সবাই এক সঙ্গে কথা বলছেন। তাঁদেব গলার স্বর এক রকম। সবাই এক সঙ্গে কথা বলার জন্যই বোধকরি এক ধরনের অধ্যাভাবিক রেজোনেন্স তৈরি হচ্ছে। শব্দটা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। শরীরের প্রতিটি কোষ ঝিনঝন করে বাজছে। তার চেয়েও বড় কথা, ঘুমের মধ্যেই মবিনুর রহমানের মনে হলো এই বৃদ্ধদের তিনি আগেও স্বপ্ন দেখেছেন।
অতি দূর শৈশবে। যার স্মৃতি অস্পষ্টভাবে হলেও রয়ে গেছে।
মবিনুর রহমান!
জি।
তুমি কি মাতৃগর্ভের স্মৃতি মনে করতে পারছ?
না।
মাতৃগর্ভে যখন ছিলে তখন চারদিকে ছিল নিশ্চিন্দ্র অন্ধকার। এখনো কি চারদিকে অন্ধকার নয়?
হ্যাঁ!
মাতৃগর্ভে তুমি এক ধরনের তরল পদার্থের উপর ভাসছিলে–যাকে তোমরা বলে। এমনোটিক ফ্লুয়িড। এখনো তুমি ভাসছ পানির উপর। দোল খাচ্ছ। খাচ্ছ না?
জি।
খানিকটা হলেও মাতৃগর্ভের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। নয় কি?
হ্যাঁ, তৈরি হয়েছে। আপনারা কে?
আমরা হচ্ছি–নি।
হ্যাঁ— নি। আমরা স্বপ্ন তৈরি করি।
বুঝতে পারছি না।
এখন বুঝতে না পারলেও আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে। আমরা তোমাকে বুঝতে সাহায্য করব। তোমাকে সাহায্য করার জন্যেই আমরা এসেছি। তুমি আমাদেরই একজন।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তুমিও একজন নি।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
তোমার মধ্যে আছে প্ৰচণ্ড ক্ষমতা। তুমি এই ক্ষমতা ব্যবহার করা।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
মন দিয়ে শোন–তোমার ভেতর আছে প্ৰচণ্ড ক্ষমতা! অকল্পনীয় ক্ষমতা। ক্ষমতা ব্যবহার কর। স্বপ্ন দেখ। স্বপ্ন দেখ।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
মবিনুর রহমান ঘুমের ঘোরেই কাতর শব্দ করলেন, তারপর তলিয়ে গেলেন গভীর ঘুমে। ঘুম যখন ভাঙল তখন চারদিক আলো হয়ে আছে। অনেক বেলা হয়েছে, কড়া রোদ। দীর্ঘ আট বছর পর এই প্রথম মবিনুর রহমানের মনে হলো আজ স্কুলে না যেয়ে সারাদিন নৌকায় বসে নদীর দিকে তাকিয়ে থাকলে কেমন হয়?
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেড মাস্টার
নীলগঞ্জ হাইস্কুলের হেড মাস্টার হাফিজুল কবির সাহেব একটা ছোট্ট সমস্যা নিয়ে বিব্রত। সমস্যাটির বয়স সাত মাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব সমস্যাই খানিকটা পাতলা হয়। তারটা হচ্ছে না। বরং খানিকটা জোরাল হয়ে উঠছে। ব্যাপারটা এ রকম–ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রামে গত মাসে নীলগঞ্জ হাই স্কুলকে পঞ্চাশ বস্তা গম দেয়া হয়েছিল। তিনি মবিনুর রহমানকে সঙ্গে নিয়ে গম আনতে গেলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, একটা সমস্যা হয়েছে হেড মাস্টার সাহেব।
তিনি বললেন, কী সমস্যা?
পঞ্চাশ বস্তা গম তো আপনাকে দিতে পারছি না। দশ বস্তা নিয়ে যান।
দশ বস্তা।
হ্যাঁ, দশ। আর ক্যাশ টাকা দিচ্ছি। পাঁচ হাজার।
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, খাতায় সই করতে হবে পঞ্চাশ বস্তা গম?
হ্যাঁ। নানান ফ্যাকরা রে ভাই। সাহায্যের গম বারো ভূতে লুটে খাচ্ছে। সৎভাবে যে কিছু করব তার উপায় নেই। আপনি তো সবই বুঝেন। বুঝেন না?
জি, বুঝব না কেন?
দশ বস্তা গম নিয়ে যান। আর নিতে যদি না চান কোনো অসুবিধা নেই। আমার অন্য প্রোগ্রামে ট্রান্সফার করে দেব। নেবেন, না নেবেন না?
নিব।
আসুন তাহলে খাতায় সই করুন।
হেড মাস্টার সাহেব বিচক্ষণ লোক। নিজে সই করলেন না, মবিনুর রহমানকে সই করতে বললেন। তিন মাস পর উপর থেকে চিঠি এলো–বিশেষ ব্যবস্থায় নীলগঞ্জ হাই স্কুলকে যে একশ বস্তা গম দেওয়া হয়েছিল তা কীভাবে খরচ হয়েছে? উন্নয়নের কোন কোন খাতে অৰ্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা যেন অতি সত্ত্বর জানানো হয়।
হেড মাস্টার সাহেব ছুটে গেলেন উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে। আমতা আমতা করে বললেন, একশ বস্ত, গমের কথা কীভাবে এলো স্যার?
চেয়ারম্যান সাহেব হাই তুলে বললেন, কাগজপত্রে তাই লেখা আছে, আপনি নিজে সই করে নিয়েছেন।
আমি সই করি নি স্যার, মবিনুর রহমান করেছে।
মবিনুর রহমানটা কে?
আমাদের স্কুলের সায়েন্স টিচার।
তাহলে তো আপনি বেঁচেই গেলেন। তদন্ত কমিটি করে দেন। ব্যাটার চাকরি চলে যাক। সব সমস্যার সমাধান। নতুন টিচার নিয়ে নেবেন। বাংলাদেশে সায়েন্স গ্র্যাজুসেটের কোনো অভাব নেই। আমার এক ভাইস্তা আছে বিএসসি পাস করে ঘুরছে, তাকেও নিতে পারেন।
হেড মাস্টার সাহেব মুখ শুকনো করে বসে রইলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেব চা এবং কেক খাওয়ালেন। কোনো কিছুই তাঁর মুখে রুচল না।
হেড মাস্টার সাহেব তদন্তু কমিটি তৈরির ব্যাপারটা অনেকদিন ঠেকিয়ে রেখেছিলেন। আর ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। ডিসট্রিক্ট এড়ুকেশন অফিসার অতি জরুরি সিল মেরে চিঠি পাঠিয়েছেন। আর দেরি করা যায় না। হেড মাস্টার সাহেব জালালুদ্দিন সাহেবকে অফিসে ডেকে পাঠালেন। সরু গলায় বললেন, জালাল সাহেব, আপনাকে তো একটা অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করতে হয়। একটা তদন্ত কমিটি হচ্ছে, আপনি তার চেয়ারম্যান, তিনজন মেম্বার। আফজাল সাহেব, সেক্রেটারি সাহেব এবং উপজেলা চেয়ারম্যান। আমাদের মধ্যে আপনি সবচে বয়োজ্যেষ্ঠ এবং ধর্মপ্ৰাণ ব্যক্তি–সেই হিসেবে আপনি চেয়ারম্যান।
জালাল সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কীসের তদন্ত?
হেড মাস্টার সাহেব গলা পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কেলেংকারি ব্যাপার হয়েছে। স্পেশাল পারমিশনে নীলগঞ্জ স্কুলকে একশ বস্তা গম দেয়া হয়েছিল। মবিনুর রহমান সইসোবুদ করে গম নিয়েছে। আমাকে বলেছে দশ বস্তা। আমি তো তাই সরল মনে বিশ্বাস করলাম। মবিনকে অবিশ্বাস করার কি কোনো কারণ আছে? আপনি বলেন। যাই হোক দুমাস পর ডিও-র চিঠি পেয়ে আমি তো যাকে বলে থান্ডারষ্ট্রাক, বজ্রাহত।