ভাবতে ভাবতেই তার এক ধরনের ঘোবের মতো হলো। তিনি বিচিত্ৰ সব শব্দ শুনতে লাগলেন। কেরোসিনের ক্টোভ থেকে শো-শো শব্দ ছাড়াও ক্টোভেব নিজস্ব শব্দ আসছে। পানি ভর্তি গ্লাস থেকে এক ধবনের শব্দ আসছে, আবার কেতলির ফুটন্ত পানি থেকে অন্য ধরনের শব্দ। কী পাশ্চৰ্য্য। তিনি ঘোরের মধ্যেই শুনলেন–
হচ্ছে তোমার হচ্ছে! এই তো তুমি জগৎ তৈরি করেছ। শব্দময় জগৎ। অপূর্ব! অপূর্ব!
আপনারা কি নি?
হ্যাঁ আমরা নি।
আমরা তোমার ক্ষমতায় বিস্মিত।
আমি তাহলে একটি শব্দময় জগৎ তৈরি করেছি?
হ্যাঁ করেছ।
আমি আপনাদের এই রসিকতার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না। পৃথিবী সব সময়ই শব্দময়। শব্দের উৎপত্তি কম্পনে। প্রতিটি বস্তুর নিজস্ব কম্পনাংক আছে। সেই অর্থে প্রতিটি বস্তুই শব্দময়।
অবশ্যই প্রতিটি বস্তু শব্দময়। কিন্তু তুমি কল্পনা করেছ এমন মানুষের যারা এই শব্দ ধরতে পারে। সেই অর্থে তোমার জগৎটি নতুন।
কোথায় সেই জগৎ?
সেই জগতের অবস্থান তোমার মধ্যেই তবে ভিন্ন মাত্রায় বলেই তোমার ধরাছোয়ার বাইরে। তুমি আরো ভাব। কল্পনাকে আরো ছড়িয়ে দাও। নতুন নতুন জগৎ সৃষ্টি কর।
তাতে আমার লাভ?
তুমি সৃষ্টির আনন্দ পোচ্ছ। এই আনন্দই তোমার লাভ।
যে সৃষ্টি আমি দেখছি না। সেই সৃষ্টিতে কোনো আনন্দ থাকার কথা নয়।
তুমি কি কোনো আনন্দই পাচ্ছে না?
না।
তুমি যখন শব্দময় জগতের কথা ভাবছিলে তখন কি আনন্দ পাও নি?
পেয়েছি।
সেই আনন্দ কি অসম্ভব তীব্র ছিল না?
হ্যাঁ ছিল
ঐটিই তোমার লাভ। শব্দময় জগতের কথা ভাবতে ভাবতে তোমার নিজের জগৎও হয়ে গেল শব্দময়। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
বিচিত্ৰ!
শুধু বিচিত্র? আর কিছু না? আনন্দে কি তখন তোমার শরীর ঝনঝনি করছিল না?
করছিল।
তোমার কল্পনা যতই উন্নত হবে তোমার আনন্দের পরিমাণ হবে ৩তই তীব্ৰ। আমরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
কেন?
কারণ তোমার আনন্দ আমাদেরও আনন্দ। আমরাও তো নি তোমার জন্ম থেকেই আমরা তোমার ওপর লক্ষ রাখছি। তোমার প্রতিটি কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করছি।
প্রতিটি কার্যকলাপ?
হ্যাঁ, প্রতিটি কার্যকলাপ। তুমি যেন নীলগঞ্জ আস সে জন্যে সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। তুমি যাতে এই ভাঙা বাড়িতে এসে উঠ সেই ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কারণ তোমার ক্ষমতার পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য নির্জন একটি বাড়ি প্রয়োজন ছিল।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ তাই। তুমি টেলিস্কোপের কথাই চিন্তা করে দেখ। একটি প্রথম শ্রেণীর এস্ট্রনোমিক্যাল টেলিস্কোপ তুমি ব্যবহার করছ। টেলিস্কোপটি তুমি কিনেছ একটি পুরানো ফার্নিচারের দোকান থেকে। তুমি সেখানে গিযেছিলে ইজিচেয়ার কিনতে। মনে আছে?
আছে। তাহলে কি আপনারা বলতে চান সব কিছুই পূর্ব নির্ধারিত?
হ্যাঁ।
রূপা মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয়ও কি পূর্ব নির্ধারিত?
হ্যাঁ পূর্ব নির্ধারিত। বিশেষ প্রয়োজনেই রূপাকে ব্যবহার করা হচ্ছে।
কী প্রয়োজন?
তুমি যে সব জগৎ তৈরি করছ, সেসব জগতের মানুষ তোমার মতোই আবেগশূন্য। তীব্র আবেগের সঙ্গে তোমার পরিচয়ের প্রয়োজন হয়েছে সে কারণেই, যাতে তোমার জগতের মানুষদের তুমি অন্য রকম করে তৈরি করতে পোর।
আপনারা কি ভবিষ্যৎ বলতে পারেন?
পারি না। আবার এক অর্থে পারি।
রূপা এখন কি করবে বলতে পারেন?
না, পারি না। প্রকৃতি খানিকটা অনিশ্চয়তা রেখে দেয়। রূপা ঝড়-বৃষ্টির রাতে এখানে ছুটে আসতে পারে, আবার আসতে নাও পারে, আবার অন্য কিছু করতে পারে।
তাহলে অনিশ্চয়তা সামান্য বলছেন কেন? অনেকখানি অনিশ্চয়তা।
হ্যাঁ, অনেকখানি।
আপনারা বলছেন নি-রা প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন। এই অনিশ্চয়তা তারা দূর করতে পারে না।
না। অনিশ্চয়তা প্রকৃতিরই নিয়ম। প্রকৃতি তার নিজের নিয়ম ভঙ্গ করে না।
মবিনুর রহমানেব ঘোর কেটে গেল। কেতলিতে পানি টগবগ করে ফুটছে। তিনি চা বানিয়ে খেলেন। হাওয়ার বেগ আরো বাড়ছে। তুমুল বর্ষণ। ধুপ ধুপ শব্দে নদী ভাঙতে ভাঙতে এগুচ্ছে। যে হারে এগুচ্ছে তাতে মনে হয় আজ রাতের মধ্যেই নদী তার বাড়ি গ্ৰাস করে নেবে। তিনি তেমন চিন্তিতবোধ করছেন না। বরং ভালোই লাগছে। তিনি রাত দুটোর দিকে ঘুমুতে গেলেন। চাদর মুড়ি দিয়ে সবে শুয়েছেন। হাত বাড়িয়েছেন হারিকেনের সালতা কমিয়ে দেবার জন্যে। এমন সময় দরজায় প্ৰবল ধাক্কার শব্দ হলো। তিনি বললেন, কে?
বাইরে থেকে তানভিরের গলা শোনা গেল।
দরজা খুলুন মাস্টার সাহেব।
কী ব্যাপার?
দরজা খুলুন। তারপর বলছি।
তিনি দরজা খুললেন। তানভির একা নয়। রূপার দুই ভাই–রফিক এবং জহিরও তার সঙ্গে এসেছে। রফিক কঠিন গলায় বলল, রূপা কি আপনার এখানে?
তিনি বিস্মিত হয়ে বললেন, না তো!
আপনি কী সত্যি কথা বলছেন মাস্টাব সাহেব?
মিথ্যা বলার প্রয়োজন কখনো বোধ করি নি। রূপাকে কী পাওয়া যাচ্ছে না?
তানভির বলল, আমরা আপনার নৌকাটা একটু দেখব। নৌকা কী ঘাটে বাধা আছে?
থাকার কথা। আসুন যাই।
নৌকা বাতাসের প্রবল ঝাণ্টায় উলট পালট খাচ্ছে। যে কোনো মুহুর্তে দড়ি ছিঁড়ে যাবে। রফিক বলল, আপনি রাতে আমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন তখন রূপা আপনাকে কি বলেছে?
আমার এখানে আসতে চেয়েছিল, আমি নিষেধ করেছিলাম।
তিনজনই ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জহির হিসহিস করে চাপা গলায় বলল, রূপার যদি কিছু হয় তাহলে আমি আপনাকে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করব। কেউ আপনাকে রক্ষা করতে পারবে না। কেউ না।