- বইয়ের নামঃ নি
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ কাকলী প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, উপন্যাস
নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের সায়েন্স টিচার
নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের সায়েন্স টিচার মবিনুর রহমান, বিএসসি (অনার্স), এমএসসি (প্রথম শ্রেণী) খুব সিরিয়াস ধবনের মানুষ। বয়স ছত্রিশ/সাঁইত্রিশ, রোগা লম্বা। গলার স্বরে কোনোরকম কোমলতা নেই। ভদ্রলোক এমনভাবে তাকান যাতে মনে হতে পারে যে সমস্ত পৃথিবীর উপর তিনি বিরক্ত। কোনো কারণে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেলে তিনি আরাম পাবেন।
এমএসসি পাস করার পর সব মিলিয়ে আঠারোবার তিনি চাকরির ইন্টারভ্যু দিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা ঘটল তা হচ্ছে–তিনি ইন্টারভ্যু দিতে ঢুকলেন, বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন, বসুন।
তিনি বসলেন। বোর্ডের চেয়ারম্যান বললেন, আপনার নাম?
মবিনুর বহমান সহজ গলায় বললেন, নাম তো আপনি জানেন। এই নামেই ডেকে পাঠালেন। আবার জিজ্ঞেস করছেন কেন?
আচ্ছা। আপনি যেতে পারেন।
ধন্যবাদ।
তিনি শান্ত মুখে উঠে চলে এলেন।
এ জাতীয় মানুষদের কোনো চাকরি-বাকরি হবার কথা না। তবে মবিনুর রহমান হাল ছাড়লেন না। দুবছর চেষ্টা করলেন, প্রাণপণ চেষ্টা। ইন্টারভ্যু গাইড নামের সাতশ একুশ পৃষ্ঠার একটা বই প্রায় মুখস্ত কবে ফেললেন। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব, ন্যাটো চুক্তিভুক্ত দেশের নাম, কোন কোন বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় নি, আমেরিকান সব প্রেসিডেন্টের নাম এবং বংশ-পরিচয়–পাঠ্য তালিকা থেকে কিছুই বাদ গেল না। খুব ঈশ্বর-বিশ্বাসী না হয়েও মায়ের পীড়াপীড়িতে সিলেটে হয়রত শাহজালাল এবং হযরত শাহ পরাণের মাজার জিয়ারত কবে এলেন। রাজশাহীতে গিয়ে জিয়ারত করলেন শাহ মখদুমের মাজার এই তিন মহাপুরুষের কল্যাণেই হয়তো বা তিনি নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের সায়েন্স টিচারে চাকরিটা পেয়ে গেলেন। অবশ্যি এই চাকরি পাওয়ার পেছনে অনা একটি কারণ থাকতে পারে। এই চাকরির জন্যে তাকে ইন্টারভ্যু দিতে হয় নি। কাগজপত্ৰ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
যাই হোক, নীলগঞ্জ মডেল হাই স্কুলের চাকরির নিয়োগপত্র এবং দুকেজি মিষ্টি নিয়ে তিনি কুমিল্লার মতলবে তার মাকে দেখতে গেলেন। মা তখন রোগে শয্যাশায়ী। মবিনুর রহমানের চাকরির খবরে তাকে মোটেই আনন্দিত মনে হলো না। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, শেষ পর্যন্ত স্কুলমাস্টার?
মবিনুর রহমান শান্ত গলায় বলেন, স্কুল মাস্টারি খারাপ কিছু না। নাও, মা মিষ্টি খাও।
আমি মিষ্টি খাব না, বাবা। তুই খা।
মিষ্টি না খেলে মনে কষ্ট পাব, মা।
ভদ্রমহিলা ছেলেকে মনোকষ্ট থেকে বাচানোর জন্য মিষ্টি খেলেন। এই মিষ্টিই তার কাল হলো। ভোরবেলা পেট নেমে গেল। সন্ধ্যার মধ্যে মৃত্যু।
আশেপাশের সবাই সান্ত্বনা দিতে ছুটে এসে দেখে মবিনুর রহমান পাথরের মতো মুখ করে মিষ্টি খাচ্ছে। নিতান্তই অস্বাভাবিক দৃশ্য কিন্তু আসলে তেমন অস্বাভাবিক নয়। মিষ্টিই তার মার মৃত্যুর কারণ কি-না এটাই মবিনুর রহমান পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। দুকেজি কালোজাম খেয়েও তার যখন কিছু হলো না তখন তিনি মোটামুটি নিশ্চিত হলেন–বয়সজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুতে খুব বেশি দুঃখিত হবার কিছু নেই। প্রতিটি জীবিত প্ৰাণীকেই একটা নির্দিষ্ট সময়ের পাব মরতে হবে। তবে এই মৃত্যুর মানে পুরোপুরি ধ্বংস নয়। মানুষের শরীরের অযুত, কোটি, নিযুত পার্টিকেলস যেমন–ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন–এদের কোনো বিনাশ নেই। এরা থেকেই যাবে। ছড়িয়ে পড়বে সারা পৃথিবীতে। কাজেই মানুষের মৃত্যুতে খুব বেশি কষ্ট পাবার কিছু নেই।
মবিনুর রহমান তার বসতবাড়ি এবং অল্প যা জমিজমা ছিল বিক্রি করে দিয়ে নীলগঞ্জ চলে এলেন। তাঁর সঙ্গে দুই ট্রাংক বই, একটা ম্যাকমিলন কোম্পানির দুরবিন। দুরবিনটা ঢাকা থেকে অনেক দাম দিয়ে কেনা। ছাত্রজীবন থেকেই তাঁর শখ ছিল ভালো একটা দুরবিন কেনা। টাকার অভাবে কেনা হয় নি। জমি বিক্রির টাকাটা কাজে লাগল। এই সঙ্গে একটা মাইক্রোসকপি, কিনতে পারলে হতো। টাকায় কুলালো না।
নীলগঞ্জ হাই স্কুলে মবিনুর রহমানের আট বছর কেটে গেছে। শুরুতে তাকে যতটা বিচিত্র বলে মনে হয়েছিল এখন আর ততটা মনে হয় না। মবিনুব রহমান বদলান নি, আগের মতোই আছেন। ছাত্ররা এবং সহকমী শিক্ষকরা তার আচার-আচরণে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এইটুকু বলা যায়। তাঁর আচার-আচরণের সামান্য নমুনা দেয়া যাক।
তাঁর বুক পকেটে সব সময় একটা গোলাকার নিকেলের ঘড়ি থাকে। নীলগঞ্জে আসার আগে চৌদ্দশ টাকায় ইসলামপুর থেকে এই ঘড়িটা কেনা হয়েছে। সাধারণ ঘড়ি নয়–একের ভেতর তিন। ঘড়ির সঙ্গে আছে স্টপ ওয়াচ এবং একটি আদ্রতা মাপক কাটা।
ক্লাসে ঢোকার আগে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ঘড়িতে সময় দেখে নেন। ক্লাস শেষের ঘণ্টা পড়া মাত্র আবার ঘড়ি বের কবে সময় দেখেন। তখন যদি তাঁর কপাল কুঁচকে যায় তাহলে বুঝতে হবে ঘণ্টা ঠিকমতো পড়ে নি। দুএক মিনিট এদিক-ওদিক হয়েছে।
ক্লাসে ঢুকে প্রথমেই আজকের আবহাওয়া সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, যেমনআজ বাতাসের আর্দ্রতা ৭৭ পারসেন্ট। বৃষ্টিপাত হবার সম্ভাবনা। আবহাওয়া সম্পর্কে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী খুব লেগে যায়। তিনি বৃষ্টি হবে বলেছেন। অথচ বৃষ্টি হয় নি এমন কখনো দেখা যায় নি।
তাঁর ক্লাসে ছাত্রদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। হাসা যায় না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোঁচা দেয়া যায় না, খাতায় কাটাকুটি খেলা যায় না। মনের ভুলেও কেউ যদি হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব হয়ে দীর্ঘসময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন গলায় বলেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। সায়েন্স পড়বার সময় তুমি হেসেছি, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। অন্যায় করেছি। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার পর বাড়ি যাবে না। পাটিগণিতের সাত প্রশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
মবিনুর রহমান স্কুল থেকে প্রায় দুমাইল দূরে দুকামরার একটা পাকা ঘরে একা বাস করেন। ঘরটি জরাজীর্ণ। ভেঙে পড়তে পড়তেও কেন জানি পড়ছে না। ছোটখাটো ভূমিকম্প কিংবা দমকা বাতাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয় না। বাড়িটি সাপেব আড্ডাখানা। বর্ষাকালে যেখানে-সেখানে সাপ দেখা যায়। বাড়ির মালিক কালিপদ রূপেশ্বর স্কুলের দপ্তরি। সাপের ভয়েই সে পূৰ্বপুরুষের ভিটায় বাস করে না। সাপের কামড়ে তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর প্রথম সন্তান মারা গেছে। মবিনুর রহমান সেই বাড়িতে সুখেই আছেন। স্বপাক আহার করেন। তাকে নিরামিষভোজী বলা চলে। মাছ মাংস খান না। না খাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মাছ-মাংস রাঁধতে জানেন না। তার বাড়িটা রূপেশ্বর নদীর ধারে। শীতকালে এই নদীতে পায়ের পাতাও ভিজে না। বর্ষাকালে কিছু পানি হয়। গত বর্ষায় মবিনুর রহমান দেড় হাজার টাকা দিয়ে একটা নৌকা কিনেছেন। নৌকার কোনো মাঝি নেই। নৌকা ঘাটে বাধা থাকে। মাঝে মাঝে তিনি নৌকার ছাদে সারারাত বসে থাকেন। নৌকার ভেতরটাও সুন্দর। ঘরের মতো। দুদিকে দরজা আছে। বাথরুম আছে। বিছানা বালিশ দিয়ে ভেতরটা চমৎকার গোছানো। মবিনুর রহমানের প্রিয় কিছু বই নৌকায় থাকে। অধিকাংশই গ্ৰহ নক্ষত্র বিষয়ক বই।
এই জাতীয় আধাপাগল নিঃসঙ্গ মানুষকে সবাই খানিকটা ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে। মবিন্নুর রহমানের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। এই অঞ্চলের মানুষদের প্রচুর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। এই ভালোবাসা পাবার পেছনের আরেকটি কারণ হচ্ছে, তিনি শিক্ষক হিসেবে প্রথম শ্রেণীব। ইতিমধ্যেই অঙ্কের ড়ুবো জাহাজ হিসেবে তাঁর খ্যাতি বটেছে। ড়ুবো জাহাজ নামকরণের রহস্য হচ্ছে তিনি যে খুব ভালো অঙ্ক জানেন এটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল
আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল।
সেকেন্ড পিবিয়ডে মবিনুর রহমানের কোনো ক্লাস নেই। তিনি টিচার্স কমনরুমে তাঁর নিজের চেয়াবে চুপচাপ বসে আছেন। তাঁর বুক পকেটের ঘড়ি শতকরা আশি ভাগ হিউমিডিটির কথা বলছে। কিন্তু আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না। মবিনুর রহমানের ভুরু কুঁচকে আছে এই কারণে। কমনরুমে আরো কিছু শিক্ষক আছেন। তারা সরকারি ডি এ নিয়ে আলাপ করছেন। এবারের সরকারি সাহায্য এখনো এসে পৌঁছায় নি। মবিনুর রহমান এইসব আলোচনায় অংশগ্ৰহণ করছেন না। কখনোই করেন না। স্কুলের ধর্ম ও আরবি শিক্ষক জালালুদ্দিন সাহেবের চেয়ার মবিন্নুর রহমানের চেয়ারের ঠিক পাশেই। পাশাপাশি বসতে হয় বলেই বোধহয় দুজনের মধ্যে সামান্য সখ্যতা আছে। জালালুদ্দিন সাহেব মবিনুর রহমানকে তুমি তুমি করে বলেন। তাঁর কথাবার্তা থেকে মনে হতে পারে যে বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর প্রচুর কৌতূহল। তা ঠিক না। কোনো বিষয় সম্পর্কেই তার কোনো আগ্রহ নেই। ভদ্রলোক কোনো ক্লাসই ঠিকমতো নেন না। আজও ক্লাস শেষ হবার কুড়ি মিনিট আগে বের হয়ে এলেন। মবিনুর রহমানের পাশে বসতে বসতে মধুর গলায় বললেন, তারপর মবিন, তোমার সায়েন্সের খবর কী?
কোন খবরটা জানতে চান?
বৃষ্টি হবে কী হবে না?
বৃষ্টি হবে। হিউমিডিটি ৮০।
জালালুদ্দিন পানের কোটা খুলতে খুলতে বললেন, বৃষ্টি যে হবে এটা বলার জন্য তোমার সায়েন্স লাগে না। আষাঢ় মাস, বৃষ্টি তো হবেই। পান খাবে না-কি?
জি-না।
খাও একটা জর্দা দেয়া আছে। আকবরী জর্দা। অতি সুঘ্ৰাণ।
আমি পান খাই না।
এমনভাবে তুমি কথাটা বললে যেন পান খাওয়া বিরাট অপরাধ। পান খাওয়া কোনো অপরাধ না। এটা হজমের সহায়ক। দাঁত ভালো থাকে।
জালালুদ্দিন একসঙ্গে দুটো পান মুখে দিলেন, আঙুলের ডগায় চুন নিতে নিতে বললেন, আচ্ছা মবিন, এই যে পানের সঙ্গে আমরা চুন খাই। কেন খাই? তোমার সায়েন্সে কী বলে?
আপনি সত্যি জানতে চান?
অবশ্যই চাই। আরবি পড়াই বলে সায়েন্স জানব না? সায়েন্সের সঙ্গে এরাবিকের তো কোনো বিরোধ নাই।
মবিন শীতল গলায় বললেন, পানের সঙ্গে চুন কেন খাওয়া হয়। আমি ব্যাখ্যা কবছি। মন দিয়ে শুনুন।
শুনছি। তুমি হাসি মুখে বলো। মুখ এমন শুকনো করে রেখেছ কেন?
মবিনুর রহমান ক্লাসে বক্তৃতা দেয়ার ঢং-এ বললেন, শুধু শুধু পান চিবুলে দেখবেন টক টক লাগছে। টক লাগার কারণ হচ্ছে পানে এক ধরনের এসিড বা অন্ন আছে। অম্ল টক স্বাদযুক্ত। চুন হচ্ছে এক জাতীয় ক্ষার। ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড। এই ক্ষার অম্নকে প্রশমিত করে। এই জন্যেই পানের সঙ্গে চুন খেতে হয়।
ও আচ্ছা আচ্ছা। ভালো কথা। অম্ল এবং ক্ষার। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। অনেকদিন থেকে মনের মধ্যে একটা খটকা ছিল। আচ্ছা, এখন বলে তো দেখি, তেঁতুলের সঙ্গে চুন মিশালে কি তেঁতুলের টক-ধর্ম চলে যাবে?
মবিনুর রহমান চুপ করে বইলেন। এই বিষয়টা তার জানা নেই। অনুমানের উপর কিছু বলা ঠিক হবে না। বিজ্ঞান অনুমানের উপর চলে না। পরীক্ষা করে তারপর বলতে হবে।
জালালুদ্দিন পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, কী, কথা বলছি না কেন? কী হবে তেঁতুলের সঙ্গে চুন মেশালে?
কাল আপনাকে বলব।
কাল কেন? আজই বলো।
আজ বলতে পারব না। পরীক্ষা করে তারপর বলব।
একদিন যাব তোমার বাড়িতে। তোমার চোঙটা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাব।
দুরবিনের কথা বলছেন?
হ্যাঁ, দুরবিন। বৃহস্পতির বলয় না-কি দেখা যায়, হেড স্যার বলছিলেন।
হ্যাঁ দেখা যায়। চৈত্র মাসে দেখা যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকে। চৈত্র মাস। আসুক, আপনাকে দেখব।
মবিনুর রহমান উঠে পড়লেন। তার ক্লাসের সময় হয়ে গেছে। ঘণ্টা পড়বার আগেই ক্লাসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। দীর্ঘ আট বছরের নিয়ম। এই নিয়মের ব্যতিক্রম করা ঠিক না।
ক্লাস টেন, সেকশান বি-র সঙ্গে ক্লাস। পড়বার বিষয়বস্তু হচ্ছে আলো। আলোর প্রতিফলন এবং প্রতিসরণ। বড় চমৎকার বিষয়। আলো হচ্ছে একই সঙ্গে তরঙ্গ এবং বস্তু। কী অসাধারণ ব্যাপার! ক্লাস টেনের ছেলেগুলি অবশ্যি এইসব বুঝবে না, তবে বড় হয়ে যখন বুঝবে তখন চমৎকৃত হবে।
মবিনুর রহমান ক্লাসে ঢুকেই বললেন, আজ বাতাসেব আৰ্দ্ধতা শতকরা আশি। যদিও বাইরে রোদ দেখা যাচ্ছে তবু আমার ধারণা সন্ধ্যানাগাদ বৃষ্টিপাত হবে। এখন তোমরা বলে আলোর গতিবেগ সেকেন্ডে কত? যারা জানো ডান হাত তোল। যারা জানো না বাঁ হাত তোল।
সাতজন ছেলে ডান হাত তুলল। মবিনুর রহমানের মন খারাপ হয়ে গেল। তাঁর ধারণা ছিল সবাই ডান হাত তুলবে। মাত্র সাতজন? ছেলেগুলি কি সায়েন্সে মজা পাচ্ছে না? তা কী করে হয়?
তুমি বলো, আলোর গতিবেগ কত?
প্ৰতি সেকেন্ডে এক লক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল, স্যার।
ভেরি গুড। এখন তুমি বলো–হ্যাঁ, তুমি ইয়েলো শার্ট তুমি বলো–আলোর গতি কি এর চেয়ে বেশি হতে পারে?
জি-না স্যার। কেন পারে না?
এটাই স্যার নিয়ম।
কার নিয়ম?
প্রকৃতির নিয়ম।
ভেরি গুড়। ভেরি ভেরি গুড। প্রকৃতির কিছু নিয়ম আছে যার কখনো কোনো ব্যতিক্রম নেই। ব্যতিক্রম হতে পারে না; যেমন ধর মাধ্যাকর্ষণ। একটা পাকা আমি যদি গাছ থেকে পড়ে তা পড়বে মাটিতে। আকাশে উড়ে যাবে না। ইজ ইট ক্লিয়ার?
জি স্যার।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তির আবিষ্কারক কে?
নিউটন।
নামটা তুমি এমনভাবে বললে যেন নিউটন হলেন একজন রাম-শ্যাম, যদু-মধু, রহিম-করিম, বজলু-ফজলু। নাম উচ্চারণে কোনো শ্ৰদ্ধা নেই। শ্রদ্ধার সঙ্গে নাম বলো।
ছাত্রটি মুখ কাচুমাচু করে বলল, মহাবিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন।
মবিনুর রহমান শুকনো মুখে বললেন, একজন অতি শ্ৰদ্ধেয় বিজ্ঞানীর নাম অশ্রদ্ধার সঙ্গে বলার জন্যে তোমার শাস্তি হবে। ক্লাস শেষ হলে আজ বাড়ি যাবে না। পাটিগণিতের বারো প্রশ্নমালার একুশ এবং বাইশ এই দুটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
ফোর্থ পিরিয়ড শেষ হবার আগেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করল। ঝুম বৃষ্টি নামল ক্লাসের শেষ ঘণ্টার পর। ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মতো বৃষ্টি। মবিনুর রহমান টিচার্স কমনরুমে বসে রইলেন। স্কুল ফাঁকা হতে শুরু করেছে। বৃষ্টি মাথায় নিয়েই সবাই নেমে পড়ছে। পুরা স্কুলে এখন মানুষ আছে তিনজন। দপ্তরি কালিপদ, মবিনুর রহমান এবং ক্লাস টেনের হলুদ শার্ট গায়ে দেয়া ছাত্র মফিজ। বারো প্রশ্নমালার অঙ্ক দুটি সে কিছুতেই কায়দা করতে পারছে না।
মবিনুর রহমান চুপচাপ তাঁর চেয়ারে বসে আছেন। খোলা জানালায় বৃষ্টির ছাঁট আসছে। তিনি তাকিয়ে আছেন বৃষ্টির দিকে। তাঁর মন বেশ খারাপ। গত দশদিন ধরেই রোজ সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি হচ্ছে। দুরবিন নিয়ে আকাশ দেখা হচ্ছে না। বর্ষাকালের মেঘমুক্ত আকাশ দুরবিন দিয়ে দেখার জন্যে খুব ভালো। আকাশে ধুলোবালি থাকে না। অনেক দূরের নক্ষত্রও স্পষ্ট দেখা যায়।
মবিনুর রহমান উঁচু গলায় ডাকলেন, কালিপদ!
কালিপদ ছুটে এলো।
মফিজ নামের ছেলেটাকে দুটা অঙ্ক করতে দিয়েছিলাম, অঙ্ক হয়েছে কি-না খোঁজ নিয়ে আসি।
জি আচ্ছা স্যার।
তুমি স্কুল বন্ধ করে চলে যাও। আমার প্রাইভেট টিউশ্যানি আছে। সন্ধ্যাবেলা স্কুল থেকে যাব। আমি তালা দিয়ে যাব।
জি আচ্ছা স্যার।
কালিপদ কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে জানাল, ছেলেটির অঙ্ক দুটা এখনো হয় নি। মবিনুর রহমান তাঁর সামনের ডেস্কের ড্রয়ার থেকে সাদা কাগজ বের করলেন। অতি দ্রুত সেই কাগজে অঙ্ক দুটি করলেন। কাগজের এক মাথায় লিখলেন–মফিজ, তুমি আরো মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। প্রকৃতি তোমাকে যে মস্তিষ্ক দিয়েছে তা প্রথম শ্রেণীর। সেই মস্তিষ্ক ব্যবহার করা তোমার কর্তব্য।
কালিপদ, ছেলেটাকে এই কাগজটা দিয়ে আসা। সে যেন দেখে দেখে অঙ্ক দুটা বোর্ডে করে রাখে।
জি আচ্ছা।
অঙ্ক করা হলে তাকে চলে যেতে বলে।
জি, আচ্ছা। স্কুলঘর এখন পুরো ফাঁকা। মবিনুর রহমান চেয়ার ছেড়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। ঘড়িতে তখন বাজে। ছটা। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি দুটা থেকে সন্ধ্যা ছটা–এই চার ঘণ্টা তিনি একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাতাসে মাথার চুল না। নড়লে তাঁকে মূর্তি বলেই মনে হতো। দীর্ঘ সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকায় এই ব্যাপারটা শুধু কালিপদ জানে। সে কাউকে তা বলে নি। মাঝে মাঝে এই মানুষটাকে তার ভয় ভয় করে অথচ মানুষটা ভালো। প্রতি মাসের তিন তারিখে বাড়ি ভাড়া বাবদ একশ টাকা তাকে দিচ্ছে। তবে কালিপদের ধারণা এই বর্ষাকালেই মানুষটা সাপের কামড়ে মারা যাবে। বাড়ি ভাড়া হিসেবে একশ টাকা আসা বন্ধ হতে বেশি দেলি নেই।
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছটায় মবিনুর রহমান এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, স্কুল কমিটির মেম্বার, প্রাক্তন চেয়ারম্যান আফজাল সাহেবের বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। আফজাল সাহেবের বড় মেয়ে রূপাকে গত ছমাস ধরে তিনি পড়াচ্ছেন। রূপা এই বছর এসএসসি দেবে। গত বছর দেবার কথা ছিল, টাইফয়েড হওয়ায দিতে পারে নি। এবার দিচ্ছে। রূপার ধারণা এবারো সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। পরীক্ষার ঠিক আগে চিকেন পক্স কিংবা হাম হবে। মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী। তবে পড়াশোনায় মন নেই। কখনো সময়মতো আসবে না। এমনো হয়েছে তিনি আধঘণ্টা বসে আছেন কপার দেখা নেই।
আজ অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো। চোখ কপালে তুলে বলল, স্যার এই বৃষ্টির মধ্যে আসছেন। আমি ভাবলাম, আসবেন না।
মবিনুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, ঝড়বৃষ্টির জন্যে আসি নি এরকম কী কখনো হয়েছে?
একবার হয়েছে স্যার। মে মাসের দু তারিখে আপনি আসেন নি। ঝড় হচ্ছিল তাই আসেন নি।
মবিনুর রহমান চুপ করে গেলেন। কথা সত্যি। মে মাসের দুতারিখে তিনি আসেন। নি। মেয়েটা এটা মনে করে বাখবে তা ভাবেন নি। এই মেয়েব অনেক কিছুই তিনি বুঝতে পাবেন না। যেমন, মাঝে মাঝে সে পড়া বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি বিবক্ত হয়ে যখন ধমক দেন–কী ব্যাপার, পড়ছি না কেন? তখনো চোখ নামিয়ে নেয় না। ক্লান্ত গলায় বলে, আজ আর পড়তে ভালো লাগছে না, স্যার। আজ আপনি যান। বলেই অতি অভদ্রের মতো উঠে চলে যায়।
রূপা বলল, স্যার, একটা গামছা এনে দিই। মাথাটা মুছে ফেলুন, মাথা ভিজে গেছে।
অসুবিধা হবে না–তুমি অঙ্ক নিয়ে বস। বারো প্রশ্নমালার একুশ এবং বাইশ এই দুটা অঙ্ক কর তো দেখি পার কি-না!
রূপা নিমিষেই অঙ্ক দুটা করে ফেলল। মবিনুর রহমান মনে মনে বললেন, ভেরি গুড, ভেরি গুড। এই মেয়েটির সঙ্গে বেশিরভাগ কথাই তিনি মনে মনে বলেন।
স্যার, অঙ্ক দুটা হয়েছে?
হ্যাঁ। আচ্ছা শোন, তোমাদের বাসায় কি তেঁতুল আছে?
জি স্যার, আছে।
একটা পিরিচে করে সামান্য তেঁতুল আর খানিকটা চুন আন। পান খাওয়ার চুন।
কী করবেন। স্যার?
ছোটখাটো একটা এক্সপেরিমেন্ট। পিরিচটা দিয়ে তুমি অ্যালজেব্রা নিয়ে বস। কাল করেছিলে দশ প্রশ্নমালা। আজ এগারো।
রূপা উঠে চলে গেল। ফিরতে অনেক দেরি করল। মেয়েটার এই এক অভ্যাসএকবার উঠে গেলে ফিরতে অনেক দেরি করে। মবিনুর রহমান বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। এবার নিশ্চয় বন্যা হবে। এক বছর পর পর দেশে বন্যা হচ্ছে। গত বছর হয় নি। এবার তো হবেই।
স্যার, নিন তেঁতুল। খানিকটা লবণও নিয়ে এসেছি। স্যার লবণ লাগবে?
না। তোমাকে তো লবণ আনতে বলি নি। তুমি অ্যালজেব্রা নিয়ে বস।
মবিনুর রহমান আঙুল দিয়ে ডলে ডলে চুন এবং তেঁতুল মেশাচ্ছেন। রূপা নিঃশব্দে অঙ্ক করে যাচ্ছে। মবিনুর রহমান এক সময় হঠাৎ লক্ষ করলেন, রূপা অঙ্ক করা বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘোর-লাগা চোখের দৃষ্টি।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কী ব্যাপার, কী দেখছ? অঙ্ক কর।
আজ আর করব না, স্যার।
কেন?
ভালো লাগছে না।
রূপা তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে না। মবিনুর রহমান চুন মেশানো তেঁতুল খানিকটা জিভে লাগালেন। তিতা তিতা লাগছে। টক ভাব এখনো আছে। অন্ন এবং ক্ষারের প্রশমন ক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয় নি বলে মনে হচ্ছে। আরো খানিকটা চুন মেশানো দরকার। এবং একটু বোধহয় গরম করা দরকার।
রূপা!
জি স্যার।
আরেকটু চুন। এনে দাও তো!
রূপা উঠে দাঁড়াল। ইতস্তত কবে বলল, আচ্ছা স্যার, আমার মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী পরিবর্তন?
সত্যি লক্ষ করেন নি?
না তো!
প্রথম আমার গায়ে ছিল সবুজ রঙের একটা শাড়ি। এখন একটা ডোরাকাটা শাড়ি। যখন তেঁতুল আনতে বললেন, তখন শাড়ি বদলালাম।
ও!
ও আচ্ছা!
চুন নিয়ে রূপা এলো না। একটা কাজের মেয়ে একগাদা চুন দিয়ে গেল। সরু গলায় বলল, আপার মাথা ধরছে আইজ আর পড়ব না।
আচ্ছা।
আম্মা আফনেরে ভাত খাইয়া যাইতে বলছে।
না, ভাত খাব না। চলে যাব। শোন, আমি তেঁতুল আর চুন নিয়ে যাচ্ছি, কেমন? ঘরে বাড়তি ছাতা থাকলে আমাকে একটা ছাতা দাও।
বাড়তি ছাতা ছিল না।
মবিনুর রহমান বাড়িতে ফিরলেন কাকভেজা হয়ে। নদীর পাশ ঘেসে বাড়ি ফেরার বাস্তা। নদী ফুলে-ফোঁপে একাকার হয়েছে। কান পাতিলেই নদীর ভেতর থেকে আসা হুঁ-হু গর্জন শোনা যায়। খানিকটা ভয় ভয় লাগে। শুধু ভয় না। ভয়ের সঙ্গে এক ধরনের আনন্দও মেশানো থাকে।
মবিন্নুর রহমান বাড়ি ফিরেই রান্না চড়ালেন। হাঁড়িতে দুছিটাক আন্দাজ পোলাওয়ের চাল, মুগের ডাল, কয়েক টুকরা আলু এবং তিন চামচ ঘি। অল্প আঁচে অনেকক্ষণ সিদ্ধ হবে। এক সময় অতি সুস্বাদু ঘন সু্যপেব মতো একটা জিনিস তৈরি হবে। গরম গরম খেতে চমৎকার লাগবে। ডিম থাকলে ভালো হতো। ডিমটাও ছেড়ে দেওয়া যেত। প্রোটিন কম খাওয়া হচ্ছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। বৃষ্টির বিরাম নেই। মনে হচ্ছে আকাশটা যেন অনেক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। মবিনুর রহমান একটা টর্চ এবং ছাতা হাতে ঘরে তালা দিয়ে বের হলেন। আজ রাতটা তিনি নৌকায় কাটাবেন। নৌকায় বিছানা বালিশ সবই আছে। প্রশস্ত পাটাতনে তোশক বিছানো। দুপাশের দরজা লাগিয়ে নৌকায় শুয়ে থাকলে চমৎকার লাগবে। সারারাত নদীতে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাবে। বাতাসে নৌকা এপাশি-ওপাশ করবে। চারদিকে থাকবে নিশ্চিছদ্র অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাবে। সেই বিদ্যুৎ চমকে চারদিক আলো হয়ে আবার অন্ধকার হয়ে যাবে।
মবিনুর রহমান নৌকার বিছানায়
মবিনুর রহমান নৌকার বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। গাঢ় ঘুম, এত গাঢ় যেন মৃত্যুর কাছাকাছি। এই ঘুমের মধ্যেই তিনি অতি বিচিত্র একটি স্বপ্ন দেখলেন। যেন কয়েকজন বুড়ো মানুষ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সবার চেহারা এক রকম। তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিও একরকম। সবার মুখেই এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হাসি। সেই হাসি একই সঙ্গে কঠিন এবং কোমল। তারা কথা বলতে শুরু করলেন।
সবাই এক সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁদেব গলার স্বর এক রকম। সবাই এক সঙ্গে কথা বলার জন্যই বোধকরি এক ধরনের অধ্যাভাবিক রেজোনেন্স তৈরি হচ্ছে। শব্দটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। শরীরের প্রতিটি কোষ ঝিনঝন করে বাজছে। তার চেয়েও বড় কথা, ঘুমের মধ্যেই মবিনুর রহমানের মনে হলো এই বৃদ্ধদের তিনি আগেও স্বপ্ন দেখেছেন।
অতি দূর শৈশবে। যার স্মৃতি অস্পষ্টভাবে হলেও রয়ে গেছে।
মবিনুর রহমান!
জি।
তুমি কি মাতৃগর্ভের স্মৃতি মনে করতে পারছ?
না।
মাতৃগর্ভে যখন ছিলে তখন চারদিকে ছিল নিশ্চিন্দ্র অন্ধকার। এখনো কি চারদিকে অন্ধকার নয়?
হ্যাঁ!
মাতৃগর্ভে তুমি এক ধরনের তরল পদার্থের উপর ভাসছিলে–যাকে তোমরা বলে। এমনোটিক ফ্লুয়িড। এখনো তুমি ভাসছ পানির উপর। দোল খাচ্ছ। খাচ্ছ না?
জি।
খানিকটা হলেও মাতৃগর্ভের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। নয় কি?
হ্যাঁ, তৈরি হয়েছে। আপনারা কে?
আমরা হচ্ছি–নি।
হ্যাঁ— নি। আমরা স্বপ্ন তৈরি করি।
বুঝতে পারছি না।
এখন বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে। আমরা তোমাকে বুঝতে সাহায্য করব। তোমাকে সাহায্য করার জন্যেই আমরা এসেছি। তুমি আমাদেরই একজন।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তুমিও একজন নি।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তোমার মধ্যে আছে প্ৰচণ্ড ক্ষমতা। তুমি এই ক্ষমতা ব্যবহার করা।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
মন দিয়ে শোন–তোমার ভেতর আছে প্ৰচণ্ড ক্ষমতা! অকল্পনীয় ক্ষমতা। ক্ষমতা ব্যবহার কর। স্বপ্ন দেখ। স্বপ্ন দেখ।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
মবিনুর রহমান ঘুমের ঘোরেই কাতর শব্দ করলেন, তারপর তলিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে। ঘুম যখন ভাঙল তখন চারদিক আলো হয়ে আছে। অনেক বেলা হয়েছে, কড়া রোদ। দীর্ঘ আট বছর পর এই প্রথম মবিনুর রহমানের মনে হলো আজ স্কুলে না যেয়ে সারাদিন নৌকায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলে কেমন হয়?
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেড মাস্টার
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেড মাস্টার হাফিজুল কবির সাহেব একটা ছোট্ট সমস্যা নিয়ে বিব্রত। সমস্যাটির বয়স সাত মাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সমস্যাই খানিকটা পাতলা হয়। তারটা হচ্ছে না। বরং খানিকটা জোরাল হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা এ রকম–ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রামে গত মাসে নীলগঞ্জ হাই স্কুলকে পঞ্চাশ বস্তা গম দেয়া হয়েছিল। তিনি মবিনুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে গম আনতে গেলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, একটা সমস্যা হয়েছে হেড মাস্টার সাহেব।
তিনি বললেন, কী সমস্যা?
পঞ্চাশ বস্তা গম তো আপনাকে দিতে পারছি না। দশ বস্তা নিয়ে যান।
দশ বস্তা।
হ্যাঁ, দশ। আর ক্যাশ টাকা দিচ্ছি। পাঁচ হাজার।
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, খাতায় সই করতে হবে পঞ্চাশ বস্তা গম?
হ্যাঁ। নানান ফ্যাকরা রে ভাই। সাহায্যের গম বারো ভূতে লুটে খাচ্ছে। সৎভাবে যে কিছু করব তার উপায় নেই। আপনি তো সবই বুঝেন। বুঝেন না?
জি, বুঝব না কেন?
দশ বস্তা গম নিয়ে যান। আর নিতে যদি না চান কোনো অসুবিধা নেই। আমার অন্য প্রোগ্রামে ট্রান্সফার করে দেব। নেবেন, না নেবেন না?
নিব।
আসুন তাহলে খাতায় সই করুন।
হেড মাস্টার সাহেব বিচক্ষণ লোক। নিজে সই করলেন না, মবিনুর রহমানকে সই করতে বললেন। তিন মাস পর উপর থেকে চিঠি এলো–বিশেষ ব্যবস্থায় নীলগঞ্জ হাই স্কুলকে যে একশ বস্তা গম দেওয়া হয়েছিল তা কীভাবে খরচ হয়েছে? উন্নয়নের কোন কোন খাতে অৰ্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা যেন অতি সত্ত্বর জানানো হয়।
হেড মাস্টার সাহেব ছুটে গেলেন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে। আমতা আমতা করে বললেন, একশ বস্ত, গমের কথা কীভাবে এলো স্যার?
চেয়ারম্যান সাহেব হাই তুলে বললেন, কাগজপত্রে তাই লেখা আছে, আপনি নিজে সই করে নিয়েছেন।
আমি সই করি নি স্যার, মবিনুর রহমান করেছে।
মবিনুর রহমানটা কে?
আমাদের স্কুলের সায়েন্স টিচার।
তাহলে তো আপনি বেঁচেই গেলেন। তদন্ত কমিটি করে দেন। ব্যাটার চাকরি চলে যাক। সব সমস্যার সমাধান। নতুন টিচার নিয়ে নেবেন। বাংলাদেশে সায়েন্স গ্র্যাজুসেটের কোনো অভাব নেই। আমার এক ভাইস্তা আছে বিএসসি পাস করে ঘুরছে, তাকেও নিতে পারেন।
হেড মাস্টার সাহেব মুখ শুকনো করে বসে রইলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব চা এবং কেক খাওয়ালেন। কোনো কিছুই তাঁর মুখে রুচল না।
হেড মাস্টার সাহেব তদন্তু কমিটি তৈরির ব্যাপারটা অনেকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ডিসট্রিক্ট এড়ুকেশন অফিসার অতি জরুরি সিল মেরে চিঠি পাঠিয়েছেন। আর দেরি করা যায় না। হেড মাস্টার সাহেব জালালুদ্দিন সাহেবকে অফিসে ডেকে পাঠালেন। সরু গলায় বললেন, জালাল সাহেব, আপনাকে তো একটা অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করতে হয়। একটা তদন্ত কমিটি হচ্ছে, আপনি তার চেয়ারম্যান, তিনজন মেম্বার। আফজাল সাহেব, সেক্রেটারি সাহেব এবং উপজেলা চেয়ারম্যান। আমাদের মধ্যে আপনি সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং ধর্মপ্ৰাণ ব্যক্তি–সেই হিসেবে আপনি চেয়ারম্যান।
জালাল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কীসের তদন্ত?
হেড মাস্টার সাহেব গলা পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কেলেংকারি ব্যাপার হয়েছে। স্পেশাল পারমিশনে নীলগঞ্জ স্কুলকে একশ বস্তা গম দেয়া হয়েছিল। মবিনুর রহমান সইসোবুদ করে গম নিয়েছে। আমাকে বলেছে দশ বস্তা। আমি তো তাই সরল মনে বিশ্বাস করলাম। মবিনকে অবিশ্বাস করার কি কোনো কারণ আছে? আপনি বলেন। যাই হোক দুমাস পর ডিও-র চিঠি পেয়ে আমি তো যাকে বলে থান্ডারষ্ট্রাক, বজ্রাহত।
জালালুদ্দিন হতভম্ব গলায় বললেন, মবিন এই কাজ করেছে আমার বিশ্বাস হয় না। যদি আসমান থেকে ফেরেশতা নেমে এসে বলে–মোবিন গম চুরি করেছে। আমি বিশ্বাস করব না।
বিশ্বাস তো আমিও করি না। করি না বলেই তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান করলাম। আপনাকে। আপনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মবিনকে আজই কিছু বলার দরকার নেই…
আমার তো মনে হয় আজই কথা বলা দরকার।
দরকার মনে হলে বলবেন-আপনি হচ্ছেন তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান। আপনি যা ডিসাইড, করবেন তাই হবে। থরো ইনকোয়ারি হবে।
আমি কিছুই বুঝছি না। কিছুই না–এমন একজন ভালো মানুষ!
ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ চট করে চেনা যায় না জালাল সাহেব। চট করে মানুষ চেনা গেলে কি আর দুনিয়ার আজ এই হালত? তবে আপনাকে একটা কথা বলি, গোড়া থেকেই কিন্তু এই লোকটাকে আমার পছন্দ না। তারপর যখন দুমাস আগে নৌকা কিনে ফেলেছে–দুই না তিন হাজার টাকা দাম। নৌকা ঘাটে বাধা থাকে। তখনো মনে খচ করে উঠল।
জালাল সাহেব উঠে দাঁড়ালেন। হেড মাস্টার সাহেবের কথা শুনতে তার এখন আর ভালো লাগছে না। টিচার্স কমনরুমে মবিনুর রহমানকে পেলেন না। দীর্ঘদিন পর এই মানুষটা স্কুল কামাই করেছে এবং বেছে বেছে আজকের দিনে। এটা কি পুরোপুরি কোনো কাকতালীয় ব্যাপার? জালাল সাহেব ক্লাস সিক্সে ধর্ম পড়াতে পড়াতে হঠাৎ বললেন, সুরা বনি ইসরাইলে দুটা চমৎকার বাক্য আছে–মানুষ যেভাবে ভালো চায়, সেভাবেই মন্দ চান। মানুষের বড়ই তাড়াহুড়া। তোমরা এই দুই লাইনের ব্যাখ্যা করা। তোমাদের যা মনে আসে তাই লেখ। আর শোন, কেউ হৈ চৈ করবে না। আমার মন আজ ভালো না। মন। অসম্ভব খারাপ। বলতে বলতে জালাল সাহেবের চোখে পানি এসে গেল।
আকাশ অন্ধকার করে মেঘ করছে
কদিন ধরে রোজ বিকেলে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ করছে। আজ ব্যতিক্রম। সারাদিন আকাশ ছিল ঘন নীল। মেঘের ছিটাফোঁটাও ছিল না। এখন সাড়ে ছাঁটার মতো বাজে, এখনো আকাশ পরিষ্কার। গাছের মাথায় মাথায় ঝকঝকে রোদ।
রূপা এই সময় তার মার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। জানালায় পর্দা দেয়া। পর্দা দেয়া থাকলেও পর্দার ফাঁক দিয়ে অনেক দূর দেখা যায়। ঠিক সাড়ে ছাঁটায় রূপার মাস্টার সাহেব তাদের বাড়ির গেটে হাত রাখেন। হাত রাখার আগে পকেট থেকে ঘড়ি বের করে বিরক্ত চোখে তাকান। এই দৃশ্য দেখতে রূপার বড় ভালো লাগে।
তার কী যে হয়েছে! রোজ দুপুরের পর থেকেই এক ধরনের অস্বস্তি। অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে আশঙ্কা : যদি না আসেন! যতই বিকেল হতে থাকে আশঙ্কা ততই বাড়তে থাকে। এক সময় বুকের ভেতর ধুকধুক শব্দ এত বেশি হয় যে মনে হয় সবাই শুনে ফেলছে। সাড়ে ছটার পর অবধারিতভাবে এই শব্দ কমে যায়। নিজেকে তখন খুব ক্লান্ত লাগে। সারাদিন খুব পরিশ্রমের কোনো কাজ করলে কাজের শেষে যে রকম ক্লান্তি, অনেকটা সে রকম ক্লান্তি।
এই যে ব্যাপারগুলি তার মধ্যে হচ্ছে এটা কি অন্যায়? অন্যায় তো বটেই, তবে খুব বেশি অন্যায় নিশ্চয়ই না। সে তেমন কিছু তো করে না। স্যার যা পড়তে বলেন পড়ে। যে অঙ্ক করতে বলেন করে। বাড়ির কাজ করে। মাঝে মাঝে অবশ্যি সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়–তখন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এই সময় শরীরে এক ধরনের ব্যথা বোধ হয়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। বমি বমি ভাব হয়। তখন সামনে থেকে উঠে গিয়ে বমি করতে হয়। তবে এই ব্যাপারগুলি ঘনঘন হয় না। ঘনঘন হলে সবার চোখে পড়ত। ভাগ্যিস কিছুদিন পর পর হয়।
রূপা তার স্যারকে গত ছমাসে গভীর মনোযোগে লক্ষ করেছে। এত মনোযোগ দিয়ে এর আগে সে কাউকেই লক্ষ করে নি। ভবিষ্যতেও করবে না। কারণ করার প্রযোজন নেই। রূপার ধারণা এই মানুষটিকে সে যতটা ভালো জানে অন্য কেউ তা জানে না, এমনকি মানুষটা সি জেও এতটা জানেন না।
মানুষটা কি জানেন যে তিনি মাঝে মাঝে অসম্ভব অন্যমনস্ক হয়ে যান? হ্যাঁ, তা নিশ্চয়ই জানেন। তবে অন্যমনস্ক হবার আগ মুহুর্তে তিনি কী করেন তা-কি জানেন? না, জানেন না। এটা জানে শুধু রূপা। এই মানুষটা যখন বঁ হাত দিয়ে খুব শান্ত ভঙ্গিতে মাথার চুল ভাজ করতে থাকেন তখন বোঝা যাবে তিনি অন্যমনস্ক হতে শুরু করেছেন। অন্যমনস্ক অবস্থায় মানুষটা কী ভাবেন তা রূপার খুব জানার ইচ্ছা।
রোজই ভাবে জিজ্ঞেস করবে। জিজ্ঞেস করা হয় না। শেষ মুহুর্তে লজ্জা লাগে। তবে একদিন সে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করবে। হয়তো আজই করবে।
মানুষটা রূপাকে খুবই বাচ্চা মেয়ে বলে মনে করেন। এটা যেমন সত্যি তেমনি এটাও সত্যি রূপা যখন কিছু বলে তখন তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে শোনেন এবং রূপার প্রতিটি কথা বিশ্বাস করেন। রূপা প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। খুব যে গুছিয়ে মিথ্যা বলে তাও না, অথচ মানুষটা তা বিশ্বাস করেন। রূপার তখন খুব খারাপ লাগে।
একবার রূপা বলল, মশা যে খুব বুদ্ধিমান প্ৰাণী তা কি স্যার আপনি জানেন?
তিনি অবাক হয়ে বললেন, জানি না তো! খুব বুদ্ধিমান হবার তো কথা না। ক্ষুদ্র প্ৰাণীর মস্তিষ্কের পরিমাণ অতি অল্প।
স্যার মস্তিষ্ক অল্প হলেও মশা খুব বুদ্ধিমান। আমি পরীক্ষা করে বের করেছি।
মানুষটা এতে খুব উৎসাহিত বোধ করলেন। তার চোখ চকচক করতে লাগল। মাথা সামনের দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলো, আবেগশূন্য কণ্ঠস্বরেও খানিকটা আবেগ চলে এলো। তিনি ছেলেমানুষি কৌতূহল নিয়ে বললেন, কী পরীক্ষা?
রূপার লজ্জা লাগছে। কারণ এখন সে যা বলবে তার পুরোটাই ডাহা মিথ্যা। অনেক ভেবেচিন্তে বের করেছে।
পরীক্ষাটা করেছি। আমার মামাতো বোনকৈ দিয়ে। মামাতো বোনের নাম ইয়াসমিন। আমার দুই বছরের ছোট। সে মশারি খাটিয়ে ঘুমুতে পারে না, তার নাকি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি একদিন লক্ষ করলাম, যখন সে জেগে থাকে তখন মশা খুব কম কামড়ায়। যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন খুব বেশি কামড়ায়। বুদ্ধিমান বলেই তারা অপেক্ষা করে কখন মানুষটা ঘুমিয়ে পড়বে। আরাম করে রক্ত খাওয়া যাবে। ঠিক না স্যার?
বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা এমন হেলাফেলা করে হয় না রূপা। আরো সূক্ষ্মভাবে করতে হয়। যেমন ধর, ঘুমুবার আগে ঘণ্টায়। কটা মশা কামড়াচ্ছে। ঘুমুবার পর কাঁটা। একজনকে দিয়ে পরীক্ষা করলেও হবে না। অনেককে দিয়ে করতে হবে। বুঝতে পারছ কী বলছি?
জি স্যার।
তবে তোমার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে বুঝতে হবে মশার মনে মৃত্যুভয় আছে। মৃত্যুভয় আছে বলেই জাগ্ৰত মানুষকে কামড়াচ্ছে না। মৃত্যুভয় বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ। শুধুমাত্র নির্বোধদেরই মৃত্যুভয় থাকে না।
স্যার আমার কিন্তু মৃত্যুভয় নেই। আমি কি নির্বোধ?
এইসব কথা এখন থাক। ফিজিক্স বইটা খোল তো।
ফিজিক্স পড়তে আমার ভালো লাগে না স্যার।
ফিজিক্স পড়তে ভালো লাগে না? তুমি এইসব কী বলছ? খুবই অন্যায় কথা বলছি। তোমার ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত।
রূপা বিস্মিত হয়ে বলল, কার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করব?
তোমার নিজের কাছে।
আচ্ছা স্যার ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। এবং নিজেকে ক্ষমা করে দিলাম।
বই খোল, থার্ড চেপ্টার বের কব–স্থির বিদ্যুৎ।
রূপা নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে থার্ড চেপ্টার বের করল। মানুষটা হাত নেড়ে নেড়ে স্থির বিদ্যুৎ বুঝাচ্ছেন। এমনভাবে বুঝাচ্ছেন যেন স্থির বিদ্যুৎ তিনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন। রূপা পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। আবার বমি বমি লাগছে। মাথা ঘুরছে। কেন এ রকম হয়? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? কী আছে এই মানুষটার মধ্যে, কেন তাকে এত ভালো লাগে?
ছটা চল্লিশ বাজে।
এখনো মানুষটার দেখা নেই। আকাশ পরিষ্কার। ঝড়-বৃষ্টি কিছুই নেই। এ রকম তো হবার কথা নয়। রূপার কেমন যেন লাগছে। গা কাঁপছে, ঘাম হচ্ছে। মাথার ভেতরটা যেন ফাঁকা হয়ে গেছে। রূপা বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তাদের উঠোনে অনেক গাছপালা। গাছপালার জন্যেই রাস্তা দেখা যায় না। রূপার মনে হলে গেটের কাছে দাঁড়ালেই সে দেখবে লম্বা মানুষটা মাথা নিচু করে দ্রুত আসছেন। দেরি করার জন্যে রূপা আজ কিছু কঠিন কথা শোনাবে। অবশ্যই শোনাবে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই আজ দেরি করবেন কেন?
রূপা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখান থেকে ডিসট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তার অনেকখানিই দেখা যায়। রাস্তায় লোকজন আছে কিন্তু ঐ মানুষটা নেই। রূপার মনে হলো খানিকক্ষণ চোখ বন্ধ করে তারপর যখন সে তাকাবে তখনই মানুষটাকে দেখতে পাবে। অবশ্যই পাবে। সে দীর্ঘ সময় চোখ বন্ধ করে রইল, এক সময় চোখ মেলল। রাস্তা ফাঁকা, কেউ নেই।
সন্ধ্যা মিলাচ্ছে, আকাশ গাঢ় রক্তবর্ণ। রূপা এখনো গেটের বাইরে। রূপার মা এক সময় বারান্দায় এসে বিস্মিত গলায় বললেন, ভরসন্ধ্যায় বাইরে কেন রে মা?
রূপা জবাব দিল না।
আয, ঘরে আয়।
রূপা ঘরে ঢুকাল। রূপাব মা বললেন, তোর কী হয়েছে? তোকে এমন লাগছে কেন? চোখ লাল।
রূপা ক্লান্ত গলায় বলল, মনে হয় আমার জ্বর আসছে।
কই, গা তো ঠাণ্ডা!
শরীরটা ভালো লাগছে না মা।
যা শুয়ে থাক।
আচ্ছা। স্যার এলে বলবে, আজ আমি পড়ব না।
বলব।
রূপা ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল। তার প্রতি মুহুর্তেই মনে হতে লাগল–এই বুঝি সার এসেছেন।
স্যার এলেন না, তবে বাত দশটায় রূপার বড় ভাই রফিক তার স্ত্রী এবং দুই কন্যা নিয়ে খুলনা থেকে বিনা নোটিশে এসে উপস্থিত হলো। সে তিন বছর পর গ্রামের বাড়িতে এসেছে। তার দ্বিতীয় মেয়ে রুবাবাকে এ বাড়ির কেউ দেখে নি। সেই মেয়ে এখন ফড়ফড় করে কথা বলে। যা দেখছে সে দিকেই ডান হাতের পাঁচ আঙুল বাড়িয়ে বলছে, এটা কী? বড় মেয়ের নাম জেবা। এই মেয়ে নিঃশব্দবতী, তার মুখে কোনো কথা নেই। রূপার মা ছেলেকে এবং ছেলের বেঁকে জড়িয়ে ধরে ক্রমাগত কাঁদছেন। রূপারও অসম্ভব ভালো লাগছে। সে ভাইয়ের ছোট মেয়েকে কোলে নিয়ে বাগানে হাঁটছে। মেয়েটি এক সময় আকাশের চাঁদের দিকে হাতের পাঁচ আঙুল মেলে বলল, এটা কী?
রূপা বলল, এটা চাঁদ। দেখেছ কত সুন্দর!
কয়েকটা জোনাকি উড়ে গেল। রুবাবা বলল, এটা কী?
এর নাম জোনাকি। এরা চাঁদের কণা গায়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কী সুন্দর তাই না রুবাবা?
একটা বাদুড় উড়ে যাচ্ছিল। রুবাবা বলল, এটা কী?
রফিক এক সময় বারান্দায় এসে দাঁড়াল। তার পেছনে পেছনে বাড়ির সবাই। রফিক তার মাকে বলল, রূপা তো মা পরীর মতো সুন্দর হয়েছে। আশ্চর্য!
ভাইয়ের কথা শুনে রূপার চোখে কেন জানি পানি এসে গেল।
রফিক বলল, এই রূপা! অন্ধকারে বাগানে ঘুরছিস? সাপখোপ আছে না?
রূপা হালকা গলায় বলল, অন্ধকার কোথায়? দেখছি না। কত বড় চাঁদ। দিনের মতো আলো।
রূপার বাবা বাড়িতে নেই। মামলার ব্যাপারে নেত্রকোনা গিয়েছেন। কয়েকদিন সেখানে থাকবেন। তাকে খবর দেবার জন্য রাতেই লোক গেল। একজন গোল ঘাটে। মাছ কিনতে।
ঘাটে বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। বেপারিরা ঢাকায় চালান দেবার জন্যে কিনে এনে জড়ো করে।
মবিনুর রহমান নৌকার ছাদে
মবিনুর রহমান নৌকার ছাদে বসে আছেন। নদীতে জোছনা যেন গলে গলে পড়ছে। পৃথিবী তাঁর কাছে এত সুন্দর এর আগে কখনো মনে হয় নি। এই ব্যাপারটাও তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। পৃথিবীর সৌন্দর্য নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি কবি নন। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। প্রকৃতির সৌন্দর্যের চেয়ে প্রকৃতির নিয়ম-নীতির সৌন্দর্য তাঁকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আজ সারাদিন তিনি কিছু খান নি। কারণ ঘরে কোনো খাবার নেই। সব এক সঙ্গে শেষ হয়েছে। হরলিক্সের একটা কোটায় চিড়া ছিল। মুখ খুলে দেখা গেল পোকা পড়ে গেছে। ডালের টিনে ডাল আছে। দুপুরে একমুঠ ডাল চিবিয়ে খেলেন। নাড়িতুড়ি উল্টে আসার জোগাড় হলো। বিকেল পর্যন্ত তিনি ক্ষিধেয় কষ্ট পেয়েছেন। এখন আর পাচ্ছেন না। ববং এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে হয় ক্ষুধার্ত অবস্থায়। ক্ষুধার্ত মানুষের স্নায়ু থাকে তীক্ষ্ণ। আহারে পরিতৃপ্ত একজন মানুষ ভোঁতা। স্নায়ু নিয়ে তেমন কিছু বোঝে না।
রাত নটার দিকে জালালুদ্দিন এসে উপস্থিত হলেন।
ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক ডাকাডাকি করলেন। কেউ সাড়া দিল না। সাপেব ভয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন না। নদীর দিকে রওনা হলেন। ঘরে যখন নেই। নৌকায় থাকতে পারে। না-কি সাপের কামড়ে ঘরে মরে পড়ে আছে?
দূর থেকে জালালুদিনের মনে হলো নৌকার উপর একটা পাথরের মূর্তি বসে আছে। জীবন্ত মানুষ এইভাবে বসে থাকতে পারে না। সামান্য হলেও নড়াচড়া করে। জালালুদ্দিন ডাকলেন, মবিন, এই মবিন!
পাথরের মূর্তি ডাক শুনতে পেল না। জালালুদিনের কেন জানি মনে হচ্ছিল শুনতে পাবে না। চিৎকার করে ডাকলেও এই মানুষ কিছু শুনবে না। গায়ে ঝাঁকি দিয়ে তাকে জাগাতে হবে।
তিনি নৌকায় উঠে এলেন।
মবিনুর রহমান চমকে উঠে বললেন, আপনি!
স্কুলে যাও নাই, খোঁজ নিতে আসলাম। করছ কী?
জ্যোৎস্না দেখছি।
কবি-সাহিত্যিকরা জ্যোৎস্না দেখে বলে শুনি–তুমি হলে গিয়ে সায়েন্সের লোক। আজ স্কুলে যাও নাই কেন? শরীব ভালো আছে?
জি, শরীর ভালোই আছে।
শরীর ভালো তো স্কুলে যাও নাই কেন? সারাদিন করেছ কী? ঘরে বসে ছিলে?
জি-না। নৌকায় ছিলাম। কিছু করছিলাম না–এই দৃশ্য-টুশ্য দেখছিলাম।
কী দৃশ্য দেখছিলে?
সন্ধ্যাবেলা কয়েক ঝাক পাখি উড়ে গেল। দেখতে খুব ভালো লাগল। পাখির ঝাকে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ করলাম। সব ঝাকে পাখি থাকে বেজোড় সংখ্যা।
এর মধ্যে ইন্টারেস্টিং কী?
খুবই ইন্টাবেষ্টিং। পাখিদের নিয়ম হচ্ছে এবং সব সময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। একটা পুরুষ পাখির সঙ্গে একটা মেয়ে পাখি থাকবেই। কিন্তু ঝাঁকগুলোয় একটা পাখি আছে সঙ্গীহীন। এর কারণটা কী? আর এই নিঃসঙ্গ পাখিটা পুরুষ না মেয়ে এটাও আমার জানার ইচ্ছ। কীভাবে সম্ভব হবে বুঝতে পারছি না। কীভাবে এটা বের করা যায় বলুন তো?
জালালুদ্দিন কিছু বললেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এই মানুষটিকে তিনি আট বছর ধরে চেনেন। তবু মনে হচ্ছে আট বছরে ঠিকমতো চেনা হয় নি।
মবিন।
জি।
ইয়ে একটা কাজে তোমার কাছে এসেছিলাম।
কী কাজ?
ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রামে তুমি একবার কিছু গম এনেছিলে মনে আছে?
হ্যাঁ–মনে আছে।
কয় বস্তা গম ছিল?
দশ বস্তা।
তোমার পরিস্কার মনে আছে তো?
মনে থাকবে না কেন, আমি নিজে সই করে আনলাম।
দশ বস্তাই ছিল? এর বেশি না?
বেশি থাকবে কেন? অবশ্যি বস্তা আমি গুনি নাই। হেডসার গুনলেন। আমি শুধু সই করে দিয়েছি।
হেড স্যার বস্তা গুনেছিলেন?
এইসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?
এমনি। এমনি জিজ্ঞেস করছি। তোমার ঘরে কি চায়ের ব্যবস্থা আছে?
না, আমি তো চা খাই না।
চায়ের একটা বাজে নেশা হয়েছে। বিকালে চা না খেলে ভালো লাগে না। আচ্ছা! আসছি। যখন তোমার চোঙটা দিয়ে আকাশ দেখে ফুই। শনির বলয় দেখা যাবে না?
আজ দেখা যাবে না। চাঁদের আলো খুব বেশি।
তাহলে থাক। নৌকায় বসে থাকতে তো ভালোই লাগছে। বড় সৌন্দর্য। কোরান মজিদে আল্লাহপাক কী বলেছেন জানো? সুরা কাহাফ-এর সপ্তম পারায় আছে–পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে। আমি সেগুলিকে তার শোভা কবেছি। এই অর্থ ধরলে চন্দ্র হচ্ছে পৃথিবীর শোভা। কি, ঠিক না?
মবিনুর রহমান জবাব দিলেন না। তার মাথায চমৎকার একটা চিন্তা এসেছে। যদি পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকত তাহলে পৃথিবীব একদিকে থাকত সূর্যের আলো, অন্যদিকে চির অন্ধকার। তখন যদি চাদটার অবস্থান এমন হতো যে, চির-অন্ধকার পৃথিবীতে থাকবে চির-জ্যোৎস্না–তাহলে ব্যাপারটা কী দীড়াত? সেই চির জোৎস্নাব জগতের গাছগুলি নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো। মানুষগুলিও হতো অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা কী রকম?
জালালুদ্দিন ডাকলেন, মবিন!
মবিন জবাব দিলেন না। তার সমস্ত চিন্তা-চেতনায় আছে চির-জ্যোৎস্নার দেশ। ঠিক এই রকম অবস্থায় মবিনুর রহমান দ্বিতীয় স্বপ্নটা দেখলেন। এই স্বপ্ন জাগ্রত অবস্থায্য ঘোরের মধ্যে দেখা। কাজেই তাকে হয়তো স্বপ্ন বলা যাবে না। মবিনুব রহমান স্পষ্ট দেখলেন–অসংখ্য বুড়ো মানুষ তার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। তারা এক সঙ্গে বলে উঠল— হচ্ছে, তোমার হচ্ছে। তুমি একজন প্রথম শ্রেণীর নি। তুমি তোমার প্ৰচণ্ড ক্ষমতা ব্যবহার কর।
মবিন। এই মবিন!
জি।
কী হচ্ছে তোমার, এই রকম কবছ কেন?
কী করছি?
গোঁ গোঁ শব্দ করছিলে।
মবিনুর রহমান ক্লান্ত গলায় বললেন, স্বপ্ন দেখছিলাম।
স্বপ্ন দেখছিলে মানে? তুমি ঘুমুচ্ছিলে না-কি?
মবিনুর রহমান বিব্রত গলায় বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হয়। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
রূপার বড় ভাই রফিক
রূপার বড় ভাই রফিক খুব আমুদে মানুষ। হৈ চৈ করতে পছন্দ করে। লোকজন জড়ো করে আড্ডা দেয়ায় তার খুব আগ্ৰহ। সে আসার পর থেকে রূপাদের বাড়িতে প্রচুর লোকজন। আসছে, যাচ্ছে, চা খাচ্ছে। বড় চায়ের কেতলি চুলায় আছেই।
বাড়ি-ভর্তি মানুষ, কিন্তু রূপার অস্থিরতা কমছে না। সে খুব স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে, পারছে না। মনে হচ্ছে এ জীবনে আর কোনোদিনও সে স্বাভাবিক হতে পারবে না। রফিকের এক গল্প শুনে সে খুব শব্দ করে হাসল। রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, হাসছিস কেন?
রূপা ক্ষীণ গলায় বলল, হাসির গল্প তাই হাসলাম।
আমি তো মোটেই হাসির গল্প বলি নি। আমাদের এক কলিগের স্ত্রী কীভাবে এ্যাক্সিডেন্ট করে পঙ্গু হয়ে গেছে, সেই গল্প করলাম। এর মধ্যে হাসির তো কিছু নেই।
রূপা চুপ করে রইল। ভাইয়ার দিকে চোখ তুলে তাকাতেও এখন তার ভয় ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে ভাইয়ার দিকে তাকালেই সে সব কিছু বুঝে ফেলবে।
রূপা!
জি।
তোর কী হয়েছে বল তো?
কিছু হয় নি।
আমার তো মনে হয় কিছু-একটা হয়েছে। তুই কারো কথাই মন দিয়ে শুনছিস না। তোর মধ্যে একটা ছটফটানি ভাব চলে এসেছে। আগে তো তুই এমন ছিলি না।
মানুষ তো বদলায় ভাইয়া।
অবশ্যই–বদলায়–এমনভাবে বদলায় না। তুই মাকে ডেকে আন তো, মাকে জিজ্ঞেস করি।
তাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে?
ডেকে আনতে বলছি, ডেকে আন।
রূপা মাকে ডেকে নিয়ে এলো। নিজে সামনে থাকল না। থাকতে ইচ্ছা করল না। সে লক্ষ করেছে তাকে নিয়ে বাড়িতে ঘনঘন বৈঠক হচ্ছে। বৈঠকে এমন কিছু আলোচনা হচ্ছে যেখানে তার উপস্থিতি কাম্য নয়। সবাই নিচু গলায় কথা বলছে–সে কাছে এলেই থেমে যাচ্ছে। এর মানে কী?
রূপা বাগানে নেমে গেল। সাত দু বাজতে বেশি বাকি নেই। রূপা নিশ্চিত আজ স্যার আসবেনই। আজ ছতারিখ। ছতারিখ তার জন্যে খুব লাকি। ক্লাস এইটো বৃত্তি পাবার খবর সে পেয়েছিল ছতারিখে। মবিনুর রহমান স্যার প্রথম এ বাড়িতে এসেছিলেনও ছতারিখে। রূপা লক্ষ করল ভাইয়া মার সঙ্গে কথা বলছে এবং আড়চোখে তাকে দেখছে। রূপা এমন ভাব করল যেন সে বাগানের গাছগুলি দেখছে। যদিও গাছপালার প্রতি তার তেমন মমতা নেই।
বারান্দায় জেবা এসে দাঁড়িয়েছে। সে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রূপার দিকে। এই মেয়েটির চোখের দৃষ্টিতে এমন কিছু আছে যে অস্বস্তি বোধ হয়। মনে হয় এই মেয়েটার দুটা চোখের ভেতরও কয়েকটা চোখ আছে। এক সঙ্গে অনেকগুলি চোখ যেন তাকে দেখে। রূপা জেবার দিকে তাকিয়ে বলল, বাগান দেখবে জেবা?
জেবা হ্যাঁ-না কিছু বলল না, তবে বাগানে নেমে এলো।
রূপা বলল, এই বাগানের নাম কী জানো? জংলি বাগান। কোনো যত্ন নেই–গাছপালায় জঙ্গল হয়ে আছে। তাই জংলি বাগান।
জেবা কিছু বলল না। এই মেয়েটা একেবারেই কথা বলে না।
আমাদের এই জংলি বাগান তোমার কাছে কেমন লাগছে জেবা?
জেবা নিশ্চুপ। যেন সে পণ করেছে কোনো কথা বলবে না। রূপা হাসতে হাসতে বলল, তুমি কি কারো সঙ্গেই কথা বলো না?
জেবা হাসল। ঠিক হাসিও না। তার ঠোঁট বাকাল না, তবে চোখে হাসি ঝিলিক খেলে গেল। সে এবার স্পষ্ট গলায় বলল–তুমি কার জন্য অপেক্ষা করছি ফুপু?
রূপা চমকে উঠে বলল, কারো জন্যে অপেক্ষা করছি না তো! আমি কারো জন্যে অপেক্ষা করছি এটা তোমার মনে হলো কেন?
জেবা এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বাগান থেকে উঠে বারান্দায় চলে গেল। রফিক হাসিমুখে বলল, কী মা বাগান ভালো লাগল না? জেবা জবাব দিল না। রফিক আবার বলল, আমাদের এই বাড়ি তোমার পছন্দ হয়েছে তো মা? জেবা এ প্রশ্নের উত্তরেও কিছু বলল না। তাকে আরো প্রশ্ন করা হতে পারে এই ভয়েই হয়তোবা বাড়ির ভেতরে চলে গেল।
রফিকের মা বললেন, তোর এই মেয়ে বোধহয় আমাদের কাউকে পছন্দ করছে না। কারো কোনো কথার জবাব দেয় না। রফিক বলল, ও এ রকমই মা। কথা বলার ইচ্ছা! হলেই কথা বলবে। ইচ্ছা না হলে বলবে না। খুব সমস্যা করছে। ঢাকায় নিয়ে ডাক্তাব দেখাব।
ডাক্তার কী করবে? সাইকিয়াট্রিষ্ট, ওরা এইসব ব্যাপার জানে। বাচ্চারা থাকবে বাচ্চাদের মতো। ওকে দেখ কেমন বড়দের মতো ভঙ্গি করে ঘুরে। ওর কথা বাদ দাও মা। এখন রূপার ব্যাপারটা বলে। ওর হয়েছে কী?
কিছু হয় নি তো!
আগেও তো বললে কিছু হয় নি। ভালো কবে ভেবে বলো ও কারো প্ৰেমে-ট্রেমে পড়ে নি তো?
কী বলিস তুই।
আজগুবি কোনো কথা বলছি না মা, রূপার ভাবভঙ্গি আমার ভালো লাগছে না বলেই বলছি। শেষটায় বিয়ে ঠিকঠাক হবার পর দেখা যাবে সে বেঁকে বসেছে।
এরকম কিছু নাই।
জানো তো ভালোমতো?
জানি।
কিন্তু আমার ভালো লাগছে না। রূপাকে দেখ কেমন মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। আগে তো। এ রকম ছিল না।
রফিক ঘরের ভেতরে চলে গেল। ছোট মেয়ে রুবাবা তারস্বরে চিৎকার করছে। সে ছাড়া এই মেয়েকে কেউ সামলাতে পারে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এত চিৎকারেও রূপার কোনো ভাবান্তর নেই। যেন সে কিছু শুনছে না। এক ধরনের ঘোরের মধ্যে আছে।
রূপা সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত বাগানে বসে রইল। বাঁধানো বকুল গাছের নিচে বসার ব্যবস্থা আছে।
রফিক বাইরে বেরোতে গিয়ে এই দৃশ্য দেখে বিবক্ত। গলায় বলল, এখনো বাগানে বসে আছিস কেন?
মাথা ধরেছে ভাইয়া। ফ্রেশ বাতাস নিচ্ছি।
বর্ষার সময়, সাপখোপ বেরোবে। উঠে আয়।
রূপা উঠে এলো। রফিক বিস্মিত হয়ে বলল, তুই কি কাঁদছিলি না-কি?
কাঁদব কেন শুধু শুধু?
তোর গাল ভেজা, এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছি।
কাঁপা শাড়ির আঁচলে গাল মুছতে মুছতে বলল, হ্যাঁ কাঁদছিলাম। মাথার যন্ত্রণায় কাঁদছিলাম। মাঝে মাঝে এমন যন্ত্রণা হয়। মাথাটা কেটে ফেলে দিতে ইচ্ছা করে।
সে কী যন্ত্রণা খুব বেশি?
হুঁ।
ডাক্তাব দেখিয়েছিস?
না।
তোদের নিয়ে বড় যন্ত্রণা। অসুখ-বিসুখ হবে, ডাক্তাব দেখাবি না? দেশে ডাক্তার আছে কী জন্যে? আচ্ছা। আমি বিধুবাবুকে নিয়ে আসব।
কাউকে আনতে হবে না।।
যা ঘরে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক। বাতে তোর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।
এখন বলো।
না এখন না। রাতে বলব। এখন একটা কাজে যাচ্ছি। আর শোন, তোর যদি বিশেষ কোনো কথা বলার থাকে যা আমাকে বা মাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছিস তাহলে তোর ভাবিকে বলবি।
আমার আবার বিশেষ কী কথা…
থাকতেও তো পারে। এই জন্যই বলছি।
রূপা নিজের ঘরে এসে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল। তার এখন সত্যি সত্যি মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। অসম্ভব কষ্টও হচ্ছে। আজ ছ তারিখ, কিন্তু স্যার এলেন না। উনার কি কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে? মোতালেবকে কি পাঠাবে খোঁজ নিতে? যদি পাঠায় কেউ কি তা অন্য চোখে দেখবে? অন্য চোখে দেখার তো কিছু নেই। একটা লোকের অসুখ-বিসুখ হলে খোঁজ নিতে হবে না!
হারিকেন হাতে মিনু ঘরে ঢুকল। কোমল গলায় বলল, তোমার নাকি প্ৰচণ্ড মাথাব্যথা?
হ্যাঁ, ভাবি।
মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?
না, তুমি এখন যাও। আমার একা থাকতে ইচ্ছা করছে। কিছুক্ষণ একা থাকলে মাথা ধরাটা কমবে।
এরকম কি তোমার প্রায় হয়?
হুঁ।
মশারি খাটিয়ে শোও। মশা কামড়াচ্ছে তো।
মশা কামড়াচ্ছে না ভাবি, তুমি যাও, হারিকেন নিয়ে যাও–আলো চোখে লাগছে।
মিনু হারিকেন নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল, তোমার স্যার এসেছিলেন। উনাকে বলেছি আজ পড়তে পারবে না। তোমার মাথাব্যথা। তাকে চলে যেতে বলেছি।
রূপা উঠে বসল। তার বুক ধকধক করছে। মনে হচ্ছে, সে নিজেকে সামলাতে পারবে না। সে কাঁপা গলায় বলল, ভাবি উনি কি চলে গেছেন?
জানি না। বলেছিলাম তো চ খেয়ে তারপর যেতে। বসেছেন কি-না জানি না।
ভাবি প্লিজ, উনাকে একটু বসতে বলো।
তোমার মাথাব্যথা?
এখন কমেছে। অনেকখানি কমেছে, জরুরি কিছু পড়া আছে দেখে নিই।
কাল আসতে বলি?
না ভাবি না।
মিনু হারিকেন হাতে চলে গেল। রূপার অস্বাভাবিক আগ্রহ তার চোখ এড়াল না। অবশ্যি সে এটাকে তেমন গুরুত্ব দিল না। এই বয়েসী মেয়েদের আচার-আচরণ কোনো ধরাবাধা পথে চলে না। তাদের আগ্রহ ও অনাগ্রহ কোনোটারই সাধারণত কোনো ব্যাখ্যা থাকে না। এরা চলে সম্পূর্ণ নিজের খেয়ালে।
মবিন সাহেবের হাতে দুদিনের পুরনো একটা খববের কাগজ। তিনি গভীব মনোযোগে খবরের কাগজ পড়ছেন। যে অংশটি পড়ছেন সে অংশ কেউ মন দিয়ে পড়বে না। সংবাদ শিরোনাম সিরাজগঞ্জের ধানচামীদের কীটনাশকের জন্যে আবেদন। ধানে পামরী পোকা ধরেছে। সেই পোকা বিনষ্ট করা আশু প্রয়োজন … ..ইত্যাদি, ইত্যাদি। খবরটা দুবার পড়বাব পর তিনি এখন তৃতীয় বারেব মতো পড়ছেন। তবে ভুরু কুঁচকে আছে। তিনি অপেক্ষা করছেন চায়েব জন্য। অপরিচিত একজন মহিলা তাকে বলে গেছেন, বসুন চা খেয়ে যান। তিনি বসে আছেন। চা এখনো আসছে না। রূপার মাথাব্যথা। সে আজ পড়বে না। শুনে তিনি খানিকটা স্বস্তি বোধ করছেন। কারণ তাঁর মন ভালো না, পড়াতে ইচ্ছা করছে না। শুধু মন না-শরীরটাও খারাপ। পরপর তিন রাত ঘুম হয় নি। দিনের বেলা ঘুমোতে চেষ্টা করেন, লাভ হয় না। খানিকটা ঝিমুনির মতো আসে খুঁটিখাট শব্দে ঝিমুনি কেটে যায়। বাজারে এসেছিলেন ঘুমের ওষুধ কিনতে, ফেরার পথে ভাবলেন রূপার পড়াশোনার খোঁজ নিয়ে যাবেন। একজন শিক্ষক সব সময় যে পড়া দেখিয়ে দেবেন তা তো না। মাঝে মাঝে তার উপস্থিতিই যথেষ্ট।
মবিন সাহেব খবরের এই অংশ তৃতীয়বার পড়া শেষ করে দরজার দিকে তাকালেন। দশ-এগারো বছরের এক বালিকা পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে চেষ্টা করছে যেন তাকে দেখা না যায়। দেখা যাচ্ছেও না, তবে পর্দার ফাঁক দিয়ে তার উজ্জ্বল চোখ দেখা যাচ্ছে।
মবিন সাহেব বললেন, তুমি কে? মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি কেউ না।
এ উত্তর মবিন সাহেবের পছন্দ হলো। মেয়েটা ভালোই বলেছে সে কেউ না। হুঁ আর ইউ? আই অ্যাম নো বডি। বাহ ভালো তো!
তোমার নাম কী?
জেবা।
জবা? বাহ্ সুন্দর নাম!
জবা না জেবা।
ও আচ্ছা, জেবা। পর্দার আড়ালে কেন? কাছে আসি গল্প করি।
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে ভেতরে চলে গেল।
মবিন সাহেব খুশিই হলেন। মেয়েটি গল্প করার জন্যে এগিয়ে এলে সমস্যা হতো। তিনি একেবারেই গল্প করতে পারেন না। তাছাড়া এই বয়েসী মেয়েরা কোন ধরনের গল্প শুনতে চায়। তাও জানেন না। তিনি চতুর্থ বারের মতো ধান গাছের পোকা বিষয়ে খবর পড়তে শুরু করলেন; কিছুতেই এটা মাথা থেকে সরাতে পারছেন না।
চা নিয়ে রূপা ঢুকল! শুধু চা না–এক বাটি মুড়ি। মুড়ির উপর তিনটা ভাজা শুকনা মরিচ।
স্যার কেমন আছেন?
ভালো।
এতদিন আসেন নি কেন?
মবিন সাহেব জবাব দিলেন না। এতদিন কেন আসেন নি এটা বলতে হলে এক গাদা কথা বলতে হবে। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। রূপা চেষ্টা করছে খুব স্বাভাবিক থাকতে। তার আচার-আচরণে কিছুতেই যেন ধরা না পড়ে–যে সে এই মুহুর্তে এক ধরনের ঘোবের মধ্যে আছে। বিশ্বাস পর্যন্ত হচ্ছে না যে স্যার তার সামনে বসে আছেন। মানুষটাব চেহারা এত সাধারণ কিন্তু এই সাধারণ চেহারা তার কাছে এত অসাধারণ লাগছে। মনে হচ্ছে তার একটা জীবন সে এই লোকটির দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিতে পারবে। এক পালকের জন্যেও সে চোখে ঐ পাতা ফেলবে না।
স্যার, আজ কিন্তু আমি পড়ব না।
আচ্ছা।
কাল থেকে সিরিয়াসলি পড়া শুরু করব।
আচ্ছা।
কাল আসবেন তো?
হুঁ।
চা খান স্যার। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে।
তিনি চায়ে চুমুক দিলেন। রূপা বলল, খুলনা থেকে আমার বড় ভাই এসেছেন। উনার দুই মেয়ে জেবা এবং রুবাবা। রুবাবা খুব অদ্ভুত নাম না স্যার?
হুঁ।
এই নাম আগে শুনেছেন?
না।
আমার মেজো ভাই থাকেন চিটাগাং। উনিও বোধ হয় আসবেন। তাকেও খবর দেয়া হয়েছে। সবাই মিলে একটা হৈচৈ-এর ব্যবস্থা হচ্ছে।
মবিন সাহেব ডান হাতে মাথার চুল আঁচড়াবার মতো ভঙ্গি করছেন। এই ভঙ্গি রূপার চেনা। এর অর্থ তিনি এখন অন্যমনস্ক। অন্য কিছু ভাবছেন।
স্যার, স্যার!
হুঁ।
কী ভাবছেন স্যার?
না মানে তেমন কিছু না–খবরের কাগজে একটা খবর পড়ার পব থেকে খারাপ লাগছে। মন থেকে বিষয়টা তাড়াতে পারছি না। ধান ক্ষেতে পোকা লেগেছে। চাষী বা পোকা মারার জন্য কীটনাশক চাচ্ছে। আমার খুব খারাপ লাগছে।
রূপা বিস্মিত হয়ে বলল, খারাপ লাগার কী আছে?
মবিনুর রহমান চেয়ারে পা তুলে বসলেন। এই ভঙ্গিটাও রূপার চেনা। এখন তিনি কঠিন গলায় কিছু কথা বলবেন। তিনি কথা বলা শুরু করলেন।
শোন রূপা, এই পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির জন্ম হয়েছে। মানুষ যেমন একটি প্ৰজাতি, কীট-পতঙ্গও প্রজাতি। এদের সবার বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এদের সঙ্গে সহাবস্থানেব পদ্ধতি বের করা যেতে পারে, এদের হত্যা করা যাবে না। এদের হত্যা করার আমাদের কোনো অধিকার নেই। আমরা সীমা লঙ্ঘন করছি।
রূপার খুব ইচ্ছে করল বলে–ওদের হত্যা না করলে তো এরা ধান খেয়ে ফেলবে। তখন আমরা মারা পড়ব। কিন্তু সে কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কথা শুনতে ইচ্ছা করছে। তার চেয়েও যা ভয়ংকিব তার ইচ্ছা করছে এই মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে।
যাই রূপা।
স্যার একটু বসুন। একটু।
মবিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
আরেক কাপ চা খান, আমি বানিয়ে নিয়ে আসি।
চা তো একবার খেলাম!
ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমি ভালো করে এক কাপ বানিয়ে নিয়ে আসি।
না।
তিনি উঠে পড়লেন। রূপার খুব কষ্ট হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে। হাত ধরে জোর করে তাকে স্বসিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলে আপনাকে বসতেই হবে। আপনি যেতে পারবেন। না। আপনি সারারাত এই চেয়ারে বসে থাকবেন। সারারাত আমার সঙ্গে গল্প করবেন।
তা বলা হলো না। কল্পনা এক জিনিস। বাস্তব অন্য। বাস্তবে রূপা তার স্যারকে এগিয়ে দিল গোট পর্যন্ত। স্যার চলে যাবার পরেও গোট ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আকাশ পরিষ্কার, চাঁদ উঠেছে। চাদের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। এত সুন্দর! পৃথিবী এত সুন্দর।
বাতের খাবাব শেষ হবার পর রফিক বলল, রূপা আয়, ছাদে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব কবি। ছাদ পরিষ্কার?
হুঁ। পাটি দিতে বলব? না চেয়ার?
পাটি দিতে বল। আর কয়েকটা বালিশ। তোর ভাবিকেও আসতে বল। ছাদে বসে চা খেতে খেতে জোছনা দেখি। অসম্ভব সুন্দর জোছনা হয়েছে। অনেকদিন এমন জোছনা দেখি নি।
তোমাদের খুলনায় জ্যোৎস্না হয় না?
হয়। দেখা হয় না। পানের বাটা সঙ্গে নিয়ে আসিস, পান খাব। কাঁচা সুপারি দিয়ে পান।
ভাইয়া তাকে কী বলবে তা কাঁপা আঁচ করতে পাবছে। বিয়ের কথা বলবে। এটা বলাব জন্যে এত ভনিতা কেন কে জানে। বলে ফেললেই হয়। অনেকক্ষণ ধরেই তারা ছাদে বসে আছে। রফিক নানান কথা বলছে। মূল প্রসঙ্গে আসছে না। এক সময় রূপার ধারণা হলো হয়তো মূল প্রসঙ্গই নেই। হালকা গল্পগুজব কিবাবা জন্যেই তাকে ডাকা হয়েছে। মিনু বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না।
রফিক বলল মিনু ঘুমিয়ে পড়েছ নকি?
মিনু সাড়া-শব্দ করল না। রফিক হালকা গলায় বলল, রূপা তোর ভাবির কাণ্ড দেখেছিস? ঘুম দিচ্ছে। এমন চমৎকার জোছনায় ঘুমিয়ে যাওয়া তো রীতিমতো ক্রাইম। শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রূপা বলল, আমার নিজেরও ঘুম পাচ্ছে ভাইয়া। কয়েকবার হাই তুলেছি। রফিক বলল, সবাই যদি ঘুমে কাতর হয়ে থাকে তাহলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়। চল যাই, ফেয়ারওয়েল টু দা মুন।
তুমি কী যেন বলবে বলছিলে?
তেমন জরুরি কিছু না। ইট কেন ওয়েট। তোর বিয়ের ব্যাপাবে কথা বলব বলে ভাবছিলাম।
ও।
খুব ভালো ছেলে পাওয়া গেছে। সবদিক মিলিয়ে ছেলে জোগাড় করা তো এখন ভয়াবহ সমস্যা। ছেলে দেখতে সুন্দর হলে স্বভাব-চরিত্র হয় মন্দ। টাকা-পয়সা থাকলে বিদ্যা-বুদ্ধি থাকে না। ভালো ছেলে হলে দেখা যায় বোকা ছেলে, মন্দ হবার মতো বুদ্ধি নেই বলে ভালো ছেলে হয়ে দিন পার করছে। তাছাড়া ভালো ছেলের কনসেপ্টও পাল্টে গেছে।
যাকে পেয়েছ সে-কি সব দিকে পারফেক্ট?
এখন পর্যন্ত তো তাই মনে হচ্ছে। তুই নিজে দেখ।
আমি নিজে কীভাবে দেখব?
ছেলেটাকে এখানে আসতে বলেছি। জহির চিটাগাং থেকে আসার সময় তাকে নিয়ে আসবে।
ও!
মনে হচ্ছে খুব উৎসাহ বোধ করছিস না। রূপা কিছু বলল না। রফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ছেলেটাকে আমি দেখেছি। কথা বলেছি। আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। চমৎকার ছেলে।
চমৎকার একটা ছেলে আমার মতো একটা গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করবে। কেন? বিয়ে করবে। কারণ তুইও চমৎকার একটা মেয়ে। ছেলেটা এখানে আসছে। তোর লজ্জায় লজ্জাবতী হয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। তোরা কথাবার্তা বলবি। গল্প করবি। ছেলেটাকে গ্রাম দেখাবি এতে দোষের কিছু নেই। বুঝতে পারছিস আমার কথা?
পারছি।
কিছু বলবি?
ভাইয়া, ধর আমার ছেলেটাকে পছন্দ হলো। ছেলেটার আমাকে পছন্দ হলো না। তখন?
তখন বিয়ে হবে না।
তখন কি আমার খারাপ লাগবে না?
রফিক কিছু বলার আগেই মিনু বলল, মোটেই খারাপ লাগবে না। কারণ তোমাকে যেই দেখবে সেই পছন্দ করবে। তুমি যে কী সুন্দর হয়েছ তা তুমি নিজেও জানো না।
রূপা বলল, তুমি জেগে ছিলে?
হ্যাঁ, জেগে ছিলাম। ঘুমের ভান করে দেখতে চাচ্ছিলাম তোমরা ভাইবোনরা কীভাবে কথা বলো।
কীভাবে বলি?
স্মাটলি বলো। সহজ স্বাভাবিক। লজ্জা-টজার কোনো বালাই নেই। শুনতে ভালোই লাগল। কে বলবে তুমি জীবন কাটিয়েছ গ্রামে।
রফিক বলল, চল উঠা যাক। আমারো ঘুম পাচ্ছে।
মিনু বলল, না তুমি আরো খানিকক্ষণ বস। রূপা চলে যাক। আমরা দুজন খানিকক্ষণ গল্প করি। আর রূপা শোন, জেবা বলছিল সে আজ রাতে তোমার সঙ্গে ঘুমোবে। সে হয়তো তোমার বিছানায় গম্ভীর মুখে বসে আছে। ও তোমার সঙ্গে ঘুমোলে অসুবিধা হবে না তো?
অসুবিধা কী।
মিনু দুঃখিত গলায় বলল, মাঝে মাঝে জেবা দুঃস্বপ্ন দেখে বিকট চিৎকার করে। ওর এই ব্যাপারটার সঙ্গে তুমি পরিচিত না। ভয় পেতে পোর।
আমি এত সহজে ভয় পাই না ভাবি।
রফিক ইতস্তত করে বলল, জেবার মধ্যে কিছু কিছু পাগলামি ভাব আছে। রূপা, তুই ওর কোনো কথায় বেশি গুরুত্ব দিবি না। যা বলে মেনে নিবি। ওকে নিয়ে আমরা একটু সমস্যায় আছি। ঢাকায় নিয়ে ডাক্তার দেখাব।
রূপা বলল, তোমরা শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছি। জেবা চমৎকার মেয়ে। দেখো অল্পদিনেই আমি ওকে ঠিকঠাক করে দেব।
জেবা এখনো ঘুমোয় নি।
একটা বালিশ কোলে নিয়ে পা তুলে বিছানায় বসে আছে। মানুষ না, যেন সুন্দর পাথরের একটা মূর্তি। রূপা বলল, কী-রে এখনো জেগে আছিস? শুয়ে পড়।
জেবা যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল। শীতল গলায় বলল, ফুপু আমাকে তুমি করে বলবেন। কেউ আমাকে তুই করে বললে ভালো লাগে না।
কণা হাসতে হাসতে বলল, আদর করে তুই বলছিলাম। আর বলব না। জেবা, তুই ছাড়া আর কোন কোন জিনিস তোমার ভালো লাগে না বলে ফেল তো, জেনে রাখি!
কেউ মিথ্যা কথা বললে আমার ভালো লাগে না।
আচ্ছা। ভুলেও আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। খুব সাবধানে থাকব।
কেউ গায়ে হাত দিয়ে আদর করলেও আমার ভালো লাগে না।
কখনো তোমার গায়ে হাত দিয়ে আদর করব না। তোমার কাছ থেকে সব সময় এক হাত দূরে থাকব। রাতে ঘুমোবার সময় যদি গায়ের সঙ্গে গা লেগে যায়। তাতে অসুবিধা নেই তো?
অসুবিধা আছে।
শোবার সময় রূপা একটা কোল বালিশ এনে দুজনের মাঝখানে রাখতে রাখতে বলল, এই কোল বালি, টা হচ্ছে আমাদের সীমানা। একপাশে থাকবে তুমি একপাশে আমি। এবাব ঠিক আছে। জেবা?
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
এখন আরাম করে ঘুমোও।
জেবা বলল, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে ফুপু।
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমাকেও আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি একটু অদ্ভুত! তাতে কী! অদ্ভুত মানুষই আমার ভালো লাগে। আমার একজন স্যার আছেন, তিনিও অদ্ভুত। আমি তাঁকেও খুব পছন্দ করি।
আমি জানি।
কীভাবে জানো?
জেবা অস্পষ্টভাবে হাসল, কিছু বলল না। রূপা বলল, তুমি তো আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না।
আমি সব প্রশ্নের জবাব দিই না।
প্রশ্নের জবাব না দেয়াটা তো অভদ্রতা।
প্রশ্ন করাও তো অভদ্রতা।
তা ঠিক। প্রশ্ন করার মধ্যেও এক ধরনের অভদ্রতা আছে।
জেবা বলল, ফুপু আপনি ইচ্ছা করলে আমার গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে পারেন। আমি রাগ করব না।
আচ্ছা, জানা রইল। এখন ঘুমাও।
আর আমি সব সময় আপনার দলে থাকব।
আমার দল মানে?
জেবা শান্ত গলায় বলল, এ বাড়িতে দুটো দল হবে। আপনার একাব একটা দল। আর বাকি সবাব একটা দল। অন্য দলটি চাইবে একটা ছেলের সঙ্গে আপনার বিয়ে দিতে। আপনি চাইবেন না…।
এই সব তুমি কী বলছ? এমন সব অদ্ভুত কথা তোমার মাথায় ঢুকল কীভাবে?
বলব না।
জেবা পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। রূপার ঘুম এলো না। এগারো বছরের এই বাচ্চা মেয়ে কী বলছে, কোথেকে বলছে? নিশ্চয়ই বড়দের কথা শুনে শুনে নিজের মনে একটা-কিছু দাঁড়া কবিয়েছে। শিশুদের মনেব জগৎ খুব সহজ নয়। নামান জটিল কর্মকাণ্ড সেই জগতে হয়। শিশুবা তার খবর কখনো বড়দেব বালে না।
প্রতি মাসের তিন তা বিখ নীলগঞ্জ হাইস্কুলের দপ্তরি কালিপদ বাড়ি ভাড়া বাবদ মবিনুর রহমানের কাছ থেকে একশটা টাকা পায়। টাকাটা নিতে কালিপদের খুবই লজ্জা লাগে। যি বাড়িতে তার মতো দরিদ্র ব্যক্তি নিজে থাকতে পারে না সেই বাড়ি ভাড়া বাবদ একশ টাকা নেয়া কি অন্যায় না? বাড়িটি মানুষ বাসের যোগ্য না। একটা মাত্র ঘর কোনো রকমে টিকে আছে। তারও কড়িবারগা ঝুলে আছে। যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পাবে। যদি ঘটে। সে কী জবাব দেবে? লোকে তো তাকেই ধরবে? হেড স্যার তাকে জিজ্ঞেস করবেন, কালিপদ তুমি জেনেশুনে এই বাড়ি কী করে ভাড়া দিলে? থানার বড় দারোগা সাহেবও তাকে থানায় ধরে নিয়ে যেতে পারেন।
ঘর যদি ভেঙে না-ও পড়ে, সাপেব কামড়েও তো মানুষটা, মরতে পারে। চারদিকে সাপ কিলবিল করছে। তার ছোট মেয়েটা মরুল সাপের কামড়ে।
কালিপদ অবশ্যি সাপের কথা মবিন স্যারকে বলেছে। তিনি উদাস গলায় বলেছেন, সাপ আছে থাক না। অসুবিধা কী? সাপদের ও তো বাঁচাব অধিকার আছে। ওরাও একটা প্রজাতি।
সারের কথাবার্তার ঠিক নেই। সাপ আর মানুষ এক হলো! সাপ কি স্কুলে পড়াশোনা করে? বিএ, এমএ পাস করে?
ত এই সব কথা স্যারকে কে বলবে? কালিপদের বলার ইচ্ছা করে। সাহসে কুলায় না। সার হচ্ছেন জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে সে মহামুর্থ দপ্তরি কী কথা বলবে? তবে একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে মবিন স্যারের সঙ্গে সব কথা বলা যায়। তিনি চুপ করে শোনেন। এমনভাবে শোনেন যেন খুব জ্ঞানী একজন মানুষের কথা শুনছেন। হেড স্যারের মতো কথার মাঝখানে ধমক দেন না। কথার মাঝখানে বলেন না–চুপ কর গাধা।
আজ মাসের সাত তারিখ। এ মাসের বাড়ি ভাড়া বাবদ একশ টাকা কালিপদ এখনো পায় নি। মবিন স্যার স্কুলে আসছেন না। অথচ টাকাটা তার বিশেষ প্রয়োজন। সে ঠিক করুল মবিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। টিফিন টাইমে হেড স্যারকে বলে ছুটি নেবে। তার ধারণা ছুটি চাইলে হেড স্যার না বলবেন না। কারণ তাঁর অনেক কাজ সে করে দেয়। গত মাসে হেড স্যার একটা দুধেল গাই কিনেছেন। সেই গাইয়ের জন্য ঘাস কেটে আনাব সব দায়িত্ব তার। এই দাযিত্ব সে নিঃশব্দে পালন করে। এমনভাবে করে যে তাকে দেখলে মনে হতে পারে এই দায়িত্ব পালন করতে পেরে সে বিমলানন্দ উপভোগ করছে। অবশ্যি কারো জন্যে কিছু করতে কালিপদের খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। মবিনুর রহমান স্যারের জন্যেও তার সব সময় কিছু করতে ইচ্ছা করে। এখন পর্যন্ত তেমন কিছু করার সুযোগ পায় নি।
টিফিন পিরিয়ডে কালিপদ হেড স্যাবের ঘরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। একজন জ্ঞানী মানুষকে নিজ থেকে কিছু বলা মুশকিল। হেড স্যার বললেন, কী ব্যাপার কালিপদ?
কালিপদ মাথা চুলকাতে লাগল।
কিছু বলবো?
একটা কাজ ছিল স্যার।
তোমার আবার কী কাজ? তোমার কাজ তো একটাই। স্কুলের বাবান্দায় হাঁটাহাটি করা।
কালিপদের মন খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের শতেক কাজ সে করে, তারপরেও কেউ যদি বলে তার কাজ শুধু হাঁটাহাঁটি কবা তাহলে মনে লাগারই কথা।
ছুটি চাও না-কি?
জি। টিফিন টাইমে চলে যাব।
টিফিন চাইমে চলে যাব? মামার বাড়ির আব্দার? স্কুলটা কী তোমার মামার বাংলা ঘর? যাও যাও বিরক্ত করবে না।
কালিপদ হতভম্ব হয়ে বের হয়ে এলো। আজ সকালেও সে হেড স্যারের একগাদা কাজ করেছে। হেড স্যারের গাইয়ের জন্যে ঘাস কেটে দিয়ে এসেছে। পুঁই গাছের জন্যে মাচা বেঁধেছে।
কালিপদ লক্ষ করল তার অসম্ভব রাগ হচ্ছে। রাগ হলেই তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। এখনো তার হাত-পা কাঁপছে সে রাগ কমানোর জন্য বড় একটা বালতি নিয়ে পানি আনতে রওনা হলো। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলে রাগ কমে যায়। হেড স্যার হচ্ছেন জ্ঞানী মানুষ, স্কুলের প্রধান। তার উপর রাগ করা উচিত না।
স্কুলের টিউব ওয়েলটা নষ্ট। অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়। টিউবওয়েলটা ঠিক করা উচিত। কেউ ঠিক করছে না। সামান্য একটা ওয়াসারের জন্য টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কালিপদ ঠিক করে ফেলল। ময়মনসিংহ যাওয়া হলে সে নিজেই একটা ওয়াসার কিনে আনবে। এতে একটা ভালো কাজ করা হবে। সে তার জীবনে ভালো কাজ কিছুই করে নি। কখন ডাক এসে যাবে কে জানে। চিত্রগুপ্ত খাতা খুলে বসে আছেন। ডাক এলেই হাজিরা দিতে হবে। যমরাজ বলবেন, ওহে কালিপদ, তুমি মর্ত্যধামে ভালো কর্ম কী কী করিয়াছ? সে তখন বলতে পারবে, স্যার স্কুলের টিউবওয়েলের জন্য একটা ওয়াসার কিনেছি।
ইহা ছাড়া অন্য কোনো সৎকর্ম কি আছে?
জি-না।
খারাপ কর্ম কী কী করিয়াছ?
খারাপ কাজ কিছু করি নাই স্যার।
এইটাই কালিপদের একমাত্র ভরসা।
সে খারাপ কিছু করে নি। করবেও না।
কালিপদ পানির ভারি বালতি স্কুলের বারান্দায় রাখতে রাখতে লক্ষ করল যে, তার রাগ কমে গেছে। সে স্বস্তি বোধ করল। রাগ বেশিক্ষণ পুষে রাখা ঠিক না। তাছাড়া হেড স্যার অনায্য কিছু বলেন নি। সত্যি তো স্কুল কি আর তার মামার বাড়ির বাংলা ঘর?
কালিপদ পানির বালতি রেখে মুড়ি কিনতে গেল। স্যারদের জন্যে টিফিন তৈরি হবে। এক সের মুড়ি, তিন ছটাক বাদাম। মুড়ি বাদাম, পেঁয়াজ, কাচামরিচ দিয়ে মাখানো হবে। খুব ঝাল হতে হবে। শিক্ষকরা টিফিন টাইমে তা খাবেন। তেল মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখানো কোনো জটিল কাজ না। বাদামের খোসা ছড়ানোর কাজটা জটিল। কালিপদের আঙুলে তেমন জোর নেই। ভারী কাজ করতে কষ্ট হয় না। কিন্তু বাদামেব খোসা ছাড়ানোর মতো ছোট কাজ করতে কষ্ট হয়।
কালিদেব মন এখন একটু বিষন্ন, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে একগাদা কঠিন কথা শুনতে হবে। স্যাররা যখন ঝালমুড়ি খান তখন কালিপদকে অনেক কথা শুনতে হয়।
যেমন–
লবণ দিয়ে তো বিষ বানিয়ে ফেলেছ। এতদিনেও মুড়ি বানানো শিখলে না।
বালি কিচকিচ করছে, ব্যাপারটা কী? এর মধ্যে খুব কম হলেও এক পোয়া বালি আছে।
নাতাচ্যাত মুড়ি কোথেকে কিনলে? মুড়িও চেন না?
এইসব কথার কোনো জবাব কালিপদ দেয় না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। শুধু দুজন লোক কখনো তাকে কিছু বলেন না। একজন মবিনুর রহমান, অন্যজন জালালুদ্দিন স্যার। মুড়ির বাটি জালাল স্যারের সামনে রাখা মাত্র তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ পাক তোমার ভালো করুন কালিপদ।
আজও তাই বললেন।
কালিপদ বলল, স্যারের শরীর ভালো?
হ্যাঁ, শরীর ভালো। মনটা ভালো না। শোন কালিপদ, তোমরা জন্য একটা চিঠি আছে।
কালিপদ বিস্মিত হয়ে বলল, চিঠি?
হুঁ। চিঠি। গতকাল মবিনের কাছে গিয়েছিলাম। সে তোমাকে চিঠি দিয়েছে। চিঠি পড়তে পোর?
জি স্যার, পারি। উনার শরীর কেমন?
বেশি ভালো না।
মুখ বন্ধ খাম নিয়ে কালিপদ আড়ালে সরে গেল। চিঠি পড়তে পারে কি-না এটা জিজ্ঞেস করায় সে মনে কষ্ট পেযেছে। স্কুলে চাকরি করে আর সে একটা চিঠি পড়তে পারবে না? ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। বাবা মরে যাওয়ায় আর পড়াশোনা হলো না। জালাল স্যার পুরনো লোক। উনি কেমন কবে এই ভুল করেন?
কালিপদ টিউবওয়েলের পাশে বসে পরপর চারবার চিঠিটা পড়ল।
কালিপদ,
অমি খুব লজ্জিত যে যথাসময়ে তোমাকে বাড়ি ভাড়া বাবদ একশ টাকা দিতে পারি নি। আমার মনে ছিল তবু দেয়া হয় নি। শরীর বিশেষ ভালো না বলে স্কুলে যাচ্ছি না। তোমার সঙ্গে দেখাও হচ্ছে না। তোমার অসুবিধা সৃষ্টি করায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এখন টাকাটা পাঠালাম।
ইতি
মবিনুর রহমান
কালিপদের চোখে পানি এসে গেল। মবিন স্যারের মতো একজন জ্ঞানী লোক বলছেন ক্ষমাপ্রার্থী। সে কে? সে কেউ না। সে একজন অধম দপ্তরি।
কালিপদ ঠিক কবে ফেলল। আজ সন্ধ্যায় স্যারকে দেখতে যাবে। খালি হাতে যাবে না। কিছু-একটা নিয়ে যাবে। পাকা পেঁপে, কলা। শরীব বেশি খারাপ দেখলে বাতে থেকে যাবে। যদিও ঐ মাডিতে থাকতে তার ভয় লাগে। সাপের ভয়। যত ভয়ই লাণ্ডক সে যাবে। হেড স্যারের গাইকে ঘাস এনে দিয়েই রওনা হবে।
সন্ধ্যাব পরপর কালিপদের যা য়া হলো না। কারণ হেড স্যার হঠাৎ সদরে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। তাঁর সুটকেস স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসতে হবে। স্টেশন এখান থেকে পাঁচ মাইলের মতো দূরে।
কালিপদ বিনা বাক্যব্যয়ে স্টেশনের দিকে রওনা হলো।
সদরে যাচ্ছি কেন জানিস না-কি কালিপদ?
জে না।
ডিইও সাহেব খবর পাঠিয়েছেন। মবিন সাহেবের গম চুরির ব্যাপারে কথা বলতে চান। ঘটনা শুনে উনি খুবই ক্ষিপ্ত। আমাকে বললেন–শুধু চাকরি থেকে ডিসমিস করলে এতবড় অপরাধের শাস্তি হয় না। অপরাধীকে জেলে ঢুকাতে হবে। আমি অবশ্যি বলেছি মানী লোক একটা ভুল করেছে। বাদ দেন। ডিইও সাহেব শুনতে চান না।
কালিপদ কিছু বলল না। গম চুরির কথা সে শুনেছে। একশ বস্তা গম স্কুলে দেয়া হয়েছিল। মবিন স্যার দস্তখত করে এনেছেন। কিন্তু একশ বস্তা না, এনেছেন মাত্র দশ বস্তা। এই নিয়ে মামলা-মোকদ্দমা হচ্ছে। স্বয়ং ভগবান যদি স্বৰ্গ থেকে নেমে এসে কালিপদকে বলেন–মবিনুর রহমান গম চুরি করেছে–কালিপদ বিশ্বাস করবে না। তবে তার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে কী যায় আসে? সে হলো মুর্থ দপ্তরি। স্কুলে ঘণ্টা দেয়া ছাড়া সে কিছুই জানে না।
কালিপদ!
জি স্যার।
মানুষের চেহারা দেখে বুঝা মুশকিল। তার ভেতরটা কেমন। মবিনকে দেখ কে বলবে–ভেতরে ভেতরে সে এত বড় শয়তান।
কালিপদ চুপ করে রইল। কথা বলার কোনো অর্থ হয় না।
ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। এইটাই নিয়ম। নিয়তি কঠিন জিনিস। নিয়তির হাত এড়ানো মুশকিল। লখিন্দরের নিয়তি ছিল সাপের হাতে মরা। মরাল কি-না বল। লোহার ঘর বানিয়ে লাভ হয়েছিল?
ট্রেন এলো রাত দশটায়। আটটায় আসার কথা–দুঘণ্টা লেট। এই দুঘণ্টা কালিপদ স্টেশনে বসে রইল। হেড স্যারকে রেখে চলে আসা যায় না। মালপত্র তুলে দিতে হবে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে এগারোটা বেজে গেল। এত রাতে মবিন স্যাবের কাছে যাওয়া ঠিক না। স্যার হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন। অসুস্থ মানুষ সকাল সকাল ঘুমোতে যাদ্ধার কথা।
তবু কালিপদ ভাবল, একবার যখন ঠিক করেছে যাবে–যাওয়াই উচিত।
স্যার ঘুমিয়ে থাকলে চলে আসবে। অসুবিধা তো কিছুই নেই।
মবিনুর রহমান ঘুমান নি। তিনি তাঁর দুরবিন ফিট করেছেন। দুরবিন তাক করা হয়েছে অনুরাধা নক্ষত্রেব দিকে। প্রাচীন ভারতে অনুরাধা একটি বিশেষ নক্ষত্র। তখন নিয়ম ছিল বিয়ের পর স্ত্রীকে সন্ধ্যাবেলা অনুরাধা নক্ষত্ৰ দেখিয়ে বলতে হবেঅনুরাধার মতো দৃঢ়চিত্ত ও পূত চরিত্রের হও। তারপরই শুধু স্ত্রীকে ঘরে নেয়া যাবে।
আগে নয়।
কালিপদ বলল, স্যার কী করেন?
মবিন সাহেব দুরবিন থেকে চোখ না। সরিয়েই বললেন, অনুরাধা নক্ষত্ৰ দেখি। খুব উজ্জ্বল নক্ষত্র। আলো স্থির হয়ে থাকে।
তিনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন কালিপদের জন্য অপেক্ষা কবছিলেন। রাতদুপুরে তার উপস্থিতি হওয়ায় মোটেই বিস্মিত হন নি।
কালিপদ!
জি স্যার।
দেখবে না-কি?
কী দেখব স্যার?
অনুরাধা নক্ষত্র। দেখ, এইখানে চোখ লাগাও। বাঁ চোখ বন্ধ করা।
কালিপদ দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থেকেও কিছুই দেখতে পেল না। মবিন সাহেব যখন বললেন, দেখা যাচ্ছে? কালিপদ শুধুমাত্র তাকে খুশি করার জন্য বলল, জি স্যার। বড়ই সৌন্দৰ্য।
হ্যাঁ, সুন্দর তো বটেই। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের পুরোটাই সুন্দর। প্রকৃতি অসুন্দর কিছু তাঁর জগতে স্থান দেন নি।
কালিপদ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, আপনার খাওয়া-দাওয়া হয়েছে স্যার?
না। রান্না কবি নি এখনো।
আপনি স্যার কাজ করেন, আমি রান্না করে ফেলি।
আচ্ছা।
ঘরে তেল মসলা আছে তো স্যার?
সব আছে। গতকাল বাজার কবেছি।
আপনার শরীর শুনেছিলাম খারাপ।
না। শরদি ঠিক আছে। মাঝে মাঝে শুযঙ্কর সব স্বপ্ন দেখি, তখন সব উলট-পালট হয়ে যায়।
কী দেখেন?
দেখি কয়েকটা বুড়ো মানুষ। এদের শরীর দেখা যায় না, শুধু মুখ দেখা যায়। এরা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
দেখতে কেমন স্যার?
লম্বা মুখ। সামান্য দাড়ি আছে…
বলতে বলতে মবিনুর রহমান অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, কালিপদ।
জি স্যার।
রূপাকে আজ পড়াতে যাওয়ার কথা ছিল, যেতে পারি নি। শবীরটা ভালো লাগছে। না। কয়েকদিন যাব না; আমি একটি চিঠি লিখে রেখেছি, তুমি মেয়েটাকে দিয়ে এসো। কাল ভোর বেলা দিলেই হবে।
জি আচ্ছা স্যার।
চিঠি খুব সাদামাটা–
রূপা, আমি কয়েকদিন আসতে পারব না। তুমি নিজে নিজে পড়। মন নানান কারণে অস্থির হয়ে আছে। একটু স্থির হলেই আসব।
চিঠি সাদামাটা হলেও কিন্তু সাদা নাটা নয়। চিঠির উল্টো পিঠে তিনি অসংখ্যাবার লিখেছেন–রূপা, রূপা। এর পেছনেও একটা লজিক আছে। বল পয়েন্টের কলমে কালি আটকে যাচ্ছিল, তিনি কলম ঠিক করার জন্যেই রূপা রূপা লিখেছেন। অন্য কিছুও লিখতে পারতেন। লিখেন নি কারণ চিঠিই যেহেতু রূপাকে লিখবেন সেহেতু তার নামই মনে এসেছে। আবার এও সত্যি যে, এই নামটাই তিনি অসংখ্যবার লিখতে চেয়েছেন। অজুহাত হিসেবে ভাবছেন কলমে কালি আটকে যাচ্ছে বলে অসংখ্যবার রূপার নাম লিখতে হয়েছে। কোনটা সত্যি কে জানে, হয়তো সবটাই সত্যি।
এই বিশেষ চিঠিটি রূপার হাতে আসার আধঘণ্টা আগে মজার একটা ব্যাপার হলো। জেবা এসে বলল, ফুপু, কিছুক্ষণের মধ্যে তুমি এমন একটা কিছু পাবে যে আনন্দে তোমার মরে যেতে ইচ্ছা করবে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হবে।
কী পাব?
কী পাবে তা জানি না, তবে কিছু-একটা পাবে।
রূপা বিরক্ত হয়ে বলল, কী যে অদ্ভুত কথা তুমি বলে।
তার কিছুক্ষণ পর কালিপদ চিঠিটা দিল। রূপার আনন্দে মরে যেতে ইচ্ছা করল। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করল। ইচ্ছা করল পৃথিবীর সব মানুষকে ডেকে বলে— দেখ, তোমরা দেখ, স্যার কতবার আমার নাম লিখেছেন।
রূপার চোখে পানি এসে গেছে। জেবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখ ভাবলেশহীন। তবে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
হেড মাস্টার হাফিজুল কবির
হেড মাস্টার হাফিজুল কবির সাহেব আজ একটু ব্যস্ত। ব্যস্ততার নানাবিধ কারণের একটি হচ্ছে নেত্রকোনা থেকে সিও রেভিন্যু এসেছেন গম চুরির তদন্তে। ভদ্রলোকের বয়স অল্প। নিতান্তই চেংড়া ধরনের। অল্পবয়স্ক অফিসাররা ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবে না। দশজনের কথা শুনতে চায় না। হুঁট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। গরম গরম কথা বলে। মানী লোকের মান রাখতে জানে না।
হাফিজুল কবির সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করছেন। সিও সাহেব স্কুলে পা দেয়ার পরপরই তাকে দৈ মিষ্টি দেয়া হয়েছে। চায়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। কালিপদ স্কুলের বারান্দায় কেরোসিন কুকারে চা বসিয়ে দিয়েছে। হাফিজুল কবির সাহেব এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এনে সিও সাহেবের সামনে রেখেছেন। তিনি প্যাকেট খুলে একটা সিগাবেটি ধরিয়েছেন। এটা আশার কথা। যদি বলতেন–সিগারেট কেন? তাহলে চিন্তার ব্যাপার হতো।
সিও সাহেব বললেন, গম চুরির ব্যাপারে আপনারা নিজেরা কোনো তদন্ত করেছেন?
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, জি না স্যার।
করেন নি কেন?
তদন্ত কমিটি কবা হয়েছে কিন্তু কমিটির বৈঠক বসে নি।
বৈঠক বসল না কেন?
সেটা স্যার আমি বলতে পারি না। আমি কমিটিতে নেই।
মবিন সাহেবকে কি আপনি সরাসরি জিজ্ঞেস করেছেন?
কী জিজ্ঞেস করব? আমি কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
গম চুরির বিষয়ে তাঁর কী বলাব আছে তা জানতে চেয়েছেন?
জি-না।
জিজ্ঞেস করেন নি কেন? মানী লোক।
জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগল।
ডাকুন, উনাকে ডাকুন। আমি জিজ্ঞেস করি…
উনি স্যার স্কুলে আসেন নি। কয়েকদিন ধরেই আসছেন না।
আই সি!
লজাতেই বোধহয় আসতে পারছেন না।
চুরি করবার সময় মনে ছিল না, এখন লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। শুনুন হেড মাস্টার সাহেব, অ্যাডমিনিষ্ট্রেশান খুব সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নিয়েছে। আপনি জানেন কি-না জানি না। জাতীয় দৈনিকে চিঠি ছাপা হয়েছে।
বলেন কী স্যার!
হেড মাস্টার সাহেব বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলেন। চিঠি ছাপার ব্যাপারটা তিনি খুব ভালোমতো জানেন। চিঠি তারই লেখা। নেত্রকোনা গিয়ে নিজের হাতে পোস্ট করেছেন। সব কটা দৈনিকে চিঠি দিয়েছিলেন। শুধু একটাতে ছাপা হয়েছে। হেড মাস্টার সাহেব বললেন, চিঠিতে কী লেখা সারা?
সিও সাহেব ব্রিফ কেইস থেকে খবরের কাগজ বের করে এগিয়ে দিলেন। বিরস মুখে বললেন, কাগজটা আপনার কাছে রেখে দিন। হেড মাস্টার সাহেব অনেকবার পড়া চিঠি আবারো পড়লেন–
সরিষায় ভূত
নেত্রকোনা নীলগঞ্জ হাই স্কুলে সম্প্রতি গম চুরির এক কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়াছে। উক্ত স্কুলের জনৈক প্ৰবীণ শিক্ষক স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত ১০০ বস্তা গমের মধ্যে ৯০ বস্তা গায়েব করিয়া দেন। এই ঘট বা অত্র অঞ্চলে তমুল আলোড়ন সৃষ্টি করিযাছে। যাহাদের হাতে শিশু-কিশোরদের নীতি শিক্ষাব দায়িত্ব ন্যস্ত তাহারা যদি চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হন তাহা হইলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী। জনগণের মনে আজ এই প্রশ্ন আলোড়িত হইতেছে।
জনৈক অভিভাবক
নীলগঞ্জ হাই স্কুল
হেড মাস্টার সাহেব শুকনো মুখে বললেন, পত্রিকায় খবর কে দিল?
সিও সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, পত্রিকায় খবং কে দিল এটা নিয়ে চিন্তা করে লাভ কী? আমরা অ্যাকশন কী নিয়েছি সেটা হলো কথা। ক্রিমিন্যাল কেইস করা হয়েছে?
জি-না স্যার। শুধু জিডি এন্ট্রি করেছি। কেইস করে দিন। মিস এপ্ৰোপ্রিয়েশন অব পাবলিক ফান্ড। সেটা কি স্যার ঠিক হবে?
অবশ্যই ঠিক হবে। এই সঙ্গে সাসপেনশন অর্ডার দিয়ে দিন।
সাসপেনশন?
হ্যাঁ।
স্কুলে স্যার ও-রকম ব্যবস্থা নেই।
ব্যবস্থা নেই, ব্যবস্থা করুন। স্কুলে গভর্নিং বডির মিটিং দিন। মিটিং-এ ডিসকাস করুন।
আপনি বললে অবশ্যই করব।
মনে রাখবেন, বর্তমান সরকার এ-জাতীয় কেলেংকারি সহ্য করবে না। দুনীতিমুক্ত সমাজ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। পত্র-পত্রিকায় চিঠি ছাপা হয়ে গেছে। জনমত তৈরি হয়ে গেছে। আর অবহেলা করা যায় না।
তা তো বটেই স্যার।
গভর্নিং বডির মিটিং ডাকুন। আজই ডাকুন।
জি আচ্ছা স্যার।
গভর্নিং বডির মিটিং-এ পত্রিকায় ছাপা চিঠি পড়া হলো। হেড মাস্টার সাহেব সিও বেভিনিউ সাহেব যা যা বলে গিয়েছেন সব আবারো বললেন এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কী করি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রাইভেট স্কুল হলেও সরকারি চাপ অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। আমরা গভর্নমেন্ট ডিএ নেই। ডিএ বন্ধ হয়ে গেলে স্কুল উঠিয়ে দিতে হবে। গভর্নিং বডির একজন মেম্বাব হলেন রূপার বাবা আফজাল সাহেব। তিনি বললেন, পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। মবিনুর রহমান এই কাজ করতে পাবেন না। কোথাও ভুল হয়েছে। অবশ্যই ভুল হয়েছে।
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, ভুল হবার কোনো ব্যাপার না। মবিন সাহেব সিগনেচার করে গম নিয়েছেন।
আত্মভোলা মানুষ। তাকে প্যাঁচে ফেলে আটকানো হয়েছে। এটা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না।
গমের দায়িত্ব তাহলে কে নিবে?
ঘণ্টাখানিক আলাপ-আলোচনা কবেও কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেল না। আফজাল সাহেব মন খারাপ করে ঘরে ফিরলেন। মবিনুর রহমানকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তিনি বুঝতে পারছেন মবিনুর রহমান কোনো-একটা চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে এই চক্রান্তে হেড মাস্টার সাহেবের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু কী ভূমিকা তা ধরতে পারছেন না। মবিনুব রহমানের সঙ্গে হেড মাস্টােব সাহেবেব কোনো শক্ৰতা থাকার কথা নয়। একদল মানুষ আছে যাদেব কখনো কোনো শত্রু তৈরি হয় না। মবিনুর রহমান সেই দলের মানুষ। কিন্তু এখানে তিনি কী করে ঝামেলায় জড়িয়ে গেলেন? এই ঝামেলা থেকে মুক্তিব উপাযই বা কী?
আফজাল সাহেবের মন-খারাপ ভাব বাসায় এসে কেটে গেল। কী কারণে মন খারাপ তাও পর্যন্ত মনে রইল না। তার মেজো ছেলে জহির এসেছে চিটাগাং থেকে। সঙ্গে তার বন্ধু তানভির। রাজপুত্রের মতো ছেলে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখতে হয়। ছেলের সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলেই তার মনে হলো যে ভাবেই হোক এই ছেলের সঙ্গে রূপার বিয়ে দিতে হবে। একে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। তিনি ঘাটে লোক পাঠালেন ভালো মাছের জন্যে। যাকে পাঠালেন তার উপর ঠিক ভরসা করতে পারলেন না। নিজেই খানিকক্ষণ পর রওনা হলেন। তানভির বলল, চাচা। আপনি যাচ্ছেন কোথায়?
মাছের জন্যে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে ঘাটে খুব ভালো মাছ পাওয়া যায়।
চাচা, আমি কি আপনার সঙ্গে যেতে পারি?
যেতে চাও?
অবশ্যই যেতে চাই।
রাস্তায় কিন্তু খুব কাদা।
তানভির হাসতে হাসতে বলল, আমি খালি পায়ে যাব।
ঘাট থেকে সবচে বড় চিতল মাছটি কেনা হলো; আফজাল সাহেব মাছের দাম
দিতে পারলেন না। তানভির দাম দিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে রাতে খাবার সময় তানভির বলল, আমি তো চিতল মাছ খাই না।
আফজাল সাহেব হতভম্ব হয়ে বললেন সে কী। চিতল মাছ খাও না তাহলে কিনলে কেন? ঘাটে আরো তো মাছ ছিল!
তানভির হাসতে হাসতে বলল, আমার পরিকল্পনা ছিল সবচে বড় মাছটি কিনিব। তাই কিনেছি। কিনেছি বললেই যে খেতে হবে সে রকম তো কোনো আইন নেই।
তানভিব হচ্ছে সেই ধরনের মানুষ যারা আশেপাশের সবাইকে মন্ত্ৰমুগ্ধ করে রাখতে পছন্দ করে। এবং অতি সহজেই তা পারে। রাত দশটায় সে ঘোষণা করল–ম্যাজিক দেখানো হবে। বাচ্চারা যারা এখনো ঘুমাও নি চলে এসো। বাচ্চা বলতে জেবা এবং রুবাবা। রুবালা ঘুমিয়ে পড়েছে। জেবা জেগে আছে। তবে সে কঠিন মুখে বলল, ম্যাজিক আমার ভালো লাগে না। আমি দেখব না। রূপাও বলল, তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, সে কিছু দেখবে না।
মিনু বলল, পাগলামি করো না তো রূপা। এসো। এমন চমৎকার একটা ছেলে আর তুমি মুখ শুকনো করে আছ? কী কাণ্ড! শাড়ি বদলে একটা ভালো শাড়ি পর।
রূপা বলল, বেনাবসি পরব?
বেনারসি তো পরবেই। কয়েকটা দিন পর। আপাতত সুন্দর একটা শাড়ি পাব। নীল সিস্কের শাড়িটা পর।
নিজেকে সুন্দর কবে সাজিয়ে দেখতে যাব?
সাজা তো অপরাধ না।
আমার ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া ভাবি বিশ্বাস কর, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
এসে তো তুমি। আমাদের তরুণ মাজিসিয়ান সাহেব তোমার মাথা ধরা সারিয়ে দেবেন। আর যদি সারাতে না পারেন তাহলে আমার কাছে অ্যাসপিরিন আছে।
গ্ৰহরা যেমন নক্ষত্ৰকে ঘিরে রাখে তানভিরকে তেমনি সবাই ঘিরে আছে। আসরের মধ্যমণি হয়ে সে বসে আছে নক্ষত্রের মতোই। তার সামনে একটা খবরের কাগজ। এই কাগজ দিয়েই ম্যাজিক দেখানো হবে। আপাতত গল্প-গুজব হচ্ছে। কথক তানভির একা। বাকি সবাই মুগ্ধ শ্রোতা। রূপা শাড়ি বদলেছে। চুল বেঁধেছে। মিনু খুব হালকা করে রূপার চোখে কাজলও দিয়েছে। তার প্রয়োজন ছিল না। রূপাকে এমনিতেই ইন্দ্রাণীর মতো দেখায়।
তানভিরের গল্প বলার কৌশল চমৎকার। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যাচ্ছে। এত সহজে যে মাঝে মাঝে মনে হয় সব গল্প বোধহয় সাজানো। নম্বর দেয়া আছে কোন গল্পের পর কোনটি বলা হবে। সে রূপার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘদিনের চেনা মানুষের মতো বলল, রূপা তুমি কি মোনালিসার ছবি দেখেছ?
রূপা হকচকিয়ে গেল। নিতান্ত অপরিচিত একজন মানুষ পরিচিতের ভঙ্গিতে কথা বললে হকচকিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দেখেছ মোনালিসার বিখ্যাত ছবি?
জি।
অরিজিনাল নিশ্চয়ই দেখ নি–রিপ্ৰডাকশান দেখেছি। দেখারই কথা। পৃথিবীর অন্য কোনো ছবি এত খ্যাতি পায় নি। এত লক্ষ কোটি বার অন্য কোনো ছবির রিপ্রডাকশনও হয় নি। বলা যেতে পারে মোনালিসা হচ্ছে এই পৃথিবীর সবচে খ্যাতনামা মহিলা। অফকোর্স ছবির মহিলা। এখন বলো দেখি এই মহিলার বিশেষত্ব কী?
চোখ।
উঁহু, চোখ না। যদিও সবাই চোখ চোখ বলে মাতামাতি করে। তবু আমার মনে হয়। অন্য কিছু। কী তা-কি জানো?
না।
মোনালিসার ভুরু নেই। এই জগদ্বিখ্যাত মহিলার জগদ্বিখ্যাত চোখের ভুরু নেই। কী, ব্যাপারটা অদ্ভুত না?
রূপা কিছু না বললেও মনে মনে স্বীকার করল ব্যাপারটা অদ্ভুত। তানভির হাসতে হাসতে বলল, আমার কথা বোধহয় ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। আচ্ছা, আমি হাতে-নাতে প্রমাণ করে দিচ্ছি। আমার মানিব্যাগে মোনালিসাব পাসপোর্ট সাইজের একটা ছবি আছে।
তানভির মানিব্যাগ থেকে ছবি বের করল। ছবি সবার হাতে হাতে ফিরছে। সবাই চোখ কপালে তুলে বলেছে–তাই তো! তাই তো। রূপাব একটু মন খারাপ লাগছে। কারণ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে এই মানুষটির প্রতিটি গল্প সাজানো। সাজানো বলেই মানিব্যাগে মোনালিসার ছবি রেখে দেয়া।
আচ্ছা, এখন শুরু হবে ম্যাজিকের খেলা। এখানে একটা খবরের কাগজ আছে। সবার সামনে কাগজ কেটে আমি দুখণ্ড করব, তারপর জোড়া দেব।
জহির বলল, আমি কাটতে পারি? না-কি ম্যাজিসিয়ানকেই কাটতে হবে?
যে কেউ কাটতে পারবে।
মিনু বলল, রূপা কাটুক, রূপা।
রূপা কাগজ কাটল। কাটা কাগজ রুমাল দিযে। ঢাকা হলো। রূপা ভেবেছিল রুমাল উঠাবার পর দেখা যাবে কাগজ জোড়া লেগেছে। রুমাল উঠাবার পর দেখা গোল কাগজের টুকরোগুলো নেই। সেখানে সুন্দর একটা কাগজের ফুল। সোবাহান সাহেবের মতো মানুষও চেচিয়ে বললেন, অপূর্ব, অপূর্ব অপুর্ব!
আসর ভাঙল রাত বারোটায়। রূপা ঘুমোতে গিয়ে দেখল জেবা এখনো জেগে।
মশারি ফেলে মশারির ভেতর চুপচাপ বসে আছে। রূপা বিক্ষিত হয়ে বলল, এখনো জেগে?
হুঁ।
কেন?
ঘুম আসছে না?
না।
রূপা হালকা গলায় বলল, আমরা সুন্দর ম্যাজিক দেখলাম। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলে তোমারও ভালো লাগত। এসো এখন ঘুমানো যাক। ঘুমানোর আগে কি পানি খাবে? বাথরুমে যাবে?
না।
বাতি নিভিয়ে রূপা মশারির ভেতর ঢুকতেই জেবা বলল, ফুপু ঐ লোকটা তোমাকে পছন্দ করেছে। খুব বেশি পছন্দ করেছে। এখন সবাই মিলে ঐ লোকটার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে।
রূপা হালকা গলায় বলল, দিলে দিবে। কী আর করা।
জেবা রূপার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, এখন থেকে এই বাড়িতে দুটা দল হলো। ঐ লোকটাব একটা দল। সবাই সেই দলে। আর তোমার একার একটা দল। তোমাল দলে শুধু আছি আমি একা।
রূপা বলল, কী সব অদ্ভুত কথা যে তুমি বলো। এখন ঘুমাও তো।
জেলা বলল, আমি মোটেও অদ্ভুত কথা বলছি না। আমি যে অদ্ভুত কথা বলছি না তুমি তাও জানো। খুব ভালো করে জানো।
কাঁপা বলল, ঘুমাও তো জোরা। প্লিজ ঘুমানোর চেষ্টা করি!
আচ্ছা।
জেবা পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। রূপা ঘুমোতে পারল না। রাত জাগা তার অভ্যাস হয়ে ছে? জেগে থাকতে খারাপও লাগছে না। তক্ষক ডাকছে। গভীর বাতে তক্ষকগুলি অন্যািরকম কবে ডাকে। দিনে তাদের ডাক এক রকম, বাতে অন্য রকম। স্যারকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। উনি নিশ্চয়ই চমৎকার কোনো ব্যাখ্যা দেবেন। স্যারকে একটা ধাঁধাও জিজ্ঞেস কবিতে হবে। তব্দে ধাঁধা জিজ্ঞেস করলে উনি খানিকটা হকচকিয়ে যান এবং এমন অস্থিবি বোধ করেন যে রূপারই খারাপ লাগে। একবার সে স্যারকে জিজ্ঞেস করল, স্যার বলুন তো এটা কী–আমবাগানে টুপ করে শব্দ হলো। একটা পাকা আম গাছ থেকে পড়েছে।
যে দুজন শুনল সে দুজন গেল না।
অন্য দুজন গেল।।
যে দুজন গেল সে দুজন দেখল না।
অন্য দুজন দেখল।।
যে দুজন দেখল সে দুজন তুলল না।
অন্য দুজন তুলল।।
যে দুজন তুলল সে দুজন খেল না।
অন্য দুজন খেল।।
স্যার এখন বলুন ব্যাপারটা কী? তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। করুণ গলায় বললেন–ব্যাপারটা তো মনে হচ্ছে খুব জটিল।
মোটেই জটিল না স্যার। অত্যন্ত সহজ।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, জটিল জিনিসের ব্যাখ্যা খুব সহজ হয়। সহজ জিনিসের ব্যাখ্যাই জটিল।
রূপার মনে হলো স্যারের কথাটা তো খুব সত্যি। ভালোবাসা ব্যাপারটা অত্যন্ত সহজ কিন্তু ব্যাখ্যা কি অসম্ভব জটিল না?
তক্ষক ডাকছে। জেগে আছে রূপা। আজ রাতটাও মনে হচ্ছে তাকে জেগেই কাটাতে হবে।
কিছু-একটা হয়েছে রূপাদের বাড়িতে
কিছু-একটা হয়েছে রূপাদের বাড়িতে।
সবার মুখ হাসি হাসি। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। বড় ধরনের আনন্দের কোনো ঘটনা। এ-বাড়িতে ঘটে গেছে কিংবা ঘটতে যাচ্ছে। তবে এই ঘটনা নিয়ে কেউ আলোচনা কবীতে চাচ্ছে না। আলোচনা করতে না চাইলেও রূপার ধারণা সে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছে।
বিকেলে মিনু বলল, বরূপা শুনে যাও তো। এসো আমার সঙ্গে।
কোথায়?
ছাদে।
কোনো গোপন কথা?
গোপন কথা কিছু না, প্রকাশ্য কথা–ছাদে তোমার চুল বাঁধতে বাঁধতে বলব।
রূপা ছাদে গেল। মিনু তার চুল বাঁধতে বাধতে বলল, তানভিব জায়গাটা ঘুবে ফিরে দেখতে চায়। তুমি তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোবে।
এটাই তোমার প্রকাশ্য কথা?
না এটা প্রকাশ্য কথা না। প্রকাশ্য কথা হলো–তানভির কাল রাতে মুজিকের আসর শেষ হবার পরে তোমার ভাইয়াকে বলেছে–সে তোমাকে পছন্দ করেছে। শুধু পছন্দ না, অসম্ভব পছন্দ করেছে।
ও আচ্ছা!
ঘটনা এইখানেই শেষ না। আজ ভোরে সে বলেছে, সে এই বাড়িতেই তোমাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর বউ নিয়ে চলে যাবে।
এত তাড়া কেন?
তাড়া না। কথা এমনই ছিল। সে খুব খেয়ালি ছেলে। আমাদের এখানে আসার আগে তার বাবা তোমার মেজো ভাইকে খবর দিয়ে নিয়ে যান এবং বলেন–আমার ছেলে যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করে ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। এই ছেলে বড় যন্ত্রণা করছে। কিছুতেই তাকে বিয়ে করাতে রাজি করানো যাচ্ছে না।
রূপা বলল, বিয়েটা হচ্ছে কবে? আজই না-কি?
বিয়ে দিয়ে দেয়া। তা তো সম্ভব না। সবাইকে খবর দিতে হবে। ছেলের আত্মীয়স্বজনদের জানাতে হবে। দিন সাতেক তো লাগবেই।
এই সাতদিন আমি ভদ্রলোককে নিয়ে গ্রাম দেখাব, নদী দেখাব?
হ্যাঁ, বন্ধুর মতো পাশাপাশি থাকবে। প্ৰেম প্রেম খেলবে।
রূপা সহজ গলায় বলল, আচ্ছা।
মিনু বলল, তোমার ভাগ্য দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে রূপা।
রূপা বলল, আমার নিজেরই ঈর্ষা হচ্ছে, তোমার তো হবেই। আমি বৃশ্চিক রাশির মেয়ে। বৃশ্চিক রাশির মেয়েদের ঈর্ষা না করে উপায় নেই। এরা হয় খুব উপরে উঠবে। কিংবা ধুলার সঙ্গে মিশে যাবে। এদের কোনো মধ্যম পন্থা নেই।
কে বলেছে?
রাশিচক্র বলে একটা বই পড়ে সব জেনে বসে আছি।
রূপা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। এই হাসি মিনুর ভালো লাগল না। তবে সে সাজগোজ করতে মোটেই আপত্তি করল না। আকাশী রঙের একটা শাড়ি পরল। যা কখনো করে না। তাই করল, মার কাছ থেকে চেয়ে গয়না পরল। দীর্ঘ সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। জেবা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। জেবাকে বলল, কেমন দেখাচ্ছে জেবা?
জেবা হাসল। জবাব দিল না।
বলো তো আমাকে ইন্দ্ৰাণীর মতো লাগছে কি-না?
জেবা এই প্রশ্নোবও জবাব দিল না। আবারো হাসল। যেন সে রূপার ছেলেমানুষিতে খুব মজা পাচ্ছে।
রাস্তায় নেমেই রূপা বলল, আপনি কোন দিকে যেতে চান?
তানভির বলল, যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে যেতে পারি।
নদী দেখবেন? নদী?
অবশ্যই নদী দেখব? বাঙালি ছেলে হয়ে নদী দেখব না, তা-কি হয়!
হাঁটতে হবে কিন্তু। হাঁটতে হলে হাঁটব। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ঢাকা থেকে হেঁটে মানিকগঞ্জ গিয়েছিলাম। ননস্টপ হাঁটা। পথে একবার শুধু একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খেয়েছি। ভালো কথা রূপা, চা ভর্তি একটা ফ্লাঙ্ক সঙ্গে নিলে হতো না? নদীর তীরে বসে চা খাওয়া যেত।
আমি আপনাকে চা খাওয়ার ব্যবস্থা করব।
কীভাবে করবে?
আমি যেখানে আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি। সেখানে আমার এক স্যারের বাসা। স্যারের বাসা থেকে চা বানিয়ে আনব। ঘাটে স্যারের একটা নৌকা আছে। সব সময় নৌকা বাধা থাকে। ঐ নৌকায় বসে চা খাব।
ব্ৰিলিয়ান্ট আইডিয়া।
আপনি নৌকা বাইতে পারেন?
পারি না, তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি। নৌকা চালানো খুব কঠিন হবার কথা না; নৌক তো এরোপ্লেন না।
নৌকা চালানো যথেষ্টই কঠিন। এরোপ্লেন চালানোবা জন্যে কত যন্ত্রপাতি আছে। বোতাম টিপলেই হলো। নৌকার তো কোনো বোতাম নেই।
তানভিরের কাছে মেয়েটিকে আজ অন্য রকম লাগছে। স্মাট একটি মেয়ে যে কথার পিঠে কথা বলতে পারে এবং গুছিয়ে বলতে পারে। মেয়েটি বড় হয়েছে গ্রামে অথচ কত সহজ ভঙ্গিতে হাঁটছে। গল্প করছে। বিন্দুমাত্র আড়ষ্টতা নেই।
রূপা বলল, আমার স্যারকে দেখে আপনি অবাক হয়ে যাবেন।
কেন বলে তো?
খুবা জ্ঞানী মানুষ। সন্ন্যাসীদের মতো। চিরকুমার।
তানভির সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, কিছু কিছু মানুষ আছে টাকা-পয়সাব অভাবে এবং সাহসের অভাবে বিয়ে করতে পারে না। তারা হয়ে যায় চিবকুমাব। কিছু কিছু পাগলামি তাদের মধ্যে চলে আসে। এইসব দেখতে আমাদের ভালো লাগে। এর বেশি কিছু না।
স্যারের মধ্যে কোনো পাগলামি নেই। তার একটা টেলিস্কোপ আছে। তিনি এই টেলিস্কোপ দিয়ে রাতের পর রাত তারা দেখেন।
এটাই কি পাগলামি না? তিনি নিশ্চয়ই এষ্ট্ৰনমার না বা এসট্রো ফিজিসিষ্ট না। হিসাব নিকাশ করছেন না, তারাদেব গতিপথ বের করছেন না। শখের বসে আকাশ দেখছেন। সেটা তো একবার দেখলেই হয়। রাতের পর রাত হী করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন কী?
রূপা হেসে ফেলল।
তানভির বিস্মিত হয়ে বলল, হাসছ কেন?
আপনি কেমন রাগ করছেন তাই দেখে হাসছি। যে মানুষটিকে আপনি এখনো দেখেন নি। তার উপর রাগ করছেন কেন?
তার উপর রাগ করছি না। তোমার বিচার-বিবেচনা দেখে রাগ করছি। তোমাদের মতো ব য়েসী মেয়েদের এই সমস্যা। তারা অতি অল্পতেই অভিভূত। একজন হয়তো কবিতা লেখে। তার মাথাভর্তি লম্বা চুল। ময়লা পাঞ্জাবি পরে উদাস মুখে ঘুরে বেড়ায়। তার একটি কবিতা না পড়ে শুধুমাত্র তাকে দেখেই তোমরা অভিভূত হয়ে যাবে। চোখ বড় বড় করে কাঁপা কাঁপা গলায় বলবে, কবি, কবি!
রূপা খিলখিল করে হেসে ফেলল।
তানভিরও হাসল। হাসতে হাসতে বলল, লর্ড বায়রনের কথা তুমি জানো কি-না জানি না। বড় কবি। ইংল্যান্ডের সব তরুণী কবিতা না পড়েই এই মানুষটার জন্যে পাগল হয়ে গিয়েছিল। অথচ মানুষটা ছিলেন খোড়া, তিরিক্ষি মেজাজ। কেউ তাঁর দিকে তাকালেই রেগে যেতেন। তিনি বিয়ের দুঘণ্টা পর নববধূকে কাছে ডেকে বললেন, এই শোন, তোমাকে আমি কেন বিয়ে করেছি। জানো? তোমাকে আমি অসম্ভব ঘৃণা করি বলেই বিয়ে করেছি।
রূপা বলল, বায়রনের কোনো কবিতা কি আপনার জানা আছে?
না। তুমি পড়তে চাইলে জোগাড় করে দেব। অনেক দূর এসে পড়েছি বলে মনে হচ্ছে। আব কতক্ষণ?
ঐ যে ভাঙা বাড়িটা দেখছেন–ঐ টা।
তানভির বিস্মিত হয়ে বলল, এ বাড়ি তো যে-কোনো মুহুর্তে ভেঙে মাথার উপর পড়বে। কোনো বুদ্ধিমান প্ৰাণী এই বাড়িতে বাস করতে পারে না। অসম্ভব!
তানভিাবের কথা ভুল প্রমাণ করে ভাঙা বাড়ির ভেতর থেকে মবিনুর রহমান বের হয়ে এলেন এবং নিতান্তই সহজ গলায় বললেন, রূপা আসা। যেন তিনি রূপার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন।
রূপা বলল, স্যার ইনি মেজো ভাইয়ের বন্ধু। আমাদের এখানে বেড়াতে এসেছেন। গ্রাম দেখতে বের হয়েছেন।
মবিনুর রহমান বললেন, আসুন, ভেতরে আসুন।
তানভির কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বইলি। রূপা বলল, স্যার আপনার নৌকাটা কি ঘাটে আছে?
হ্যাঁ আছে।
আমরা আপনার নৌকান্য বসে চা খাব। ঘরে চা পাতা আছে স্যার?
আছে, চা পাতা আছে। তবে চিনি নেই। গুড় দিয়ে চা খেতে হবে। তোমরা নৌকায় গিয়ে বাস, আমি চা বানিয়ে আনছি।
আপনাকে চা বানাতে হবে না স্যার। আমি বানাব। কোনটা কোথায় আছে আপনি শুধু দেখিয়ে দেবেন।
রূপা চা বানাতে বসল। তানভির মবিনুর রহমানের পাশে একটা চৌকিতে বসল। সে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে বাড়ির ছাদ ভেঙে মাথায় পড়বে। তবে আরো আগে যে চৌকিতে বসেছে সেই টোকিও ভেঙে টুকরো টুকরো হবে। মটমট শব্দ করছে।
তানভির বলল, রূপা বলছিল। আপী-। না-কি টেলিস্কোপ দিয়ে সারারাত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন?
মবিনুর রহমান নিচু গলায় বললেন, এটা আমার একটা শখ। তবে সবদিন দুরবিন নিয়ে বসি না। আকাশ যখন পরিষ্কার থাকে তখন বসি।
কী দেখেন।
তারা দেখি?
একই তারা বারবার দেখতে ভালো লাগে?
জি লাগে। তারা দেখি আর ভাবি।
কী ভাবেন?
বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ড কী করে তৈরি হলো তাই ভাবি।
আপনার এই ভাবনা তো পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই ভেবে রেখেছেন। বিগ বেংগ-এর ফলে ইউনিভার্সের সৃষ্টি।
এটা নিয়েই ভাবি। বিগ বেংগের আগে কী ছিল? অনন্ত শূন্য ছিল? যদি তাই থাকে তাহলে তো বিগ বেংগ-এর ফলে ইউনিভার্স সৃষ্টি হতে পারে না।
অসুবিধা কোথায়?
তাহলে ধরে নিতে হবে থার্মোডিনামিক্সের প্রথম সূত্র কাজ করছে না। তা তো হয় না। প্রকৃতি তার নিজের নিয়ম কখনো ভঙ্গ করে না।
আপনি তা কী করে জানেন?
কেন জানব না? আমিও তো প্রকৃতিরই অংশ।
আপনার দুরবিনটা কি খুব ভালো দুরবিন?
জি। শনি গ্রহের বলয় পরিষ্কার দেখা যায়। এক রাতে সময় করে আসুন। আপনাকে 6थींद।
এখানে আসতে খুব ভরসা পাচ্ছি না। বাড়ির যা অবস্থা। যে কোনো মুহৰ্তে ছাদ মাথার উপর ভেঙে পড়বে বলে মনে হচ্ছে–তাছাড়া আমার কেন জানি মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে বিষাক্ত সাপ আছে। ভাঙা বাড়ি সাপদের খুব প্রিয়।
মবিনুর রহমান সহজ গলায় বললেন, সাপ আছে ঠিকই। দুটো চন্দ্রবোড়া সাপ পাশের ঘরে থাকে।
সাপ আপনি টেনেন? চন্দ্ৰবোড়া বুঝলেন কী করে?
অনুমানে বলছি। সব সাপ ডিম দেয়। এই সাপটা সরাসরি বাচ্চা দিয়েছে। একমাত্র চন্দ্রবোড়াই সরাসরি বাচ্চা দেয়। একত্ৰিশটা বাচ্চা দিয়েছে।
বসে বসে গুনেছেন?
জি না। একদিন বারান্দায় বসে ছিলাম। দেখলাম, সাপটা বাচ্চাগুলি নিয়ে বের হয়েছে। তখন গুনলাম।
একত্ৰিশটা সাপের বাচ্চা এবং দুটা সাপ নিয়ে বাস করতে আপনার ভয় লাগে না?
একটু লাগে। রাতে আমি ঘরে থাকি না। নৌকায় ঘুমাই। তবে আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। আমরা সহাবস্থান নীতি গ্ৰহণ করেছি। আমি ওদের কিছু বলি না। ওরাও আমাকে কিছু বলে না। ওরা আমার গায়ের গন্ধ চেনে। আমিও ওদের গায়ের গন্ধ চিনি। আগেভাগেই সাবধান হয়ে যাই।
চা তৈরি হয়ে গেছে। মবিনুর রহমান ফ্রাঙ্ক এনে দিলেন। ফ্লাঙ্ক-ভর্তি চা নিয়ে তিনি নৌকায় রাত্রিযাপন করেন। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন, খাবার-দাবার তো কিছু নেই রূপা। মুড়ি আছে। মুড়ি নিয়ে যাবে?
হ্যাঁ নিয়ে যাব। আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।
রূপা, তানভিরকে নিয়ে নৌকায় উঠে খুশি খুশি গলায় বলল, সুন্দর না?
তানভির বলল, অবশ্যই সুন্দর। নৌকায় বসে চা খাওয়ার এই আইডিয়া অসাধারণ আইডিয়া। আমরা রোজ এখানে আসব। নৌকা চালানো শিখে নেব।
নদীতে কিন্তু খুব স্রোত।
হোক স্রোত। স্রোত কোনো সমস্যা না।
গুড়ের চা কেমন লাগছে?
অসাধারণ লাগছে। এই পরিবেশে সবকিছুই অসাধারণ লাগে।
আমার স্যারকে আপনার কেমন লাগল?
ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার। তবে এই জাতীয় ক্যারেক্টর আমি আগেও দেখেছি। এরা কিছুটা অদ্ভুত। তবে যতটা না অদ্ভুত মানুষের কাছে তারা নিজেদের তার চেয়েও অদ্ভুত করে তুলে ধরে।
রূপা বলল, স্যার সম্পর্কে আমি আপনাকে খুব-একটা গোপন কথা বলতে পারি। বলব?
বলো!
কাউকে কিন্তু বলতে পারবেন না। অসম্ভব গোপন ব্যথা, পৃথিবীব কেউ জানে না। আমি কাউকে বলি নি। শুধু আপনাকে বলব, তবে কথা দিতে হবে আপনি কাউকে বলবেন না।
অবশ্যই আমি কাউকে বলব না।
কথাটা কী জানেন? স্যারকে আমি পাগলের মতো পছন্দ করি। সব সময় আমি উনার কথা ভাবি। রাতের পর রাত আমি ঘুমোতে পারি না। আমি ঠিক করেছি যেভাবেই হোক তাকে বিয়ে কবব। বাকি জীবন কাটিয়ে দেব তার সেবা করে।
তানভির অবাক হয়ে রূপার দিকে তকয়ে রইল। তার চোখ হয়েছে মাছের চোখের মতো। চোখে পলক পড়ছে না।
রাতের খাবার দেয়া হয়েছে
রাতের খাবার দেয়া হয়েছে।
রূপা বলল, আমি আগে আগে খোশ, নেব। আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে। মিনু বলল, তুমি আমার সঙ্গে খাবে রূপা। সেকেন্ড ব্যাচে।
ভাবি তুমি তো খাও থার্ড ব্যাচে। রাত এগারোটা বাজে খেতে খেতে।
আজ তুমিও রাত এগারোটায় খাবে। এসো আমার ঘরে। তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কিছু কথা আছে।
ক্ষিধেয় তো মরে যাচ্ছি ভাবি।
মিনু গম্ভীর গলায় বলল, মানুষ এত সহজে মরে না রূপা।
রূপা মিনুর ঘরে ঢুকল। ভাবি কী বলবেন তা সে আঁচ করতে পারছে। তানভিব সব কিছুই প্ৰকাশ করেছে। সে নিশ্চয় জনে জনে বলে নি। প্রথমে বলেছে ভাইয়াকে, সেখান থেকে শুনেছে ভাবি, ভাবির কাছ থেকে শুনেছে মা। মার কাছ থেকে বাবা। সবাই অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকে দেখছে। বাবা তখন থেকে বাবান্দায় বসে আছেন। বাবার এমন গম্ভীর মুখ সে এর আগে কখনো দেখে নি।
মিনু ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। রূপা বলল, দরজা বন্ধ করছ, কেন ভাবি?
তোমার সঙ্গে যে-বিষয় নিয়ে কথা বলব আমি চাই না তা কেউ শুনুক, এই জন্যেই দরজা বন্ধ করছি। তুমি পা তুলে আরাম করে বিছানায় বস।
রূপা তাই করল। মিনু বলল, তুমি তানভির সাহেবকে কী বলেছ?
অনেক কিছুই তো বলেছি। তুমি কোনটা জানতে চাচ্ছি?
অনেক কিছু মানে কী?
অনেক কিছু মানে অনেক কিছু। আমি প্রচুর বকবক করেছি।!
তুমি যে প্রচুর বকবক করেছ তা বুঝতে পারছি। বকবক করতে গিযে ভয়ঙ্কর সব কথা বলেছ।
আমি কোনো ভয়ঙ্কর কথা বলি নি।
অবশ্যই বলেছি–তুমি কি বলে নি যে ঘাটের মরা ঐ বুড়ো মাস্টার সাহেবের প্রেমে তুমি হাবুড়ুবু খাচ্ছ?
বলেছি।
মিনু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি তুমি ঠাট্টা করে বলেছ। আমিও তানভিব সাহেবকে তাই বললাম। কিন্তু রূপা এই জাতীয় ঠাট্টা কবা কী উচিত? তানভির সাহেব বুদ্ধিমান মানুষ। তাকে যখন বলেছি–রূপা, ঠাট্টা করেছে, তিনি একসেপ্ট করেছেন। অন্য কেউ তো তা কববে না।
রূপা বলল, তোমাদের তানভিব সাহেব মোটেই বুদ্ধিমান নন। বুদ্ধিমান হলে তিনি বুঝতে পারতেন আমি তাঁর সঙ্গে মোটেই ঠাট্টা করি নি।
কী বলছ তুমি রূপা?
সত্যি কথা বলছি ভাবি।
সত্যি কথা বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি কথা বলছি।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
হ্যাঁ ভাবি মাথা খারাপই হয়েছে। অব কিছু বলবে?
মিনু বলার মতো কিছু পেল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রূপা বলল, তুমি কি আরো কিছু বলবে?
বলব।
বলো, আমি শুনছি…।
মিনু কিছু বলতে পারল না, কারণ তার মাথা পুরোপুরি গুলিয়ে গেছে। মাথায় কোনো কিছুই আসছে না। রূপাকে দেখে এখন তার মনে হচ্ছে কিছু বলে লাভ নেই। এই মেয়েটি এখন আর কিছুই শুনবে না। সে বাস করছে অন্য জগতে।
রূপা বলল, ভাবি, আমি এখন যাই। তুমি আমাকে কী বলবে ভেবে ঠিকঠাক করে রাখ। পরে শুনব।
বাইরের ঘরের বারান্দায় তানভির হাঁটাহঁটি করছে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগাবেট। বাবান্দা অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জ্বলন্ত সিগারেটের উঠানামা থেকে বোঝা যায় এখানে একজন মানুষ আছে যে বারান্দার এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যাচ্ছে।
কাঁপা বারান্দায় এসে তীক্ষ্ণ গলায় ডাকল, একটু শুনে যান তো! তানভির এগিয়ে এলো। রূপা বলল, আপনাকে বলেছিলাম কাউকে কিছু না বলতে। আপনি সবাইকে বলে বেড়িয়েছেন, তাই না?
তানভির বলল, বলা প্রয়োজন বোধ করেছি বলেই বলেছি।
প্ৰয়োজন বোধ করলেন কেন?
ভয়ঙ্কর কোনো ভুল কেউ করতে গেলে তাকে ভুল দেখিয়ে দিতে হয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, তাই। তোমান বয়স কম। কাজেই তুমি বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলছি কিংবা কী করছ।
আপনার ধারণা আমি ভয়ঙ্কর একটা ভুল করেছি?
অবশ্যই।
কেউ যদি ইচ্ছা কবে ভুল করতে চায় তাকে কি ভুল করতে দেয়া হবে না?
না।
কোনটা ভুল কোনটা শুদ্ধ তা আপনি নিজে জানেন?
সব জানি না। তবে তোমার চেয়ে বেশি জানি।
আপনার বয়স আমার চেসে বেশি, তাই বেশি জানেন?
বয়স একটা ফ্যাক্টব তো বটেই!
যে গাধা সে আশি বছবেও গাধা থাকে, বয়স কোনো ফ্যাক্টর না।
রূপা, আমি গাধা নাই।
তা নন। তবে আপনি খুব বুদ্ধিমানও নন।
খুব বুদ্ধিমান নই তা কেন বলছ?
খুব যারা বুদ্ধিমান তারা তাদের বুধিব ধার অন্যকে দেখাবার জন্যে ব্যস্ত থাকে না। অল্পবুদ্ধির মানুষরাই অন্যদের বুদ্ধির খেলা দেখাতে চায়। অন্যদের চমৎকৃত করতে চায়। বুদ্ধিমানরা তা চায় না। কারণ তারা জানে তার প্রয়োজন নেই।
আমি কী বুদ্ধির খেলা দেখাতে গিয়েছি?
অবশ্যই গেছেন। আপনার কিছু তৈরি গল্প আছে। যে সব গল্প বলে আপনি চমক লাগাবার চেষ্টা করেন। যেমন–মোনালিসার গল্প। গল্প বলার সাজ-সরঞ্জামও আপনার সঙ্গে থাকে। মানিব্যাগে থাকে ছোট্ট মোনালিসার ছবি। এই গল্প আমাদের বলার আগে আপনি শ খানেক লোককে আগে বলেছেন। সবাই চমৎকৃত হয়েছে।
তুমি হও নি?
আমিও হয়েছিলাম। কিন্তু যেই মুহুর্তে আপনি মানিব্যাগ থেকে ছবি বের করলেন। সেই মুহুর্তেই বুঝলাম মানুষ হিসেবে আপনি খুবই সাধারণ।
তোমার ঐ স্যার বুঝি মানুষ হিসেবে অসাধারণ।
হ্যাঁ। আমার কাছে অসাধারণ।
তোমার কাছে অসাধারণ হলেই সে মানুষ হিসেবে অসাধারণ হবে? আমার তো ধারণা সে এভারেজ ইন্টেলিজেন্সের একজন মানুষ। দুরবিন নিয়ে কিছু কায়দা-কানুন করছে যা দেখে তোমরা চমৎকৃত হচ্ছি।
রূপা চুপ করে রইল। যদিও তার ইচ্ছা করছে কঠিন কিছু বলে লোকটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। কিছু মনে পড়ছে না। তানভির হাতের সিগাবেট ফেলে দিয়ে আরেকটি ধরাল। তার ভাবভঙ্গিতে আগের অস্থিরতা নেই। তবে রূপা মেয়েটিকে এখন সে আগেব মতো তুচ্ছ বালিকা হিসেবে অগ্রাহ্য করছে না। সে বুঝতে পারছে এই মেয়েটিব সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে।
রূপা!
জি।
পাড়াগায় যারা থাকে তাদের জীবন মোটামুটি নিস্তরঙ্গ। বড় ধরনের কিছু চারপাশে ঘটে না। দুরবিন নিয়ে কেউ উপস্থিত হলে তাকেই মনে হয় গ্যালিলিও। আসলে তার প্ৰতিভা হয়তো ঐকিক নিয়মে ভালো অঙ্ক করায় সীমাবদ্ধ। কাউকে স্পেসিফিক্যালি মিন করে আমি বলছি না। তুমি রাগ করো না।
আমি রাগ করছি না। ব্যাপারটা সত্যিা হলে রাগ হতো। সত্যি না বলেই রাগের বদলে হাসি পাচ্ছে।
তোমার স্যার সম্পর্কে আমি এমন একটা কথা জানি যা শুনলে তুমি হয়তো রাগ করবে।
বলুন।
শুনেছি তিনি গম চুরি করেছেন। স্কুলের বরাদ্দ একশ মণ গম লোপাট করে দিয়েছে। তার নামে কেস হয়েছে।
কে বলেছে আপনাকে?
এটা কোনো গোপন ব্যাপার না। আমি তোমার বাবার কাছ থেকেই শুনেছি।
তিনি আপনাকে কখন বললেন, আজ?
হ্যাঁ।
বাবা খুব ভালো করেই জানেন এটা মিথ্যা। তার পরেও তিনি এটা আপনাকে কেন বলেছেন তা কি আপনি বুঝতে পারছেন?
না।
জানি বুঝতে পারবেন না। কারণ আপনার এত বুদ্ধি নেই। যদি আপনার খানিকটা বুদ্ধি থাকত তাহলে আপনি বুঝে ফেলতেন যে বাবা এটা আপনাকে বলছেন যাতে আপনার সব রাগ গিয়ে ঐ মানুষটার উপর পড়ে। যাতে আপনি ভাবতে শুরু করেন যে, সব দোষ ঐ চোর মানুষটার। রূপা নামের মেয়েটার কোনো দোষ নেই।
তানভিরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। রূপা মেয়েটি তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। গ্রামে বড় হওয়া বাচ্চা একটা মেয়ে এমন গুছিয়ে কথা বলছে–আশ্চর্য!
তানভিব বলল, এই চেয়ারটায় বস রূপা। মেজাজ ঠাণ্ডা কর, তারপর কথা বলি। রূপা বলল, আমার মেজাজ খুব ঠাণ্ডা আছে। কেন আমার মেজাজ এত ঠাণ্ডা তা জানেন?
না।
একদিন না একদিন এ-রকম একটা ব্যাপার ঘটবে তা আমি জানতাম! একদিন সবাই জানবে। তুমুল হৈচৈ শুরু হবে। মা ক্রমাগত কাঁদতে থাকবেন। বাবা স্তম্ভিত হয়ে বাবান্দায় ইজি চেয়ারে বসে থাকবেন। এটা আমি জানতাম। এই ঘটনার জন্যে আমার মানসিক প্ৰস্তৃতি ছিল বলেই আমি এত সহজভাবে সব কিছু নিতে পারছি।
তানভির বলল, আমি তাই দেখছি। এবং খানিকটা বিস্মিতও হচ্ছি। তোমার স্যার অসাধারণ কি-না জানি না, তবে তুমি অসাধারণ।
রূপা বাবান্দা থেকে চলে এলো। আসলেই তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মনে হচ্ছে এখনো কেউ খাদ্য নি। আজ রাতে কি এ বাড়িতে খাওয়া হবে না? রূপা রান্নাঘরে ঢুকাল। রূপার মা রান্নাঘরে মোড়ায় একা একা বসে আছেন। রূপা বলল, প্ৰচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে মা। আমাকে ভাত দিয়ে দাও। আজ কী রান্না?
রূপার মা দীর্ঘ সময় মেয়েব দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বৌমা যা বলল তা-কি अऊिा शा?
হ্যাঁ, সত্যি। এখন তোমাবা কী কববে? বটি দিয়ে কুপিয়ে আমাকে কুচিকুচি কবে নদীতে ফেলে দেবে?
রূপার মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই ঠিক কবে বল তো মা ঐ হারামজাদা মাস্টার কি তোর গায়ে হাত দিয়েছে?
রূপা শান্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে ছোট করতে চাও, কর। কিন্তু মা উনাকে ছোট করবে না। উনি এসব কিছুই জানেন না।
রূপার মা কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, হারামজাদা জানে না মানে? হারামজাদা ঠিকই জানে। জেনেশুনে সে তোকে জাদু করেছে। তুই হচ্ছিস গাধার গাধা। মহাগাধা। তুই কিছুই বুঝতে পারিস নি। তোর বাবা ভয়ঙ্কর রাগ করেছে। সে ঐ ছোটলোকটাকে এমন শাস্তি দেবে যে সে তার বাপ-মার নাম ভুলে যাবে।
কী শান্তি দিবে? খুন করবে?
কথা বলিস না তো। তোর কথা শুনে রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। তুই যা আমার সামনে থেকে।
তিনি শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। রূপা নিজের ঘরে চলে এলো। তার অসম্ভব ভয় লাগছে। বাবা মাস্টার সাহেবকে শাস্তি দেবেন। এটা নিশ্চিত। তার অপরাধে শান্তি পাবে অন্য একজন। কী শাস্তি কে জানে। মেরে ফেলবেন না নিশ্চয়ই। মানুষ এত নিচে নামতে পারে না। চেষ্টা করেও পারে না। স্কুলের চাকরি চলে যাবে। তাকে নীলগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা হলে শাপে বর হয়। সেও স্যারের সঙ্গে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে কোথাও। যেখানে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। কেউ না।
মিনু এসে ডাকল, খেতে আস রূপা।
রূপা বলল, ক্ষিধা মরে গেছে ভাবি। তোমরা খাও। আমি কিছু খাব না।
তোমার ভাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, খেয়ে আমার ঘরে আস।
আমি এখন কারো সঙ্গেই কথা বলব না ভাবি। আমার প্রচণ্ড মাথা ধবেছে। আমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকব।
তোমার ভাই কিন্তু রাগ করবে।
রাগ যা কবার করেছে। এখন দেখা করতে গেলেও সেই রাগের উনিশ-বিশ হবে না। আমি সকালে কথা বলব।
আফজাল সাহেব রাত এগারোটায় ভাত না খেয়েই জুতা-জামা পরে ঘর থেকে বেবোলেন। রফিক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জবাব দেন নি। কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা এখন তার নেই। রফিক বলল, আমি কী সঙ্গে আসব বাবা?
তিনি হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।
রফিক সঙ্গে চলল। বাবা প্ৰচণ্ড রেগে আছেন। তার হাই ব্লাড প্রেসার। এ রকম অবস্থায় তাকে একা ছাড়া উচিত না। তাছাড়া আকাশের অবস্তা ভালো না। যে৬াবে মেঘ ডাকছে তাতে মনে হয় ঝড়-টড় হবে।
রাস্তায় নেমেই রফিক বলল, যাচ্ছেন কোথায় বাবা?
থানায় যাচ্ছি।
থানায়?
হুঁ। ওসি সাহেবকে বলব, ঐ শুওরের বাচ্চাকে কাল যেন কোমরে দড়ি বেঁধে হজিতে নিয়ে ঢোকায়। নীলগঞ্জের সমস্ত মানুষ যেন তাকে দেখে।
ওসি সাহেব কি এটা করবেন?
অবশ্যই করবে। থানার বড় সাহেবরা যে কোনো অন্যায় আগ্রহ নিয়ে কবে। আর এটা কোনো অন্যায় না। ব্যাটার বিরুদ্ধে কেইস আছে। গম চুরির কেইস।
রফিক বলল, হাজতে নিয়ে ঢুকানোর আইডিয়াটা মন্দ না বাবা। রূপা যদি শোনে চুরির অপরাধে ব্যাটাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাহলে তার মোহভঙ্গ হতে পাবে।‘
মোহভঙ্গ হোক আর না হোক, হারামজাদার বিষদাঁত আমি ভেঙে দেব। ন্যাংটো করে সারা নীলগঞ্জ আমি তাকে ঘুরাব। কুত্তা লেলিয়ে দেব। আমি খেজুরের কাটা দিয়ে ঐ কুত্তার চোখ গেলে দিব।
এত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আমরা ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা ট্যাকল করব। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
রূপা ঘুমুতে গেল বৃষ্টি নামার পর। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর ধুয়েমুছে যাবে। রূপেশ্বর এবার বান ডাকবে। নিশ্চয়ই ডাকবে। ভাবতেই রূপার ভালো লাগছে। ডাকুক, ভয়াবহ বান ডাকুক। নীলগঞ্জ ধুয়ে-মুছে যাক রূপেশ্বরের জলে।
বাতি নেভাতেই জেবা ডাকল, ফুপু।
রূপা বলল, হুঁ।
বাড়িতে এখন দুটা দল হয়ে গেছে।
হুঁ, হয়েছে।
তোমার এক দল আর বাকি সবার দল।
রূপা কিছু বলল না। আসলে কোনো কিছুই সে শুনছে না। প্রচণ্ড জ্বরের সময় যেমন হয় এখন তার তাই হচ্ছে। কোনো কথা পরিষ্কার তার মাথায় ঢুকছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটু যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।
জেবা বলল, ওদের দলে এত মানুষ আর তোমার দলে আছি শুধু আমি। দুজনের দল–তাই না ফুপু?
হুঁ।
নদীর দিক থেকে শো-শো শব্দ আসছে। রাত যত বাড়ছে শব্দ ততই স্পষ্ট হচ্ছে।
রূপা বিছানায় উঠতে উঠতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, এ বছর রূপেশ্বর নদীতে বান ডাকবে।
বান ডাকলে কি তুমি খুশি হও ফুপু?
হ্যাঁ হই। জলের তোড়ে ভেসে গেলে খুশি হই। জেবা হাসল। খিলখিল হাসি। অন্ধকারে তার হাসি অদ্ভুত শোনাল। মনে হচ্ছে সে হাসি যেন কলকল শব্দে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ফুপু।
ফুপু ফুপু করবি না তো। ঘুমো।
একটা কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ব। কথাটা হচ্ছে–কাল সকালটা তোমার জন্যে খুব কষ্টেব্য হলে। খুব কষ্টেল, তবে আমি তো তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবে।
তোমার কথার আগা-মাথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না জেবা। তুমি কি সব সময় এরকম পাগলের মতো কথা বলে?
আমি কোনোদিনই পাগলের মতো কথা বলি না। কিন্তু সবাই মনে করে আমি পাগলের মতো কথা বলি।
ঠিক আছে, তুমি ঘুমাও।
ফুপু।
আর একটা কথাও না। ঘুমাও তো।
আমি কী আমার একটা হাত তোমার গায়ে রাখতে পারি?
না।
আচ্ছা আমি ঘুমুচ্ছি। তুমি ঘুমাও।
আমার ঘুম আসবে না।
আসবে। এক্ষুণি আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব।
রূপা শুয়েছে। বৃষ্টির জন্যেই একটু শীত শীত লাগছে। গায়ে পাতলা চাদর দিতে পারলে ভালো হতো। আলসি লাগছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। ঘুমের মধ্যেই রূপা শুনতে পাচ্ছে, জেবা বলছে–দেখলে ফুপু, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। ঘুম! ঘুম!!
নীলগঞ্জ এমনই এক জায়গা যেখানে কখনো নাটকীয় কিছু ঘটে না। কারো বড়শিতে বড় মাছ ধরা পড়লে অনেক দিন সেই মাছ ধরার গল্প হয়। আসরে গল্প হিসেবে মাছেব প্ৰসঙ্গ আসে–ধরেছিল একটা মাছ, পুব পাড়ার নীলমাধব। একটা জিনিসের মতো জিনিস…
সেই নীলগঞ্জে আজ ভোরবেলা ভয়াবহ এক নাটক হচ্ছে। অচিন্তনীয় একটা ঘটনা ঘটছে। নীলগঞ্জের মানুষ এতই হকচকিয়ে গেছে যে কিছু বলতে পারছে না। পাশের জনকে ফিসফিসিয়েও কিছু বলছে না। দৃশ্যটা হজম করতে সবারই সময় লাগছে। তাবা অবাক হয়ে দেখছে নীলগঞ্জ স্কুলের স্যার মবিনুর রহমানকে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। সবার আগে যাচ্ছেন ওসি সাহেব। তার চোখে সানগ্লাস। সানগ্লাস থাকাব কারণে তাঁর মুখের ভাব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। কোমরের দড়ি ধরে যে পুলিশটি যাচ্ছে তাকে খুব বিমর্ষ মনে হচ্ছে। সে হাঁটছে মাথা নিচু করে। মবিনুব রহমানের পেছনেও দুজন পুলিশ। তারাও মাথা নিচু করে হাঁটছে।
মবিনুর রহমানকে অত্যন্ত বিস্মিত মনে হচ্ছে। এই গরমেও তিনি একটা কোট গায়ে দিয়েছেন। তার হাতে টেলিস্কোপের বাক্সটা আছে। বাক্সটা কিছুক্ষণ পর পর এ হাত থেকে ও হাতে নিচ্ছেন।
ওসি সাহেব মবিনুর রহমানকে বললেন, সিগারেট খাবেন?
মবিনুর রহমান বললেন, জি না।
ওসি সাহেব বললেন, আপনার ঐ টেলিস্কোপটা কনষ্টেবলের হাতে দিয়ে দিন। হাঁটতে আপনার কষ্ট হচ্ছে।
কষ্ট হচ্ছে না। এর ওজন বেশি না। থ্রি পয়েন্ট টু কেজি।
সাবধানে পা ফেলুন, ভীষণ কাদা।
ওসি সাহেবরা আসামিদের সঙ্গে এই ভঙ্গিতে কথা বলেন না, বিশেষত যে আসামিকে কোমরে দড়ি বেধে নিয়ে যেতে হয়। এই আসামির বেলায় তিনি কিছু ব্যতিক্রম করেছেন। শুরুতেই আপনি বলে ফেলেছেন। শুরুতে আপনি না বললে এই যন্ত্রণা হতো না।
এই লোকটা গম চুরির সঙ্গে জড়িত না তা তিনি বুঝতে পাবছেন। এটা বোঝার জন্যে এগারো বছর ধরে ওসিগিরি করতে হয় না। লোকটাকে কায়দা করে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। আগে মনে হচ্ছিল পুরো ব্যাপারটার পেছনে আছে হেডমাস্টাব হাফিজুল কবির। এখন মনে হচ্ছে আরো অনেকেই আছে। বিশেষ করে আফজাল সাহেব আছেন।
একটা নিরপরাধ লোককে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আফজাল সাহেবের কারণে। তিনি বিশেষ করে বলে দিয়েছেন যেন কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তার বাড়ির সামনে নিয়ে নেয়া হয়।
আফজাল সাহেব এই অঞ্চলের অত্যন্ত ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ। এদের কথা শুনতে হয়। না শুনলে এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন চালানো যায় না। বড়দারোগাগিরি সহজ জিনিস নয়। অনেকের মন রেখে চলতে হয়। এমন সব কাজ করতে হয় যার জন্যে মন ছোট হয়ে
ওসি সাহেব নিজের অস্বস্তি দূর করবার জন্যেই বললেন–আপনার এই যন্ত্র দিয়ে গ্রহ-নক্ষত্র সব দেখা যায়?
মবিনুর রহমান আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, সব দেখা না গেলেও অনেক দেখা যায়। যেমন ধরুন শনি গ্রহের বলয় দেখা যায়।
দেখতে কেমন?
অপূর্ব।
ওসি সাহেব আগ্রহের সঙ্গে বললেন, জিনিসটা একবার দেখলে হয়।
মবিনুর রহমান বললেন, টেলিস্কোপ সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছি। আকাশ পরিষ্কার থাকলে আপনাকে দেখাব।
ওসি সাহেব লজ্জিত বোধ করছেন। মানুষটা তো অদ্ভুত। তার কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে আর সে কী না বলছে তাকে টেলিস্কোপে শনি গ্রহের বলয় দেখাবে। মানুষটাকে এ্যাবেষ্ট করতে গিয়েও বিপত্তি। কাউকে এ্যাবেষ্ট করে নিয়ে আসা এমন কোনো মজাদার বিষয় নয়। বিশেষ করে যখন জানা থাকে লোকটা নিরপরাধ। হন্বিতম্বি তখনি বেশি করতে হয়। নিরপরাধ লোকের মনেও এই বিশ্বাস ধরিয়ে দিতে হয় যে সে আসলে নিরপরাধ না। কোনো একটা অপরাধ তার আছে যা সে নিজে তেমন ভালো জানে না। ওসি সাহেবও তাই করলেন। ভয়ঙ্কর মূর্তিতে উপস্থিত হলেন। খসখসে গলায় বললেন, ইউ আর আন্ডার এ্যারেস্ট।
ভদ্রলোক চায়ে পানি গরম কবছিলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, কেন বলুন তো?
গম চুরির মামলা–মিস এপ্রোপ্রিয়েশন অব পাবলিক ফান্ড। নব্বই বস্তা গম আপনি চুরি করেছেন।
নব্বই বস্তা গম দিয়ে আমি কী কবব?
আমার সঙ্গে কি রসিকতা করার চেষ্টা করছেন? নব্বই বস্তা গম দিয়ে আপনি কী করবেন তা জানেন না? স্ট্রেইট কথা বলুন। বাকা কথা বলবেন না।
বাঁকা কথা কী বললাম বুঝতে পারছি না।
বুঝতে না পারলে কথা বলবেন না। শুধু প্রশ্ন কবলেই জবাব দেবেন। নট বিফোর 179।
জি আচ্ছা।
আপনার ঘরও সার্চ হবে। সার্চ ওয়ারেন্ট আছে। পাশের ঘরে কী আছে?
দুটা চন্দ্রবোড়া সাপ আছে আর তাদের একত্ৰিশটা ছানা আছে। সাবধানে যাবেন।
ওসি সাহেবের রাগে গা জ্বলে গেল। লোকটিকে সাদাসিধা ভালোমানুষ মনে হয়েছিল, আসলে সে তা না। খাকি পোশাকের সঙ্গে রসিকতা করতে চায়। যারা খাকি পোশাকের সঙ্গে রসিকতা করতে চায় তাদেরকে চোখে চোখে রাখতে হয়। বুঝিয়ে দিতে হয় যে খাকি পোশাক রসিকতা পছন্দ করে না।
কী বললেন? চন্দ্রবোড়া সাপ?
জি।
ভেরি গুড। আমার কিছু চন্দ্রবোড়া সাপই দরকার।
ওসি সাহেব নিজেই দরজা খুললেন এবং ছিটকে বের হয়ে এলেন। দুটি চন্দ্রবোড়াব একটি তিনি দেখতে পেয়েছেন। সেই দৃশ্য খুব সুখকর নয়। তখনই তিনি ঠিক করেছেন এই আসামির সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। মবিনুর রহমান যখন বললেন, আমি কি আমার দুরবিনটা সঙ্গে নিতে পারি?
ওসি সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, অবশ্যই পারেন। অবশ্যই। সঙ্গে আরো কিছু নিতে চাইলে তাও নিতে পারেন।
না, আর কিছু না। হাজতে কি আমাকে দীর্ঘদিন থাকতে হবে?
এখন বলা যাচ্ছে না। নির্ভর করে.
কীসেবা ওপর নির্ভর করে?
ওসি সাহেব তার জবাব দিলেন না। তার মন বলছে এই লোকটির সঙ্গে বেশি। কথাবার্তায় যাওয়া ঠিক হবে না।
রাস্তায় লোক জমছে। তারা অবাক হয়ে মবিনুর রহমানকে দেখছে। মবিনুর রহমান তাদের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। তাঁর সেই তাকানোয় লজ্জা-সংকোচ কিছুই নেই। বিব্রত একটা ভঙ্গি আছে, এর বেশি কিছু না।
কালিপদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল। পুলিশের দল দেখে থমকে দাঁড়াল। উঁচু গলায় বলল, কী হইছে? মবিন্নুর রহমান বললেন, কেমন আছ কালিপদ?
আপনেরে কই নিয়া যায়?
থানায় নিয়ে যাচ্ছে।
কেন?
আমার বিরুদ্ধে গম চুরির কেইস আছে।
কালিপদ বালতি নামিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। পরবর্তী এক ঘণ্টা সে তার জায়গায় বসেই রইল, নড়ল না।
পুলিশের দলটা থামল আফজাল সাহেবের বাড়ির সামনে। ওসি সাহেব বাড়ির গেট খুলে বাইরের বাবান্দায় ঢুকলেন এবং গম্ভীর গলায় ডাকলেন, আফজাল সাহেব আছেন?
আফজাল সাহেব বের হয়ে এলেন।
ওসি সাহেব বললেন, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পাবেন?
এদিকে কোথায় এসেছিলেন?
আসামি নিয়ে থানায় যাচ্ছি।
বসুন চা খেয়ে যান।
চা অবশ্যি এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।
ওসি সাহেব পুলিশের দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এ্যাই, তোমরা একটু দাঁড়াও। পুলিশের দল মবিনুর রহমানকে নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
এরকমই কথা ছিল। আফজাল সাহেব বলে দিয়েছিলেন কোমরে দড়িবাঁধা অবস্থায় মবিনুর রহমানকে গেটের বাইরে দাড়া করিয়ে ওসি সাহেব তার বাড়িতে চা নাশতা খবেন।
ওসি সাহেব এই কাজটিই এখন করছেন। তবে কাজটি করতে তাঁর খুব ভালো লাগছে না। লোক জমছে। অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। মানুষ বেশি জমলেই তারা একসঙ্গে এক জাতীয় চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। যার নাম মব সাইকোলজি। এই চিন্তা হঠাৎ কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল। জড়ো হওয়া মানুষগুলি যদি মনে করে কাজটা অন্যায় হয়েছে তাহলে মুহুর্তের মধ্যে ক্ষেপে যাবে। ক্ষেপা জনতা— ভয়ঙ্কর।
রূপা বারান্দায় এসে শান্ত চোখে দৃশ্যটা দেখল। একবার মবিনুর রহমানের দিকে তাকিয়ে সে তাকাল তার বাবার দিকে। তারপর তাকাল ওসি সাহেবের দিকে।
ওসি সাহেব বললেন, আপনার মেয়ে?
আফজাল সাহেব বললেন, জি। এর নাম রূপা।
ওসি সাহেব বললেন, কেমন আছ মা?
রূপা বলল, ভালো আছি। আপনি স্যারকে কোমবে দড়ি বেঁধে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়া করিয়ে রেখেছেন কেন?
আসামিকে থানায় নিয়ে যাওয়ার এইটাই পদ্ধতি, আসামি যে-ই হোক না কেন তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যেতে হবে।
স্যারের বাড়ি থেকে থানায় যাবার রাস্তা তো এটা না। আপনি অনেকখানি ঘুরে আমাদের বাড়ির সামনে এসেছেন। কেউ নিশ্চয়ই এই কাজটা করার জন্যে আপনাকে বলেছে। তাই না?
ওসি সাহেব আফজাল সাহেবের দিকে তাকালেন।
আফজাল সাহেব কড়া গলায় বললেন, ভেতরে যাও রূপা।
রূপা কয়েক মুহুর্ত বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল।
বাড়ির সামনে লোক বাড়ছে।
ওসি সাহেব চা শেষ না করেই উঠে পড়লেন। ব্যাপারটা আর ভালো লাগছে না। এত লোক জমছে কেন?
মবিনুর রহমানকে হাজতে ঢোকানোর তিন ঘণ্টার ভেতর থানার চারপাশে দুতিন হাজার মানুষ জমে গেল। তারা হৈচৈ, চিৎকার কিছুই করছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই শান্ত। এই লক্ষণ ভালো না। খুব খারাপ লক্ষণ। এরা থানা আক্রমণ করে বসতে পারে। থানায় আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। থানায় টেলিফোন আছে–অতিরিক্ত ফোর্স চেয়ে টেলিফোন করা যায়। কিন্তু টেলিফোন গত এক সপ্তাহ থেকে নষ্ট।
ওসি সাহেব থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা সরকারি কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন। এর ফলাফল ভালো হবে না। আমরা আসামি ধরে এনেছি। আসামিকে কোর্টে চালান করে দেব। সেখান থেকে জামিন হবে। যান, আপনারা বাড়ি চলে যান। ভীড় বাড়বেন না।
কেউ নড়ল না।
দুপুর গড়িয়ে গেল। মানুষ বাড়তেই থাকল।
ওসি সাহেব সেকেন্ড অফিসারকে বললেন হেড অফিসে খবর দিতে। আসামিকে ছেড়ে দিলে এখন কোনো লাভ হবে না। হিতে বিপরীত হবে। লোকজন থানান্য আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। এই রিস্ক নেয়া যায় না।
সেকেন্ড অফিসার সাহেব থানা ছেড়ে বেরুতে গেলেন, লোকজন তাকে ঘিরে ফেলল। নিরীহ গলায় বলল, স্যার কোথায় যান?
তা দিয়ে আপনি কী করবেন?
যেতে পারবেন না স্যার।
যেতে পারব না। মানে? এটা কি মগের মুলুক নাকি?
সেকেন্ড অফিসার ভয়াবহ পুলিশী গর্জন দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। লোকজন কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এই দৃষ্টির সঙ্গে তিনি পরিচিত। এই দৃষ্টির নাম–উন্মাদ দৃষ্টি।
জেবা চা খাচ্ছে। পিরিচে করে চা খাচ্ছে।
পিরিচ ভর্তি চা নিয়ে চুকচুক করে চুমুক দিচ্ছে। তাকে কেন জানি খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। রূপা ঘরে ঢুকে জেবাকে দেখল। জেবা বলল, ফুপু আমি চা খাচ্ছি। বলেই খিলখিল করে হাসল। চা খাওয়ার মধ্যে হাসির কী আছে রূপা বুঝতে পারছে না। আসলে এখন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কাছে সবই এলোমেলো হয়ে গেছে।
ফুপু।
কী?
তুমি চিন্তা কববে না। ফুপু, আমি তোমার দলে।
আমি কোনো চিন্তা করছি না। আর শোন, আমি কোনো দল কবছি না।
তোমার স্যারকে নিয়েও তুমি চিন্তা কববে না। আমি ব্যবস্থা করছি।
তুমি ব্যবস্থা করছি মানে?
সব মানুষ ক্ষেপে যাবে। ওলা থানা আক্রমণ করবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। সাংঘাতিক মজার ব্যাপার হবে।
কী বলছ তুমি?
আমি কোনো মিথ্যা কথা বলি না ফুপু। সন্ধ্যার মধ্যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড শুরু হবে।
জেবা হাসল খিলখিল করে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব আনন্দিত।
নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেব অস্থির বোধ করছেন। দুপুরে তিনি বাসায় ভাত খেতে যান নি। শুধু তিনি কেন, থানার কেউই দুপুরে খায় নি। সেপাইদের সবাইকে রাইফেল হাতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। ওসি সাহেব বিপদের ঘাণ পাচ্ছেন। মানুষ ক্রমেই বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে দূর দূর থেকে মানুষ আসছে। অনেকের হাতেই বর্শা। বর্শা হলো এ অঞ্চলের যুদ্ধান্ত্র যার স্থানীয় নাম অলংগা। কারো কারো হাতে লম্বা বাঁশের লাঠিও আছে। এখনো সন্ধ্যা হয় নি। কিন্তু অনেকেই হারিকেন নিয়ে এসেছেন। মনে হয় তাদের সারারাত জেগে থাকার পরিকল্পনা। ওসি সাহেব মবিনুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হাজতের দরজা খুলতেই মবিনুর রহমান বিস্মিত গলায় বললেন, এত লোক কেন চারদিকে?
ওসি সাহেবের প্রথমেই মনে হলো, ব্যাটা সব জেনেশুনে ঠাট্টা করছে। পরমুহুর্তেই মনে পড়ল। এই লোক মিথ্যা বলে না। ঠাট্টাও করে না। চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সত্যি কথাই বলেছিল।
মবিন্নুর রহমান আবার বললেন, এত লোক কেন?
ওসি সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, জানি না। আপনি কি চা খাবেন?
জি-না।
সিগারেট? সিগারেট লাগবে? আনিয়ে দেব?
জি-না।
ওসি সাহেব কথা বলার আর কিছু পেলেন না। নিজের অফিস ঘরের দিকে ফিরে চললেন। লোক আরো বাড়ছে। দ্রুত কোনো একটা বুদ্ধি বেব কবে এদের দূর করতে হবে। ভয় দেখিয়ে দূর কবা যাবে না। এক মানুষ ভয প।ায়। জনতা ভয় পায় না। মবিনুর বহমানকে ছেড়ে দিলেও কোনো লাভ হবে না। এরা তাহলে নিজেদের বিজয়ী ভাববে। বিজয়ী মানুষদের জয় উল্লাসও ভয়াবহ হয়ে থাকে। আনন্দেই এরা হয়তো থানা জ্বালিয়ে দেবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে মবিনুব রহমানের কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে নিয়ে আসা যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কীভাবে তা সম্ভব? অতি দ্রুত কিছু ভেবে বের করতে হবে। অতি দ্রুত। এমন কিছু বলতে হবে যাতে সবাই বলে কোমবে দড়ি বেঁধে থানায় আনার প্রয়োজন ছিল।
ওসি সাহেব তাঁর অফিসে ঢুকেই দেখলেন, নীলগঞ্জ হাই স্কুলের ধর্ম শিক্ষক জালালুদ্দিন বসে আছেন। জালালুদ্দিন সাহেবের মুখ অতিরিক্ত গম্ভীর।
কেমন আছেন জালালুদ্দিন সাহেব?
জি জনাব, ভালো। আপনার কাছ থেকে একটা বিষয় জানতে এসেছি।
অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এর মধ্যে কী জানতে চান?
অবস্থা সম্পর্কেই একটা প্রশ্ন। মবিনুর বহমান সাহেবকে আপনারা কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে এনেছেন। কী জন্যে এনেছেন? গম চুরিব একটা মিথ্যা মামলার কারণে না অন্য কিহুচ?
অন্য কিছু।
বলুন শুনি।
ওসি সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন–অন্য ব্যাপার। সামান্য কারণে তার মতো লোককে তো এভাবে থানায় আনা যায় না। পুলিশ হয়েছি বলে তো আর আমরা অমানুষ না। মানী লোকের মান আপনারা যেমন বুঝেন আমরাও বুঝি। উনার বিরুদ্ধে অসামাজিক কাৰ্যকলাপের গুরুতর অভিযোগ আছে।
কী বললেন?
ওসি সাহেব নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্যে কিছুটা সময় নিলেন। সিগারেট ধরালেন। সুন্দর একটা গল্প ফাঁদতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য গল্প। সিগারেট টানতে টানতে কঠিন মুখে বললেন— একটা রেপ কেইস হয়েছে। ভিকটিমের জবানবন্দি অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
রেপ কেইস?
জি, রেপ কেইস। এই কারণেই কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় এনেছি।
জালালুদ্দিন হতভম্ব মুখে তাকিয়ে আছেন।
ওসি সাহেব এই হতভম্ব দৃষ্টি দেখে খানিকটা সাত্ত্বিনা পেলেন। মনে হচ্ছে কাজ হবে। জালালুদ্দিন যখন তাঁর কথায় হকচকিয়ে গেছে তখন অন্যরাও যাবে। এই ঘটনায় লোকজন বুঝবে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় আনা উচিত ছিল। বাতাস ঘুরে যাবে। মবের চিন্তা-ভাবনা একদিন থেকে অন্যদিকে অতি দ্রুত ঘুরতে পারে। এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে মামলা সাজানো। একটা মেয়ে জোগাড় করতে হবে, যে হবে ফরিয়াদি। তেমন মেয়ে জোগাড় করা কঠিন হবে না। পুলিশের কাছে কোনো কাজই কঠিন নয়।
তানভির বাগানে একা একা বসে ছিল।
রূপা বারান্দায় আসতেই সে ডাকল, রূপা শুনে যাও তো।
রূপা শান্তমুখে বাগানে নামল। তানভির বলল, তোমার স্যারের কাণ্ড শুনেছ? রফিক ভাই এইমাত্র বলে গেলেন। তিনি বাজার থেকে শুনে এসেছেন। তুমি শুনতে চাও?
না।
না কেন? একটা মানুষকে ঠিকমতো জানতে হলে তার ভালো-মন্দ সবই জানতে হয়।
আপনার বলার ইচ্ছা খুব বেশি হলে বলুন, শুনব।
জোর করে শুনাতে চাচ্ছি না। তবুও আমি মনে করি তোমার শোনা উচিত। তোমার স্যার একটা মেয়েকে নির্জন বাড়িতে রেপ করেছেন, যে কারণে পুলিশ তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেছে।
আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন?
বিশ্বাস না করার তো কিছু দেখছি না। নারীসঙ্গবৰ্জিত একজন মানুষ নির্জন জায়গায় একা একা থাকে…।
নারীসঙ্গবৰ্জিত অনেক সাধক মানুষও নির্জন জায়গায় একা একা থাকে।
তোমার ধারণা উনি সাধক মহাপুরুষ?
হ্যাঁ।
তাহলে তো আর কিছু বলার নেই।
না। আর কিছু বলার নেই।
রূপা বাগান থেকে উঠে এলো। তানভির প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করে ফেলল, এই বুদ্ধিমতী শক্ত ধাঁচের মেয়েটিকেই তার বিয়ে করতে হবে। জোর করে হলেও করতে হবে। মেয়েটির মনে সাময়িক যে মোহ আছে তা বিয়ের পর কেটে যাবে। অল্পবয়সের মোহ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এই মোহ অনেকটা শিশুদের হামের মতো, সবারই হবে। আবার সেরে যাবে।
ওসি সাহেবের পরিকল্পনা কাজ করেছে। লোকজন চলে যেতে শুরু করেছে। মানুষ অসত্যকে সহজে বিশ্বাস করে। মবিনুর রহমানের মেয়েঘটিত ব্যাপার তারা বিশ্বাস করেছে। এর নাম মিব সাইকোলজি–এই উত্তর এই দক্ষিণ। মাঝামাঝি কোনো ব্যাপার নেই।
ওসি সাহেব ডাকলেন, কবির মিয়া।
ডিউটির সেন্ট্রি বলল, জি স্যার।
দেখে আস তো মবিনুর রহমান কী করছে?
দেখে এসেছি স্যার। উনি ঘুমুচ্ছেন।
হারামজাদা।
হারামজাদা কাকে বলা হলো, কেন বলা হলো কবির মিয়া ঠিক বুঝতে পারল না। ওসি সাহেব বললেন, লোকজন এখনো আছে?
কিছু আছে স্যার।
হারামজাদা।
কিছু বললেন স্যার?
না কিছু বলি নাই। তুমি যাও ডিউটি দাও। আর শোন আমি এখন বেরুব! আমি ফিরে না। আসা পর্যন্ত যেন থানা ছেড়ে কেউ না যায়।
ওসি সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠলেন। ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়েছে। ভয়ঙ্কর একটা দিন গিয়েছে। বিশ্রামের উপায় নেই। এখন যেতে হবে একটা মেয়ের সন্ধানে, যাকে ফরিয়াদি করে মামলা দাড়া করানো যায়,। নীলগঞ্জ বাজারে কয়েকঘর পতিতা থাকে। ওদের কাছ থেকেই সংগ্ৰহ করতে হবে। অল্পবয়সী হলে ভালো হয়। বয়স যত কম হবে ততই ভালো। নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
পাওয়া গেল। সাবিহা বেগম নামের পনেরো বছরের এক বালিকা দুদিন আগের তারিখে থানায় জি.ডি এন্ট্রি করাল। তার গল্পটি এককম–সে সকালে বাড়ি যাচ্ছিল। মবিনুর রহমানের বাড়ির কাছ দিয়ে যাবার সময় মবিনুর রহমান তাকে বলল, তুমি কি বাজারে যাও? সে বলল, হ্যাঁ।
তুমি আমার জন্যে কিছু লবণ কিনে আনবে? লবণের অভাবে কিছু রাঁধতে পারিছ না। আধা কেজি লবণ আনতে পারবে?
সে বলল, পারব।
পারব বলল কারণ সে জানে এই পাগল লোকটা একা একা থাকে। স্কুলের শিক্ষক। খুব ভালো মানুষ। আগেও কয়েকবার সে এই মানুষটাকে এটা-ওটা এনে দিয়েছে।
মবিনুর রহমান বলল, আস টাকা নিয়ে যাও। সে টাকা নেবার জন্যে ঘরে ঢুকতেই মবিনুর রহমান দরজা বন্ধ করে দিল। দরজায় খিল দিয়েছিল। সাবিহা কিছু বুঝবার আগেই সে তার হাত ধরল। সাবিহা তখন অনেক চিৎকার করল। কিন্তু তার চিৎকার কেউ শুনল না। তাছাড়া খুব বৃষ্টি হচ্ছিল।
মোটামুটিভাবে বিশ্বাসযোগ্য গল্প।
মিথ্যা গল্প অতি সহজেই বিশ্বাসযোগ্য করা যায়। সমস্যা হয়। সত্য গল্প নিয়ে।
জেবার জ্বর এসেছে।
সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ সমস্ত হাত-পা অবশ করে জ্বর এলো। সে দুবার বমি করে নেতিয়ে পড়ল। তার চোখ রক্তবর্ণ। রফিক ডাক্তার ডাকতে চাইল। সে কঠিন গলায় বলল, না।
রফিক বলল, আচ্ছা থাক, ডাকব না।
রফিকের মা বললেন, এসব কেমন কথা? মেয়ে না বললেই না? জ্বরে হাত-পা পুড়ে যাচ্ছে। তুই ডাক্তারের ব্যবস্থা কর। মেয়ের কথা শুনতে হবে?
বফিক ক্লান্ত গলায় বলল, ওর কথা না শুনে উপায় নেই। মা! তুমি বুঝবে না। ওব অমতে, কিছু করা যাবে না। ও যা বলবে আমাদের তাই করতে হবে।
এটা কোনো কথা হলো?
এটা কোনো কথা না। কিন্তু এটাই সত্যি।
জেবা বলল, কেউ যেন আমার ঘরে না আসে। দরজা-জানালা সব বন্ধ করে দাও। দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হলো। জেবা ভেতর থেকে সিটিকিনি দিয়ে দিল। তার জ্বর আরো বাড়ছে। ঠিকমতো পা ফেলে বিছানা পর্যন্ত যেতে পারছে না। ঘবের ভেতরটা গরম। তার শীত লাগছে। প্রচণ্ড শীত। শীতে তার সারা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। জেবা বিড়বিড় করে বলল, আমি পারছি না। আমার শক্তি কম। আমি পারছি না। জেবা বিছানায় শুয়ে আছে কুণ্ডুলি পাকিয়ে। তার ঘুম আসছে। প্রচণ্ড ঘুম। ঘুম প্রয়োজন। এই ঘুমের মধ্যেই সে নিদের দেখা পাবে। নিরা তাকে বলে দেবে কী করতে হবে। কারণ সেও একজন নি। রূপা ফুপুর স্যারও নি। তার ক্ষমতা অনেক বেশি। তিনি যা ইচ্ছা! তাই করতে পারেন, অথচ তিনি তা জানেন না। নিরা তাঁকে কিছু বলছে না কেন? সে কী তাঁকে বলে দেবে?
ঘুমুচ্ছেন মবিনুর রহমান। ঠিক ঘুম না–তন্দ্রভাব হয়েছে। হাজাতের ছোট্ট ঘবটায় তাবে বসার জন্য ইজিচেয়ার দেয়া হয়েছে। তিনি ইজিচেয়ারে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। কেন জানি তার বেশ ভালো লাগছে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। চাবদিকে অন্ধকার। হাজত্ব; ঘরের ভেতরে কোনো বাতি নেই। বারান্দায় বাতি আছে। একশ পাওয়ারের বাতি। ইলেকট্রসিটি খুব দুর্বল। রাত এগারোটার আগে সবল হবে না। বারান্দার বাতি প্রদীপের আলোর মতো আলো দিচ্ছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঢালা বর্ষণ হচ্ছে। নদীর দিক থেকে শো-শো আওয়াজ আসছে। বোধহয় রূপেশ্বরে আবারো বান ডাকবে। এই নদী প্রতি সাত বছর পর পর যৌবনবতী হয়। দুকুল ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
মবিনুর রহমান আধো-ঘুম আধো-তন্দ্ৰায় রূপেশ্বরের গর্জন শুনতে পাচ্ছেন। এক সময় সেই গর্জনে কিছু কথা মিশে গেল। নদীর গর্জন কোলাহলের মতো শুনাতে লাগল। এক সঙ্গে অনেকেই যেন কথা বলছে। মবিনুর রহমান ঘুমের মধ্যেই অস্বস্তি বোধ করছেন। চেষ্টা করছেন, জেগে উঠতে পারছেন না। ঘুম আরো গাঢ় হচ্ছে। যে কোলাহল এতক্ষণ শুনছিলেন তা একটি নির্দিষ্ট স্বরধ্বনিতে রূপান্তরিত হচ্ছে।
মবিনুব রহমান।
জি।
মবিনুর রহমান।
জি।
মবিনুর রহমান।
আমি তো জবাব দিচ্ছি। বারবাব ডাকছেন কেন?
কী বলছি শুনতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
আমরা কে মনে আছে?
আপনারা ‘নি’।
হ্যাঁ, তোমার মনে আছে। তুমিও একজন ‘নি’।
বুঝিয়ে বলুন।
সবকিছু বুঝিয়ে বলা যায় না।
চেষ্টা করুন।
তুমি স্বপ্ন দেখতে পাব।
স্বপ্ন সবাই দেখে।
তোমার স্বপ্ন আব্ব অন্যদেব স্বপ্ন এক নয়। অন্যদের স্বপ্ন স্বপ্নই। তোমার স্বপ্ন স্বপ্ন নয়। তুমি যা স্বপ্ন দেখবে তাই হবে।
বুঝতে পারছি না।
মানুষ পৃথিবীতে এসেছে ছয়চল্লিশটি ক্রমোজম নিয়ে। তোমার ক্রমোজম সংখ্যা সাতচল্লি যারা ‘নি’ শুধু তারাই এই বাড়তি ক্রমোজম নিয়ে আসে।
বাড়তি ক্ৰমোজমটির কাজ কী?
বাড়তি ক্ৰমোজমটির জন্যেই তুমি স্বপ্নকে মুক্ত করতে পোর। কী অসীম তোমার ক্ষমতা তা তুমি জানো না, ক্ষুদ্র অর্থে তুমি স্রষ্টা।
সব মানুষই স্রষ্টা। সৃষ্টি করাই মানুষের কাজ।
তোমার সৃষ্টির ক্ষমতা অসাধারণ।
অসাধারণ?
হ্যাঁ অসাধারণ। নিদের জন্ম হয়েছে স্বপ্ন দেখার জন্যে। তারা স্বপ্ন দেখে–নতুন সৃষ্টি হয়। প্রকৃতি তাই চায়।
একদিকে সৃষ্টি মানেই অন্যদিকে ধ্বংস।
হ্যাঁ তাই ঠিক। প্রকৃতি তাই চায়। প্রকৃতি চায়। তার জগতে ক্ৰমাগত ভাঙাগড়াব খেলা চলুক।
কিছুই বুঝতে পারছি না।
তোমার কি মনে আছে তুমি একবার চিন্বজ্যোৎস্নাব একটি জগতেব কথা চিন্তা কবেছিলে, মনে আছে?
আছে।
সেই জগৎ তৈরি হয়েছে। অপূর্ব সেই জগৎ।
আমি কি সেই জগৎ দেখতে পাবি?
হ্যাঁ পাব। তবে কল্পনায়। তোমার পৃথিবী যে মাত্রায় আছে, তোমার জগৎ সেই মাত্রার নয়।
আমি কি আমার পৃথিবীতে কিছু সৃষ্টি করতে পারি?
পার। তবে ‘নি’দের সাবধান করে দেয়া হয় যেন এই কাজটি তারা না কবে।
অসুবিধা কী?
এতে প্রাকৃতিক নিয়মে অসুবিধা দেখা দেয়। প্রকৃতি তার আইনের ব্যতিক্রম সহ্য করে না। আইন অমান্যকারীকে প্রকৃতি কঠিন শাস্তি দেয়।
আমি এই পৃথিবীতেই কিছু একটা সৃষ্টি করে দেখতে চাই প্রকৃতি আমাকে কীভাবে শাস্তি দেয়।
প্রকৃতির শান্তি ভয়াবহ। আমরা তোমাকে সাবধান করবার জন্যেই আজ এসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার ইচ্ছা হবে প্রকৃতির নিয়ম ভাঙতে। সেটি যেন না হয় তাই বলতেই আমাদের আসা। তুমি তোমার কাজ কর। তোমার অসীম ক্ষমতা ব্যবহার কর।
আপনারা চলে যান। আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না।
আমরা চলে যাব। তোমাকে সাবধান করেই চলে যাব।
আমার প্রয়োজনে আবার কি আপনাদেব সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি?
হ্যাঁ পার।
ধন্যবাদ। এখন যান।
তুমি যে এখন এক সাময়িক অসুবিধাব মধ্যে আছ তা নিয়ে কি তুমি আলাপ করতে চাও?
হাজতবাসেব কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
না। এটা কোনো সমস্যা নয়।
‘নি’দের যাবতীয় সমস্যা থেকে দূরে রাখার সব ব্যবস্থা প্রকৃতি করে রাখে। তোমার বেলাতেও তা করে রেখেছে। তুমি যখন যেখানে ছিলে সেখানেই তোমার পাশে রাখা হয়েছে দুজন করে অসাধারণ মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ, যারা মানসিকভাবে অন্যদের প্রভাবিত করতে পারে। ‘নি’রা প্রকৃতির প্রিয় সন্তান।
বুঝতে পারছি না।
নীলগঞ্জে তোমার দুজন সাহায্যকারী আছে। একজন কালিপদ, অন্যজন জালালুদ্দিন। এদের মানসিক ক্ষমতা অসাধারণ। তারা সব রকম বিপদে তোমাকে সাহায্য করবে। যদিও তারা তা জানে না। তোমাকে সাহায্য করার জন্যে আরো একজন সাহায্যকারীকে আনা হয়েছে। তার নাম জেবা। জেবাও তোমাকে সাহায্য করছে। ‘নি’ প্রকৃতির বিশেষ সৃষ্টি। এদের বক্ষা করার সব রকম দায়িত্ব প্রকৃতি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে।
এইসব শুনতে আমার ভালো লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে, আমাকে ঘুমুতে দিন।
স্বপ্ন ঝাপসা হয়ে গেল। মবিনুর রহমান গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেলেন। আরেকটি স্বপ্ন দেখলেন। সেই স্বপ্ন অপূর্ব ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ছে আকাশে। তাদের কলকাকলিতে চারদিক মুখরিত। তারা এক আনন্দময় সঙ্গীত সৃষ্টি করছে। আলো আঁধারী এক জগতে তাদের সঙ্গীত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
হেড মাস্টার সাহেবেব গরুর জন্যে জাবনা তৈরি করা হচ্ছে। কালিপদ মাথা নিচু করে কাজটা করছে। হেড মাস্টার সাহেব পাশে এসে দাঁড়ালেন। তার চোখে-মুখে চিন্তিত ভাব। মবিনুর রহমানের গমের ব্যাপারটা এত দূর গড়াবে তা তিনি ভাবেন নি। এ তো বড়ই যন্ত্রণা হলো।
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, গরু কিছু মুখে দিচ্ছে না, ব্যাপার কী কালিপদ?
কালিপদ চোখ তুলে তাকাল। চোখ নামিয়ে নিল না। তাকিয়েই রইল। এ রকম সে কখনো করে না। হেড মাস্টাব সাহেব অকারণেই খানিকটা অস্বস্তিবোধ করতে লাগলেন। প্রথম প্রশ্নটি দ্বিতীয়বার করলেন, গরু কিছু মুখে দিচ্ছে না, ব্যাপার কী কালিপদ?
কালিপদ বলল, সেইটা গরুরে জিজ্ঞেস করেন।
হেড মাস্টাব সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। হারামজাদার এত বড় সাহস! কী কথা বলছে? তারপরেও তাকিয়ে আছে। চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। জুতিয়ে হারামজাদার গাল ভেঙে দেওয়া দরকার।
কী বললা কালিপদ?
বললাম, গরু কেন খায় না সেইটা গরুরে জিজ্ঞাসা করেন। আমি গরুর ডাক্তার না।
তোমার সাহস অনেক বেশি হয়ে গেছে। তুমি কী বলছ তুমি নিজেও জানো না।
কালিপদ এইবার চোখ নামিয়ে নিয়ে ক্ষীণ গলায় বলল, আমার মাথার ঠিক নাই। নিরপরাধ একটা মানুষরে কোমরে দড়ি বাইন্দা নিয়া গেছে। আমার মাথার ঠিক নাই। কি বলতে কি বলছি, মনে কিছু নিয়েন না।
নিরপরাধ বলছি কেন? তুমি কি জানো না সে একটা মেয়ের সর্বনাশ করেছে? মেয়ের নাম সাবিহা।
এইগুলা দুষ্ট লোকের মিথ্যা রটনা।
তোমারে কে বলল মিথ্যা রটনা?
আমি জানি মিথ্যা রটনা। আফনেও জানেন, আফনে জানেন না। এমন না। অখনও সময় আছে স্যার।
কী বললা?
বললাম অখনো সময় আছে। সময় শেষ হইলে আফসোস করবেন।
কী বলছ তুমি?
অতি সত্য কথা বলতেছি। অতি সত্য কথা।
কালিপদ হাঁটা ধরল। বিস্মিত হেড মাস্টার বললেন, যাও কোথায় তুমি?
সাবিহা বেগমের কাছে যাই।
কালিপদ চলে গেছে। হেড মাস্টার সাহেবের পা কাঁপছে। ঠকঠক করে কাঁপছে। অকারণে ভয়ে সমস্ত শরীর ঝিমঝিম করছে। এরকম কেন হচ্ছে তিনি বুঝতে পারছেন না। পিপাসায় বুক শুকিয়ে কাঠ। তিনি আস্তে আস্তে মাটিতে বসে পড়লেন। হড়হড় করে বমি হয়ে গেল। বমিতে লাল লাল কী দেখা যাচ্ছে। রক্ত না-কি? হেড মাস্টার সাহেব ক্ষীণ স্বরে বললেন–ইয়া মাবুদ। ইয়া মাবুদ।
বাজারের একটা ঘরের সামনে কালিপদ দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে এক সময় বাইরে এসে বলল, কারে চান গো?
তোমারে চাই। তোমার নাম সাবিহা না?
হুঁ।
তুমি মিথ্যা মামলা কেন করছ?
কালিপদ তাকিয়ে আছে তীব্র দৃষ্টিতে। সাবিহা সেই দৃষ্টি থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারছে না। কালিপদ আবার বলল, কেন তুমি মিথ্যা মামলা করলা?
ওসি সাহেব বলছেন।
এখন ওসি সাহেবের কাছে আবার যাও। ওসি সাহেববে বলে–তুমি এইসবেব মধ্যে নাই।
জি আচ্ছা।
কখন যাইবা?
এখনই যাব।
যাও দিরং করবা না।
জে-না। আমি দিরং করব না।
সাবিহারও ঠিক হেড মাস্টার সাহেবের মতো হলো। গা হাত পা কাঁপছে। প্ৰচণ্ড বমি ভাব হচ্ছে। বুক ধড়ফড় করছে।
জালালুদ্দিন ওসি সাহেবের বাসায় উপস্থিত হয়েছেন। সমস্ত দিনের ভগাবহ ক্লান্তির পর ওসি সাহেব সবে ঘুমুতে গিয়েছেন। রাত বাজে নটা। এত সকাল সকাল তিনি ঘুমুতে যান না। আজ শরীরে কুলুচ্ছে না। এই সময় যন্ত্রণা। ওসি সাহেব বলে পাঠালেন, এখন দেখা হবে না।
জালালুদ্দিন বললেন, এখনই দেখা হওয়া দরকার। ওসি সাহেবের নিজের স্বার্থেই দেখা হওয়া দরকার।
ওসি সাহেব বের হয়ে এলেন। কঠিন গলায় বললেন, কী ব্যাপার?
গম চুরি মামলাটা নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি।
আমার সঙ্গে কী কথা?
হেড মাস্টার সাহেব স্বীকার করেছেন যে গম চুরির মামলাটা মিথ্যা মামলা।
কী বললেন?
যা সত্য তাই বললাম। গম চুরি বিষয়ক সব দায়-দায়িত্ব উনি নিয়েছেন। কাজেই মবিনুর রহমান সাহেবকে ছেড়ে দিতে হয়।
উনাকে অন্য কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে। কারণটা আপনাকে বলেছি… ।
হ্যাঁ বলেছেন। সাবিহা নামের ঐ মেয়ে বলছে যে, আপনি তাকে দিয়ে মিথ্যা মামলা কবিয়েছেন।
অনেকক্ষণ ওসি সাহেব কথা বলতে পারলেন না হচ্ছে কী এসব। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, সে বললে তো হবে না?
হবে। সে বললেই হবে। নীলগঞ্জের সব মানুষ এসে ভেঙে পড়বে থানার সামনে। আপনার মহাবিপদ ওসি সাহেব।
ভয় দেখাচ্ছেন না কি?
না, ভয় দেখাচ্ছি না। যা হতে যাচ্ছে সেটাই আপনাকে বলছি। মানুষ ক্ষেপে গেলে ভযঙ্কব হয়ে যায় ওসি সাহেব। ক্ষ্যাপা মানুষ বন্দুক মানে না।
আপনি কি মবিনুব রহমান সাহেবকে ছাড়িয়ে নিতে এসেছেন? সেটা করা যায়…
শুধু সেটা কবলে তো হবে না। আপনি যে অন্যায় করেছেন তার জন্যে সবার কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা কববেন। কানে ধরে দশবার উঠবোস করবেন।
কী বললেন?
অপমানসূচক একটা কথা বললাম, ওসি সাহেব। খুবই অপমানসূচক কথা। কিন্তু প্ৰাণে বাঁচতে হলে এ ছাড়া পথ নেই। হেড মাস্টার সাহেবও একই জিনিস কববেন। উনি রাজি হয়েছেন। বুদ্ধিমান লোক তো। বিপদ আঁচ করতে পেরেছেন। আপনার বুদ্ধি কম। আপনি বিপদ টের পাবেন শেষ সময়ে, যখন করার কিছু থাকবে না।
ওসি সাহেব জালালুদিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কম বুদ্ধির মানুষ না তিনি বিপদ টের পাচ্ছেন। ভালোই টের পাচ্ছেন। তার কপালে ঘাম জমছে। পা কাঁপছে। তৃষ্ণা বোধ হচ্ছে। প্রচণ্ড বমি ভাব হচ্ছে।
জেবার জ্বর অসম্ভব বেড়েছে।
জ্বর ঠিক কত তা বোঝা যাচ্ছে না। কারণ তার গায়ে থার্মোমিটার ছুঁয়ানো যাচ্ছে না। সে কাউকেই তার কাছে আসতে দিচ্ছে না।
আফজাল সাহেব রফিককে বললেন, মেয়ে না করছে বলে কেউ তার কাছে যাবে না এটা কেমন কথা? মাথায় পানি ঢালতে হবে। ডাক্তার ডেকে চিকিৎসা করাতে হবে।
রফিক বলল, কোনো লাভ হবে না। বাবা। ওর অনিচ্ছায় কিছু করা যাবে না।
যাবে না কেন?
আপনি বুঝবেন না বাবা, অনেক সমস্যা আছে।
জ্বরে তোর মেয়ে পুড়ে যাচ্ছে আর তুই দেখবি না?
এরকম ভয়ঙ্কর জ্বর তার মাঝে মাঝে হয়, আবার আপনাতেই সারে। ডাক্তাব ডাকতে হয় না।
জেবা ক্ষিপ্ত গলায় বলল, তোমরা সবাই এখানে ভীড় করে আছ কেন? তোমরা যাও। যাও বললাম। আর ঘরে বাতি জ্বলিয়েছ কেন? বললাম না বাতি চোখে লাগে? বাতি নিভিয়ে দাও।
বাতি নিভিয়ে রফিক সবাইকে নিয়ে বেবী হয়ে এলো। তার মিনিট দিশেকের ভেতর জেবা বের হয়ে এলো। সহজ স্বাভাবিক মানুষ। জ্বর নেই। চোখে-মুখে ক্লান্তির কোনো ছোঁয়াও নেই। যেন ঘুমুচ্ছিল, ঘুম থেকে উঠে এসেছে। জেবা বলল, জ্বর সেবে গছে। ফুপু কোথায়?
রূপা বারান্দাতেই ছিল। সে চোখ তুলে তাকাল। কিছু বলল না। জেবা বলল, ফুপু তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। আমার সঙ্গে এসো।
জেবা রূপাকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। ঘর অন্ধকার। বাতি জ্বালাল। হাসতে হাসতে বলল, তোমার জন্যে খুব ভালো খবর আছে ফুপু।
কী খবর?
তোমার স্যারকে ওরা ছেড়ে দেবে। ছেড়ে না দিয়ে অবশ্যি উপায়ও নেই। হি-হি-হি।
তুমি কীভাবে জানো?
যেভাবেই হোক জানি। অনেক রাতে তিনি একা একা বাড়ি ফেবার সময। এই বাড়িতে আসবেন।
তাও তুমি জানো?
হ্যাঁ, তাও জানি। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
না।
আমি সব সময় সত্যি কথা বলি ফুপু। তবু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। তাতে কিছু অবশ্যি যায় আসে না।
তুমি মেয়েটা খুব অদ্ভুত জেবা।
সব মানুষই অদ্ভুত ফুপু। তুমিও অদ্ভুত। পৃথিবীটাও অদ্ভুত।
তুমি একেবারে বড়দের মতো কথা বলছি।
মাঝে মাঝে আমি বড়দের মতো কথা বলি। বড়রা যদি ছোটদেব মতো কথা বললে দোষ না হয় তাহলে ছোটরা বড়দের মতো কথা বললে দোষ হবে কেন? আমি ঘুমুতে যাচ্ছি ফুপু।
রাত এগারোটার দিকে এ বাড়ির সবাই ঘুমুতে গেল। ঘুমুতে যাবার আগে আফজাল সাহেব রূপাকে ডেকে বললেন, রূপা, তুমি আগামীকাল রফিকের সঙ্গে খুলনা চলে যাবে।
রূপা বলল, আচ্ছা।
ওখানেই থাকবে। পরীক্ষার সময় শুধু এখানে এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে।
আচ্ছা।
তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। এখন কিছুই বলব না। পরে বলব।
আচ্ছা।
তোমার মাকে বলেছি তোমার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিতে।
ঠিক আছে বাবা।
বাইরে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাস শো-শো করছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে একে একে। সবার শেষে ঘুমুতে গেল মিনু। সেও ঘুমুতে যাবার আগে রূপার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলল। এমনভাবে বলল যেন কিছুই হয় নি। সব স্বাভাবিক আছে। আগের মতোই আছে।
রূপা, আমাদের সঙ্গে যেতে তোমার আপত্তি নেই তো?
আপত্তি হবে কেন? খুলনা আমার খুব যেতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা ভাবি, তোমাদের ওখান থেকে সুন্দরবন কী অনেক দূব?
না–কাছেই।
আমাকে সুন্দরবন দেখাবে না?
অবশ্যই দেখাব।
সুন্দরবনে ডাকবাংলা আছে? ডাকবাংলায় থাকতে ইচ্ছা করে ভাবি।
ফবেষ্টের ডাকবাংলা আছে। তোমার ভাইকে বলে ব্যবস্থা করে দেব।
ঠিক আছে। ভাবি, তুমি ঘুমুতে যাও। খুব রাত অবশ্যি হয় নি। এগারোটা বাজে। তবু কেন জানি মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।। তাই না ভাবি?
মিনু ঘুমুতে গেল। রূপা নিজের ঘরে ঢুকে সুন্দর করে সাজল। চুল বেণী করল। শাড়ি পাল্টাল। অনেকদিন পব চোখে কাজল পরল।
সে অপেক্ষা করছে। জেবার কথ সে বিশ্বাস করছে। এই মেয়েটা কোনো এক বিচিত্ৰ উপায়ে ভবিষ্যতের কথা বলতে পাবে। কাঁপা তার প্ৰমাণ পেয়েছে।
মবিনুর রহমানকে ছেড়ে দিয়েছে রাত এগারোটায়।
ওসি সাহেব বললেন, চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। মবিনুর রহমান বললেন, না না, পৌঁছাতে হবে না।
ওসি সাহেব বললেন, আপনি আমার ওপর রাগ করবেন না ভাই। ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দেবেন।
ঠিক আছে। মানুষ মাত্রেই ভুল করে।
বৃষ্টির মধ্যে যাবেন কী করে? একটা ছাতা আর টর্চ লাইট দিয়ে দি।
টর্চ লাইট লাগবে না। ছাতা দিতে পারেন।
মবিনুর রহমানকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্যে জালালুদ্দিন এবং কালিপদ ছিল। তিনি অনেক কষ্টে তাদের বিদেয় করলেন। তার কেন জানি একা একা বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা! করছে। থানার সামনে জড়ো হওয়া মানুষজন কেউই এখন নেই। সবাই ভীড় করেছে নদীর তীরে। নদী ভাঙতে শুরু করেছে। এমনভাবে নদী আগে কখনো ভাঙে নি। নদী ভাঙার দৃশ্য একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর।
মবিনুর রহমান ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছেন। বৃষ্টি ছাতা মানছে না। বাতাসের কারণেই খুব ভিজছেন। নিজে ভিজছেন তা নিয়ে তিনি চিন্তিত না। টেলিস্কোপটা ভিজে যাচ্ছে এই নিয়েই তিনি চিন্তিত।
রূপাদের বাড়ির কাছে আসতেই তার মনে হলো তাকে যে ছেড়ে দেয়া হয়েছেএই খবরটা রূপাদের দিয়ে যাওয়া উচিত। রাত অবশ্যি অনেক হয়েছে, তবু যাওয়া যায় কারণ বাতি জ্বলছে। এখনো কেউ না কেউ জেগে আছে। সম্ভবত রূপাই জেগে আছে। সে অনেক রাত পর্যন্ত জাগে। পড়াশোনা করে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই তানভির দবাজা খুলল। টেলিস্কোপ বগলে মবিন্নুর রহমান দাঁড়িয়ে। মবিনুর রহমান অপ্ৰস্তুত গলায় বললেন, ওবা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আপনারা চিন্তা করবেন। এই ভেবে খবরটা দিতে এলাম। ভালো আছেন?
জি ভালো আছি।
তানভির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার ইচ্ছা নয় মানুষটা ঘরে ঢুকুক। তানভির বলল, রফিক সাহেবের ছোটমেয়েটা অসুস্থ। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। এখন ঘুমুচ্ছে। কাউকে ডাকা যাবে না।
মবিনুব রহমান বললেন, আপনি খবর দিয়ে দিলেই হবে। বলবেন আমি এসেছিলাম।
আমি বলব।
কাল সন্ধ্যায় রূপাকে পড়াতে আসব। বেশ কিছুদিন মিস হলো। আর হবে না।
কাল আসতে হবে না। রূপা কাল চলে যাচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছে?
খুলনা যাচ্ছে। রফিক সাহেব সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন।
এই সময় বেড়াতে যাওয়া কি ঠিক হবে? পরীক্ষার দেরি নেই।
সেটা ওদের ব্যাপার। ওরা যা ভালো বুঝে করবে।
শুধু ওদের ব্যাপার হবে কেন? আমারও ব্যাপার। আমি ওর শিক্ষক।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে রূপা তানভিরের পেছনে এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় তানভিরকে বলল, আপনি স্যারকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন? দেখছেন না উনি ভিজছেন? দরজা ছেড়ে দাঁড়ান।
তানভির দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। রূপা বলল, স্যার ভেতরে আসুন।
এখন আর ভেতরে আসব না। রূপা। তোমাদের খবরটা দিতে এলাম। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ভুল করে ধরেছিল। মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ওসি সাহেব খুব লজ্জা পেয়েছেন। আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
স্যার আপনি ভেতরে আসুন। আপনাকে আসতেই হবে।
মবিনুর রহমান ভেতরে ঢুকলেন। রূপা বলল, গামছা দিচ্ছি। মাথা মুছে আরাম করে বসুন। আপনি কি রাতে কিছু খেয়েছেন?
হ্যাঁ, ওসি সাহেব তার বাসা থেকে খাবার এনে খাইয়েছেন।
আমি চা এনে দিচ্ছি। আদা চা করে দেব?
দাও। বাসার আর মানুষজন কোথায়? সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?
জি।
তানভির দাঁড়িয়ে আছে। অপলক দেখছে রূপাকে। মেয়েটা আজ এত সুন্দর করে সাজল কেন? সে কি জানত তার স্যার আসবেন?
রূপা বলল, তানভিরের দিকে তাকিয়ে আপনি আপনার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। স্যারেব সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে। আমি কাল খুলনায় চলে যাচ্ছি। কথাগুলি স্যারকে বলে যাওয়া দরকার।
কথাগুলি সকালে বললে হয় না?
না হয় না। আপনার কাছে হাত জোড় করছি।
মবিনুর রহমান বললেন, আমি না হয় সকালে আসব।
না। আপনি চুপ কবে বসে থাকুন।
তানভির ঘর ছেড়ে বারান্দায় গেল। তার মন বলছে এই দুজনকে এখানে রেখে বাইরে দাড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না। ব্যাপারটা অন্যদের জানানো দরকার। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে একজন বাইরের মানুষ। তার কি উচিত অন্যদের জাগানো? তানভির সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছে। বাবান্দায় প্ৰবল বাতাস। দেয়াশলাই ধরানো যাচ্ছে না।
মবিনুর বহমান বিস্মিত মুখে বসে আছেন। রূপার মধ্যে খানিকটা পবিবর্তন তিনি লক্ষ করছেন। কিন্তু পরিবর্তনের ধরনটা ঠিক ধরতে পারছেন না। মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে। অবশ্যি সুন্দর মেয়েকে সুন্দর তো লাগবেই।
রূপা তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, স্যার আপনি কি এখন বাড়িতে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
নদী নাকি খুব ভাঙছে? আপনার বাড়ি ভেঙে পড়েছে কি-না কে জানে?
গিয়ে দেখি।
রূপা বলল, আমি কিন্তু স্যার আপনার সঙ্গে যাব।
আমার সঙ্গে যাবে মানে?
আপনার সঙ্গে আপনার বাড়িতে যাব। আমি এখন থেকে আপনার সঙ্গে থাকব। মবিনুর রহমান দীর্ঘ সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েটাকে এখন অচেনা লাগছে। একেবারেই অচেনা। যেন কোনোদিন এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় নি।
আমার সঙ্গে থাকবে কীভাবে?
কীভাবে তা জানি না। আমি থাকব।
আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না রূপা।
আপনি সব কথা বুঝেন আর আমার সামান্য কথা বুঝেন না?
না কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি এখন আপনার সঙ্গে যাব। গিয়ে যদি দেখি আপনার বাড়ি নদীতে তলিয়ে গেছে তাহলে নৌকায় রাতে থাকব। অবশ্যি এই অবস্থায় নৌকায় থাকা খুব বিপদজনক হবে। তাই না স্যার?
মবিনুর রহমান হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মনে হতে লাগল পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে। মাঝে মাঝে তিনি যেমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন এও তেমন কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন।
স্যার।
বলো।
সবচে ভালো হয় যদি আমরা দুজন এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই যাতে কেউ আমাদের খুঁজে বের করতে না পারে।
মবিনুর রহমান থেমে থেমে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে রূপা। তুমি কী বলছ নিজেও জানো না। তুমি খুলনায় যাও। বাইরে গেলে ভালো লাগবে।
স্যার, আপনার ধারণা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
কিছু একটা গণ্ডগোল তো অবশ্যই হয়েছে। আমি উঠি, কেমন?
বাড়ি যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
যদি অনেক রাতে একা একা আপনার বাড়িতে উপস্থিত হই আপনি কী কববেন? আমাকে এখানে এনে দিয়ে যাবেন?
অবশ্যই দিয়ে যাব।
রূপা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখতে দেখতে তার চোখ ভিজে উঠল। মবিন্নুর রহমান উঠে দাড়ালেন। তার ইচ্ছা করছে এই পাগলী মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে দুএকটা সান্ত্বনার কথা বলতে। তা বোধহয় ঠিক হবে না। এ কী ভয়াবহ সমস্যা! সমস্যার ধরন এখনো তার কাছে পরিষ্কার নয়। এই মেয়ে কী চায় তার কাছে?
রূপা যাই।
রূপা কিছু বলল না। চেয়ার ছেড়ে উঠেও দাঁড়াল না। মবিনুব বহমান বাবান্দায় এসে দেখেন তানভির দাঁড়িয়ে আছে। তিনি নিচু গলায় বললেন, আমি যাচ্ছি। আপনি রূপার দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। ও বড় ধরনের কোনো সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা ধারণা। আপনি লক্ষ্য রাখবেন রূপা যেন রাতে বাড়ি থেকে বের না হয়।
তানভির কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মবিনুর রহমান অসহায় বোধ করছেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আপনি বরং রূপার বাবা-মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলুন। ওদের বলুন মেয়েটার দিকে লক্ষ রাখতে।
লক্ষ্য রাখা হবে। আপনি আপনার বাড়িতে যান। রূপাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।
মবিনুর রহমান বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। নদী আশেপাশের পুরো অঞ্চল ভেঙে দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে–আশ্চর্য তার বাড়িটি ঠিকই আছে। নৌকাও বাধা আছে। তিনি জানতেন কিছু হবে না। প্রকৃতি তাঁকে রক্ষা করবে। তিনি একজন নি। তাঁকে সব রকম সমস্যা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রকৃতির। তিনি প্রকৃতির প্রিয় সন্তান।
ভেবেছিলেন রাতে নৌকায় ঘুমুবেন। নৌক যেভাবে দুলছে তাতে তা সম্ভব না। তিনি নিজের ঘরেই ঘুমুতে এলেন। যাবার সময় দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে গিয়েছিলেন, এখন তালা খোলা। কেউ ঘরে ঢুকেছিল নিশ্চয়ই। ঘরের জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনি আছে। যে এসেছিল সে কোনো কিছুতেই হাত দেয় নি।
চায়ের তৃষ্ণ হচ্ছে। তিনি চুলায় কেতলি বসিয়ে দিলেন। নদীর শো-শো শব্দের সঙ্গে স্টোভের শো শী শব্দ মিশে অন্য এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। চুলার সামনে বসে থাকতে থাকতে তাঁর হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবী শব্দময় হলে কেমন হতো? যদি এমন একটি জগৎ থাকত যেখানে সবই শব্দময়। গাছ। অনবরত শব্দ করে যাবে। একেক গাছ থেকে একেক ধরনের শব্দ আসবে। পাথর থেকে শব্দ হবে। বড় পাথরের এক ধরনের শব্দ, ছোট পাথরের এক ধবনের শব্দ। মানুষের শবীরে যেমন ঘাণ থাকে তেমনি শব্দও থাকবে। কারোর গা থেকে আসবে মধুর সঙ্গীতময় শব্দ। কারো গা থেকে আসবে বিরক্তিকর শব্দ। এ রকম একটি জগতে রূপার গা থেকে কেমন শব্দ আসবে? নূপুরে ছটফট ধরনের শব্দ?
ভাবতে ভাবতেই তার এক ধরনের ঘোবের মতো হলো। তিনি বিচিত্ৰ সব শব্দ শুনতে লাগলেন। কেরোসিনের ক্টোভ থেকে শো-শো শব্দ ছাড়াও ক্টোভেব নিজস্ব শব্দ আসছে। পানি ভর্তি গ্লাস থেকে এক ধবনের শব্দ আসছে, আবার কেতলির ফুটন্ত পানি থেকে অন্য ধরনের শব্দ। কী পাশ্চৰ্য্য। তিনি ঘোরের মধ্যেই শুনলেন–
হচ্ছে তোমার হচ্ছে! এই তো তুমি জগৎ তৈরি করেছ। শব্দময় জগৎ। অপূর্ব! অপূর্ব!
আপনারা কি নি?
হ্যাঁ আমরা নি।
আমরা তোমার ক্ষমতায় বিস্মিত।
আমি তাহলে একটি শব্দময় জগৎ তৈরি করেছি?
হ্যাঁ করেছ।
আমি আপনাদের এই রসিকতার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। পৃথিবী সব সময়ই শব্দময়। শব্দের উৎপত্তি কম্পনে। প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব কম্পনাংক আছে। সেই অর্থে প্রতিটি বস্তুই শব্দময়।
অবশ্যই প্রতিটি বস্তু শব্দময়। কিন্তু তুমি কল্পনা করেছ এমন মানুষের যারা এই শব্দ ধরতে পারে। সেই অর্থে তোমার জগৎটি নতুন।
কোথায় সেই জগৎ?
সেই জগতের অবস্থান তোমার মধ্যেই তবে ভিন্ন মাত্রায় বলেই তোমার ধরাছোয়ার বাইরে। তুমি আরো ভাব। কল্পনাকে আরো ছড়িয়ে দাও। নতুন নতুন জগৎ সৃষ্টি কর।
তাতে আমার লাভ?
তুমি সৃষ্টির আনন্দ পোচ্ছ। এই আনন্দই তোমার লাভ।
যে সৃষ্টি আমি দেখছি না। সেই সৃষ্টিতে কোনো আনন্দ থাকার কথা নয়।
তুমি কি কোনো আনন্দই পাচ্ছে না?
না।
তুমি যখন শব্দময় জগতের কথা ভাবছিলে তখন কি আনন্দ পাও নি?
পেয়েছি।
সেই আনন্দ কি অসম্ভব তীব্র ছিল না?
হ্যাঁ ছিল
ঐটিই তোমার লাভ। শব্দময় জগতের কথা ভাবতে ভাবতে তোমার নিজের জগৎও হয়ে গেল শব্দময়। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
বিচিত্ৰ!
শুধু বিচিত্র? আর কিছু না? আনন্দে কি তখন তোমার শরীর ঝনঝনি করছিল না?
করছিল।
তোমার কল্পনা যতই উন্নত হবে তোমার আনন্দের পরিমাণ হবে ৩তই তীব্ৰ। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
কেন?
কারণ তোমার আনন্দ আমাদেরও আনন্দ। আমরাও তো নি তোমার জন্ম থেকেই আমরা তোমার ওপর লক্ষ রাখছি। তোমার প্রতিটি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করছি।
প্রতিটি কার্যকলাপ?
হ্যাঁ, প্রতিটি কার্যকলাপ। তুমি যেন নীলগঞ্জ আস সে জন্যে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুমি যাতে এই ভাঙা বাড়িতে এসে উঠ সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কারণ তোমার ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য নির্জন একটি বাড়ি প্রয়োজন ছিল।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তাই। তুমি টেলিস্কোপের কথাই চিন্তা করে দেখ। একটি প্রথম শ্রেণীর এস্ট্রনোমিক্যাল টেলিস্কোপ তুমি ব্যবহার করছ। টেলিস্কোপটি তুমি কিনেছ একটি পুরানো ফার্নিচারের দোকান থেকে। তুমি সেখানে গিযেছিলে ইজিচেয়ার কিনতে। মনে আছে?
আছে। তাহলে কি আপনারা বলতে চান সব কিছুই পূর্ব নির্ধারিত?
হ্যাঁ।
রূপা মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয়ও কি পূর্ব নির্ধারিত?
হ্যাঁ পূর্ব নির্ধারিত। বিশেষ প্রয়োজনেই রূপাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কী প্রয়োজন?
তুমি যে সব জগৎ তৈরি করছ, সেসব জগতের মানুষ তোমার মতোই আবেগশূন্য। তীব্র আবেগের সঙ্গে তোমার পরিচয়ের প্রয়োজন হয়েছে সে কারণেই, যাতে তোমার জগতের মানুষদের তুমি অন্য রকম করে তৈরি করতে পোর।
আপনারা কি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?
পারি না। আবার এক অর্থে পারি।
রূপা এখন কি করবে বলতে পারেন?
না, পারি না। প্রকৃতি খানিকটা অনিশ্চয়তা রেখে দেয়। রূপা ঝড়-বৃষ্টির রাতে এখানে ছুটে আসতে পারে, আবার আসতে নাও পারে, আবার অন্য কিছু করতে পারে।
তাহলে অনিশ্চয়তা সামান্য বলছেন কেন? অনেকখানি অনিশ্চয়তা।
হ্যাঁ, অনেকখানি।
আপনারা বলছেন নি-রা প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন। এই অনিশ্চয়তা তারা দূর করতে পারে না।
না। অনিশ্চয়তা প্রকৃতিরই নিয়ম। প্রকৃতি তার নিজের নিয়ম ভঙ্গ করে না।
মবিনুর রহমানেব ঘোর কেটে গেল। কেতলিতে পানি টগবগ করে ফুটছে। তিনি চা বানিয়ে খেলেন। হাওয়ার বেগ আরো বাড়ছে। তুমুল বর্ষণ। ধুপ ধুপ শব্দে নদী ভাঙতে ভাঙতে এগুচ্ছে। যে হারে এগুচ্ছে তাতে মনে হয় আজ রাতের মধ্যেই নদী তার বাড়ি গ্ৰাস করে নেবে। তিনি তেমন চিন্তিতবোধ করছেন না। বরং ভালোই লাগছে। তিনি রাত দুটোর দিকে ঘুমুতে গেলেন। চাদর মুড়ি দিয়ে সবে শুয়েছেন। হাত বাড়িয়েছেন হারিকেনের সালতা কমিয়ে দেবার জন্যে। এমন সময় দরজায় প্ৰবল ধাক্কার শব্দ হলো। তিনি বললেন, কে?
বাইরে থেকে তানভিরের গলা শোনা গেল।
দরজা খুলুন মাস্টার সাহেব।
কী ব্যাপার?
দরজা খুলুন। তারপর বলছি।
তিনি দরজা খুললেন। তানভির একা নয়। রূপার দুই ভাই–রফিক এবং জহিরও তার সঙ্গে এসেছে। রফিক কঠিন গলায় বলল, রূপা কি আপনার এখানে?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, না তো!
আপনি কী সত্যি কথা বলছেন মাস্টাব সাহেব?
মিথ্যা বলার প্রয়োজন কখনো বোধ করি নি। রূপাকে কী পাওয়া যাচ্ছে না?
তানভির বলল, আমরা আপনার নৌকাটা একটু দেখব। নৌকা কী ঘাটে বাধা আছে?
থাকার কথা। আসুন যাই।
নৌকা বাতাসের প্রবল ঝাণ্টায় উলট পালট খাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে দড়ি ছিঁড়ে যাবে। রফিক বলল, আপনি রাতে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন তখন রূপা আপনাকে কি বলেছে?
আমার এখানে আসতে চেয়েছিল, আমি নিষেধ করেছিলাম।
তিনজনই ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জহির হিসহিস করে চাপা গলায় বলল, রূপার যদি কিছু হয় তাহলে আমি আপনাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করব। কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না। কেউ না।
তারা তিনজন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে।
মবিনুর রহমান একা নদীর পাড়ে দাঁড়িযে আছেন। অন্ধকার রাতে, ঠাণ্ডা হাওয়ায় বৃষ্টিতে ভিজতে তাঁর ভালো লাগছে। চোখের সামনে নদী। নদীর জল, সমুদ্রের জলের মতোই অন্ধকারে জ্বলছে। অদ্ভুত লাগছে তাকিয়ে থাকতে। তাঁর ভালো লাগছে। এক ধরনের তীব্র আনন্দবোধ করছেন।
সমস্ত রাত তিনি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ভোরবেলা প্রবল জ্বর নিয়ে ঘরে ফিরলেন। হাত-পা অবশ হয়ে আছে। ভেজা কাপড় বদলাবার শক্তিও নেই। তিনি ভেজা কাপড়েই বিছানায় শুয়ে পড়লেন। জ্বর বাড়তেই থাকল। জ্বরের ঘোবে বেশ কয়েকবাব তাঁর মনে হলো অসংখ্য বুড়ো মানুষ তাঁর দিকে তাকিয়ে মিনতির সঙ্গে বলছে–তুমি অসম্ভব ক্ষমতাধর একজন নি। তোমার অকল্পনীয় ক্ষমতা। কিন্তু তুমি সীমা লজয়নের চেষ্টা করবে না। প্রকৃতি সীমা লঙ্ঘনকারীকে সহ্য করে না। প্রকৃতি কাউকে সীমা লজন করতে দেয় না। কাউকেই না। তোমাকেও দেবে না।
ভোববেলায় সূর্য উঠার আগেই কালিপদ এলো মবিনুর বহমান সাহেবেব খোঁজ নিতে। সে আগেই আসত, মহা সমস্যায় পড়ে আসতে পারে নি। সমস্যা তার একাব না, সবার সমস্যা। নদী ভাঙতে ভাঙতে এগুচ্ছে। অতি দ্রুত এগুচ্ছে। লোকজন সরিয়ে দিতে হচ্ছে। বাজারের পুরোটাই চলে গেছে নদীর ভেতর। ঘটনা ঘটেছে অন্ধকার রাতে। লোকজন বুঝতেই পারে নি এত দ্রুত নদী এগুবে। ছসাত জন মানুষ মারা গেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু একজনের ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আফজাল সাহেবের মেয়ে রূপা। তার মৃতদেহ পাওয়া গেছে। অন্য কারো কোনো চিহ্নই এখনো পাওয়া যায়
কালিপদ এসেছে ছুটতে ছুটতে, ভয়াবহ আতঙ্ক নিয়ে। হয়তো দেখবে মবিন্নুর রহমান স্যারের শোনো চিহ্নই নেই। সে দূর থেকে বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল–নদীর এই অংশটি মোটামুটি শান্ত। ভাঙা বাড়ি এখনো টিকে আছে। ঘাটে নৌকা বাঁধা। মনে হচ্ছে নদী খানিকটা জায়গা ছেড়ে দিয়ে এগুচ্ছে।
ঘরে ঢুকে কালিপদ দেখল মবিনুর রহমান ভেজা কাপড়ে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন। তার চোখ রক্তবর্ণ। হাত-পা কাঁপছে।
কালিপদ বলল, কী হইছে স্যার?
মবিনুর রহমান জড়ানো গলায় বললেন, কে?
স্যার আমি কালিপদ।
তুমি কেমন আছ কালিপদ?
আপনের কী হইছে স্যার?
জ্বর আসছে বলে মনে হয়।
কালিপদ দ্রুত ঘরের জিনিসপত্র গুছাচ্ছে। মানুষটাকে সরিয়ে দিতে হবে। রাগী নদী কাউকে ক্ষমা করে না। যে কোনো মুহুর্তে এখানে চলে আসবে।
স্যার।
হুঁ।
এইখানে থাকা যাবে না স্যার।
অসুবিধা হবে না। কালিপদ তুমি চলে যাও।
আমি স্যার যাব না। আপনারে না নিয়া আমি যাব না।
মবিনুব রহমান ক্ষীণ গলায় বললেন, একটা খবর নিয়ে আসা। রূপা মেয়েটাকে পাওয়া গেছে কি-না জেনে আস।
কালিপদ ভেবে পেল না। দুঃসংবাদ স্যারকে দেয়া যাবে কি-না। শরীরের এই অবস্থায় কি দুঃসংবাদ দেয়া যায়? তবে মানুষটা খুব শক্ত। এবং রূপাকে যে পাওয়া যাচ্ছে না তাও এই মানুষটা জানে।
কালিপদ।
জি।
খবর নিয়ে আস।
খবর স্যার জানি। উনার লাশ পাওয়া গেছে। বাকখালির কাছে। পরনে নীল শাড়ি। গা ভরতি গয়না।
ও আচ্ছা।
তাদের বাড়ির সবাই খুব কানতেছে।
মবিনুব রহমান চোখ বন্ধ করে ফেললেন। এই খবর শোনার জন্যে তিনি মানসিকভাবে প্ৰস্তৃত ছিলেন বলে ভেবেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি মানসিকভাবে প্ৰস্তুত না। নিজেকে এক লাগছে। মনে হচ্ছে একটি প্ৰকাণ্ড গ্রহে তিনি যেন একা জেগে। আছেন। বিশাল একটা গ্ৰহ–গাছ-পালা, ফুল-ফল, নদী, সাগর… ..কিন্তু একটিমাত্র মানুষ। দ্বিতীয় প্রাণী নেই। কল্পনা করতে ভালো লাগছে।
তিনি একজন নি। বলা হয়েছে অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন নি। সৃষ্টির আদিতে ঈশ্বর বললেন–হও। জগৎ তৈরি হলো শূন্য থেকে। এই জগৎ কোথায়? ছিল ঈশ্বরের কল্পনার। নিরাও কল্পনা থেকে জগৎ সৃষ্টি করতে পারে। অন্তত তাঁকে সে রকমই বলা হয়েছে।
রূপাকে কি তিনি সষ্টি করতে পারেন না? এই জগতেই কি তা সম্ভব?
মবিনুর বহমান উঠে বসলেন। এক ধবনের ঘোরে তাঁর শরীর আচ্ছন্ন। রূপা মেয়েটির প্রতি প্ৰচণ্ড রকম আবেগ তিনি বোধ করছেন। এই আবেগ এই তীব্র আকর্ষণ কোথায় লুকিয়ে ছিল।
কালিপদ বলল, আপনে স্যার চলেন। নদী ভাঙতেছে।
তিনি কিছুই শুনছেন না। তাঁর সমস্ত চিন্তা-চেতনা কেন্দ্রীভূত। রূপার কথা ভাবছেন গভীরভাবে ভাবছেন। তাঁর সমস্ত শরীর থরথর কবে কাঁপছে। তিনি কল্পনায় দেখছেন রূপা বসে আছে নৌকায়। রূপার গায়ে হালকা নীল রঙের শাড়ি। হাত ভর্তি কাচের চুড়ি। পান খেয়ে সে ঠোঁট লাল করেছে। গুনগুন করে গান গাইছে। নৌকায় গাদা করে রাখা বইপত্র গুছিয়ে রাখছে।
মবিনুর রহমান এখন আর চারপাশের কিছু স্পষ্ট দেখতে পারছেন না। সব ধোঁয়াটে হয়ে গেছে। কালিপদ ব্যাকুল হয়ে তাকে ডাকছে, তিনি সেই ডাক শুনতে পাচ্ছেন না। এর মধ্যেও তিনি স্পষ্ট শুনলেন
মবিন্নুর রহমান! মবিনুর রহমান।
তিনি জবাব দিলেন না। তাঁকে ডাকছে নি রা। অসংখ্য বৃদ্ধের মুখ এখন তিনি দেখতে পারছেন। তারা সবাই ভয়ানক উদ্বিগ্ন।
মবিনুর রহমান। মবিনুর রহমান।
বলুন।
তুমি এসব কী করছ? তুমি সীমা লঙ্ঘন করছি। তুমি মেয়েটিকে এই জগতেই সৃষ্টি করার চেষ্টা করছি। এই চেষ্টা তুমি করতে পার না।
আমি পারি। আমি একজন নি। নিদের ক্ষমতা অসাধারণ।
প্রকৃতি সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করে না।
যে প্রকৃতি সীমা বেঁধে দেয় তাকেও আমি পছন্দ করি না।
তুমি বিরাট ভুল করেছ মবিনুর রহমান। এই পৃথিবীতে দীর্ঘদিন পর পর একজন নি আসে। তুমি এসেছ। কল্পনাতীত ক্ষমতা তোমাকে দেয়া হয়েছে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার করবে না।
আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।
রূপাকে তোমার প্রয়োজন নেই।
কে বলল প্রয়োজন নেই।
আমরা বলছি।
তোমরা বললে তো হবে না। আমার প্রয়োজন আমি বুঝব। আমি এই মেয়েটিকে আমার জগতেই তৈরি করব।
মবিনুর রহমান।
আমাকে ডাকাডাকি করে কোনো লাভ হবে না। আমি আমার প্রচণ্ড ক্ষমতা অনুভব করছি। প্রতিটি রক্ত কণিকায় অনুভব করছি। আমি সেই ক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করব।
মবিনুর রহমান কিছুক্ষণের জন্যে বাস্তবে ফিরে এলেন। কালিপদ চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে।
কালিপদ!
জি।
একটু বাইরে গিয়ে দেখ তো নৌকায় কি কাউকে দেখা যায়?
কালিপদ ঘর থেকে বের হয়ে চমকে উঠল। সে ছুটে নদীর কাছে এলো। নদী ভাঙতে শুরু করেছে। ভয়ঙ্কর গর্জন হচ্ছে নদীতে। নৌকা দুলছে কাগজের নৌকার মতো। আশ্চর্য ব্যাপার, নৌকার ভেতর কাকে যেন দেখা যায়। কালিপদ বলল, কে কে? কেউ জবাব দিল না। কিন্তু কালিপদ স্পষ্ট শুনল কেউ-একজন যেন গুনগুন করে গান গাইছে। মিষ্টি মেয়েগলা।
কালিপদ আবার ডাকল–কে? নৌকার ভেতরে কে? আশ্চৰ্য, কথা বলে না। মানুষটা কে?
মবিনুর রহমান বের হয়ে এলেন। কালিপদের দিকে তাকিয়ে বললেন–তুমি চলে যাও কালিপদ। এক্ষুণি যাও। এক্ষুণি।
মবিনুর রহমানের গলায় এমন কিছু ছিল যে কালিপদ ভয় পেয়ে ছুটে চলে গেল। সে দৌড়াতে দৌড়াতে যাচ্ছে। একবারও পেছন ফিরে তাকাচ্ছে না।
নদী ভাঙতে ভাঙতে এগুচ্ছে মবিনুর রহমানের দিকে। তিনি তা দেখেও দেখছেন না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তাকিয়ে আছেন নৌকার দিকে। আকাশ ঘন কৃষ্ণবর্ণ। মেঘেব পর মেঘা জমছে। ভয়াবহ দুর্যোগের আর দেরি নেই। মবিনুর বহমান উঁচু গলায় ডাকলেন–রূপা, রূপা! নৌকার ভেতব থেকে কাচের চুড়িব শব্দ হচ্ছে। নীল শাড়ির আভাস খানিকটা পাওয়া গেল। ফর্সা চুড়ি পরা হাত এক পলকের জন্যে বের হয়ে এলো। মবিনুর রহমান চোখ বন্ধ করে আছেন। তিনি তাঁর পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করবেন।
তিনি জানেন প্রকৃতি এই অনিয়ম সহ্য করবে না। নদী কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে গ্ৰাস করবে। তিনি আবার ডাকলেন–রূপা, রূপা!
রূপা নৌকাব ভেতর থেকে বের হয়ে এলো।
তিনি কোমল গলায় বললেন, কেমন আছ রূপা?
রূপা বলল, স্যার আমার ভীষণ ভয় লাগছে।
নদী এগুচ্ছে। নদীব জল ফুলেফেপে উঠছে। মবিনুর বহমান দাঁড়িয়ে আছেন।
রূপা আবার বলল, স্যার আমার ভয় লাগছে। খুব ভয় পাচ্ছি স্যার।
মবিনুর রহমান হাসলেন। তাঁর পায়ের নিচের মাটি কাঁপছে। প্রকৃতি আর তাঁকে সময় দেবে না। তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি হাসিমুখে রূপার দিকে তাকিয়ে আছেন।