কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছটায় মবিনুর রহমান এই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি হোমিওপ্যাথ ডাক্তার, স্কুল কমিটির মেম্বার, প্রাক্তন চেয়ারম্যান আফজাল সাহেবের বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। আফজাল সাহেবের বড় মেয়ে রূপাকে গত ছমাস ধরে তিনি পড়াচ্ছেন। রূপা এই বছর এসএসসি দেবে। গত বছর দেবার কথা ছিল, টাইফয়েড হওয়ায দিতে পারে নি। এবার দিচ্ছে। রূপার ধারণা এবারো সে পরীক্ষা দিতে পারবে না। পরীক্ষার ঠিক আগে চিকেন পক্স কিংবা হাম হবে। মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী। তবে পড়াশোনায় মন নেই। কখনো সময়মতো আসবে না। এমনো হয়েছে তিনি আধঘণ্টা বসে আছেন কপার দেখা নেই।
আজ অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে চলে এলো। চোখ কপালে তুলে বলল, স্যার এই বৃষ্টির মধ্যে আসছেন। আমি ভাবলাম, আসবেন না।
মবিনুর রহমান বিরক্ত গলায় বললেন, ঝড়বৃষ্টির জন্যে আসি নি এরকম কী কখনো হয়েছে?
একবার হয়েছে স্যার। মে মাসের দু তারিখে আপনি আসেন নি। ঝড় হচ্ছিল তাই আসেন নি।
মবিনুর রহমান চুপ করে গেলেন। কথা সত্যি। মে মাসের দুতারিখে তিনি আসেন। নি। মেয়েটা এটা মনে করে বাখবে তা ভাবেন নি। এই মেয়েব অনেক কিছুই তিনি বুঝতে পাবেন না। যেমন, মাঝে মাঝে সে পড়া বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। তিনি বিবক্ত হয়ে যখন ধমক দেন–কী ব্যাপার, পড়ছি না কেন? তখনো চোখ নামিয়ে নেয় না। ক্লান্ত গলায় বলে, আজ আর পড়তে ভালো লাগছে না, স্যার। আজ আপনি যান। বলেই অতি অভদ্রের মতো উঠে চলে যায়।
রূপা বলল, স্যার, একটা গামছা এনে দিই। মাথাটা মুছে ফেলুন, মাথা ভিজে গেছে।
অসুবিধা হবে না–তুমি অঙ্ক নিয়ে বস। বারো প্রশ্নমালার একুশ এবং বাইশ এই দুটা অঙ্ক কর তো দেখি পার কি-না!
রূপা নিমিষেই অঙ্ক দুটা করে ফেলল। মবিনুর রহমান মনে মনে বললেন, ভেরি গুড, ভেরি গুড। এই মেয়েটির সঙ্গে বেশিরভাগ কথাই তিনি মনে মনে বলেন।
স্যার, অঙ্ক দুটা হয়েছে?
হ্যাঁ। আচ্ছা শোন, তোমাদের বাসায় কি তেঁতুল আছে?
জি স্যার, আছে।
একটা পিরিচে করে সামান্য তেঁতুল আর খানিকটা চুন আন। পান খাওয়ার চুন।
কী করবেন। স্যার?
ছোটখাটো একটা এক্সপেরিমেন্ট। পিরিচটা দিয়ে তুমি অ্যালজেব্রা নিয়ে বস। কাল করেছিলে দশ প্রশ্নমালা। আজ এগারো।
রূপা উঠে চলে গেল। ফিরতে অনেক দেরি করল। মেয়েটার এই এক অভ্যাসএকবার উঠে গেলে ফিরতে অনেক দেরি করে। মবিনুর রহমান বিরক্ত মুখে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। এবার নিশ্চয় বন্যা হবে। এক বছর পর পর দেশে বন্যা হচ্ছে। গত বছর হয় নি। এবার তো হবেই।
স্যার, নিন তেঁতুল। খানিকটা লবণও নিয়ে এসেছি। স্যার লবণ লাগবে?
না। তোমাকে তো লবণ আনতে বলি নি। তুমি অ্যালজেব্রা নিয়ে বস।
মবিনুর রহমান আঙুল দিয়ে ডলে ডলে চুন এবং তেঁতুল মেশাচ্ছেন। রূপা নিঃশব্দে অঙ্ক করে যাচ্ছে। মবিনুর রহমান এক সময় হঠাৎ লক্ষ করলেন, রূপা অঙ্ক করা বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। ঘোর-লাগা চোখের দৃষ্টি।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, কী ব্যাপার, কী দেখছ? অঙ্ক কর।
আজ আর করব না, স্যার।
কেন?
ভালো লাগছে না।
রূপা তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিচ্ছে না। মবিনুর রহমান চুন মেশানো তেঁতুল খানিকটা জিভে লাগালেন। তিতা তিতা লাগছে। টক ভাব এখনো আছে। অন্ন এবং ক্ষারের প্রশমন ক্রিয়া পুরোপুরি শেষ হয় নি বলে মনে হচ্ছে। আরো খানিকটা চুন মেশানো দরকার। এবং একটু বোধহয় গরম করা দরকার।
রূপা!
জি স্যার।
আরেকটু চুন। এনে দাও তো!
রূপা উঠে দাঁড়াল। ইতস্তত কবে বলল, আচ্ছা স্যার, আমার মধ্যে কি কোনো পরিবর্তন লক্ষ করেছেন?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী পরিবর্তন?
সত্যি লক্ষ করেন নি?
না তো!
প্রথম আমার গায়ে ছিল সবুজ রঙের একটা শাড়ি। এখন একটা ডোরাকাটা শাড়ি। যখন তেঁতুল আনতে বললেন, তখন শাড়ি বদলালাম।
ও!
ও আচ্ছা!
চুন নিয়ে রূপা এলো না। একটা কাজের মেয়ে একগাদা চুন দিয়ে গেল। সরু গলায় বলল, আপার মাথা ধরছে আইজ আর পড়ব না।
আচ্ছা।
আম্মা আফনেরে ভাত খাইয়া যাইতে বলছে।
না, ভাত খাব না। চলে যাব। শোন, আমি তেঁতুল আর চুন নিয়ে যাচ্ছি, কেমন? ঘরে বাড়তি ছাতা থাকলে আমাকে একটা ছাতা দাও।
বাড়তি ছাতা ছিল না।
মবিনুর রহমান বাড়িতে ফিরলেন কাকভেজা হয়ে। নদীর পাশ ঘেসে বাড়ি ফেরার বাস্তা। নদী ফুলে-ফোঁপে একাকার হয়েছে। কান পাতিলেই নদীর ভেতর থেকে আসা হুঁ-হু গর্জন শোনা যায়। খানিকটা ভয় ভয় লাগে। শুধু ভয় না। ভয়ের সঙ্গে এক ধরনের আনন্দও মেশানো থাকে।
মবিন্নুর রহমান বাড়ি ফিরেই রান্না চড়ালেন। হাঁড়িতে দুছিটাক আন্দাজ পোলাওয়ের চাল, মুগের ডাল, কয়েক টুকরা আলু এবং তিন চামচ ঘি। অল্প আঁচে অনেকক্ষণ সিদ্ধ হবে। এক সময় অতি সুস্বাদু ঘন সু্যপেব মতো একটা জিনিস তৈরি হবে। গরম গরম খেতে চমৎকার লাগবে। ডিম থাকলে ভালো হতো। ডিমটাও ছেড়ে দেওয়া যেত। প্রোটিন কম খাওয়া হচ্ছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করতে করতে রাত দশটা বেজে গেল। বৃষ্টির বিরাম নেই। মনে হচ্ছে আকাশটা যেন অনেক জায়গায় ফুটো হয়ে গেছে। মবিনুর রহমান একটা টর্চ এবং ছাতা হাতে ঘরে তালা দিয়ে বের হলেন। আজ রাতটা তিনি নৌকায় কাটাবেন। নৌকায় বিছানা বালিশ সবই আছে। প্রশস্ত পাটাতনে তোশক বিছানো। দুপাশের দরজা লাগিয়ে নৌকায় শুয়ে থাকলে চমৎকার লাগবে। সারারাত নদীতে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাবে। বাতাসে নৌকা এপাশি-ওপাশ করবে। চারদিকে থাকবে নিশ্চিছদ্র অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাবে। সেই বিদ্যুৎ চমকে চারদিক আলো হয়ে আবার অন্ধকার হয়ে যাবে।
মবিনুর রহমান নৌকার বিছানায়
মবিনুর রহমান নৌকার বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুমিয়ে পড়লেন। গাঢ় ঘুম, এত গাঢ় যেন মৃত্যুর কাছাকাছি। এই ঘুমের মধ্যেই তিনি অতি বিচিত্র একটি স্বপ্ন দেখলেন। যেন কয়েকজন বুড়ো মানুষ তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। সবার চেহারা এক রকম। তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিও একরকম। সবার মুখেই এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হাসি। সেই হাসি একই সঙ্গে কঠিন এবং কোমল। তারা কথা বলতে শুরু করলেন।