তারিখ, কিন্তু স্যার এলেন না। উনার কি কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে? মোতালেবকে কি পাঠাবে খোঁজ নিতে? যদি পাঠায় কেউ কি তা অন্য চোখে দেখবে? অন্য চোখে দেখার তো কিছু নেই। একটা লোকের অসুখ-বিসুখ হলে খোঁজ নিতে হবে না!