মবিনুর রহমান ভেতরে ঢুকলেন। রূপা বলল, গামছা দিচ্ছি। মাথা মুছে আরাম করে বসুন। আপনি কি রাতে কিছু খেয়েছেন?
হ্যাঁ, ওসি সাহেব তার বাসা থেকে খাবার এনে খাইয়েছেন।
আমি চা এনে দিচ্ছি। আদা চা করে দেব?
দাও। বাসার আর মানুষজন কোথায়? সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি?
জি।
তানভির দাঁড়িয়ে আছে। অপলক দেখছে রূপাকে। মেয়েটা আজ এত সুন্দর করে সাজল কেন? সে কি জানত তার স্যার আসবেন?
রূপা বলল, তানভিরের দিকে তাকিয়ে আপনি আপনার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। স্যারেব সঙ্গে আমার খুব জরুরি কথা আছে। আমি কাল খুলনায় চলে যাচ্ছি। কথাগুলি স্যারকে বলে যাওয়া দরকার।
কথাগুলি সকালে বললে হয় না?
না হয় না। আপনার কাছে হাত জোড় করছি।
মবিনুর রহমান বললেন, আমি না হয় সকালে আসব।
না। আপনি চুপ কবে বসে থাকুন।
তানভির ঘর ছেড়ে বারান্দায় গেল। তার মন বলছে এই দুজনকে এখানে রেখে বাইরে দাড়িয়ে থাকা ঠিক হচ্ছে না। ব্যাপারটা অন্যদের জানানো দরকার। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সে একজন বাইরের মানুষ। তার কি উচিত অন্যদের জাগানো? তানভির সিগারেট ধরাতে চেষ্টা করছে। বাবান্দায় প্ৰবল বাতাস। দেয়াশলাই ধরানো যাচ্ছে না।
মবিনুর বহমান বিস্মিত মুখে বসে আছেন। রূপার মধ্যে খানিকটা পবিবর্তন তিনি লক্ষ করছেন। কিন্তু পরিবর্তনের ধরনটা ঠিক ধরতে পারছেন না। মেয়েটাকে সুন্দর লাগছে। অবশ্যি সুন্দর মেয়েকে সুন্দর তো লাগবেই।
রূপা তার সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, স্যার আপনি কি এখন বাড়িতে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
নদী নাকি খুব ভাঙছে? আপনার বাড়ি ভেঙে পড়েছে কি-না কে জানে?
গিয়ে দেখি।
রূপা বলল, আমি কিন্তু স্যার আপনার সঙ্গে যাব।
আমার সঙ্গে যাবে মানে?
আপনার সঙ্গে আপনার বাড়িতে যাব। আমি এখন থেকে আপনার সঙ্গে থাকব। মবিনুর রহমান দীর্ঘ সময় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই মেয়েটাকে এখন অচেনা লাগছে। একেবারেই অচেনা। যেন কোনোদিন এর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয় নি।
আমার সঙ্গে থাকবে কীভাবে?
কীভাবে তা জানি না। আমি থাকব।
আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না রূপা।
আপনি সব কথা বুঝেন আর আমার সামান্য কথা বুঝেন না?
না কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি এখন আপনার সঙ্গে যাব। গিয়ে যদি দেখি আপনার বাড়ি নদীতে তলিয়ে গেছে তাহলে নৌকায় রাতে থাকব। অবশ্যি এই অবস্থায় নৌকায় থাকা খুব বিপদজনক হবে। তাই না স্যার?
মবিনুর রহমান হতভম্ব হয়ে গেলেন। তার মনে হতে লাগল পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নে ঘটছে। মাঝে মাঝে তিনি যেমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেন এও তেমন কোনো অদ্ভুত স্বপ্ন।
স্যার।
বলো।
সবচে ভালো হয় যদি আমরা দুজন এই জায়গা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই যাতে কেউ আমাদের খুঁজে বের করতে না পারে।
মবিনুর রহমান থেমে থেমে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে রূপা। তুমি কী বলছ নিজেও জানো না। তুমি খুলনায় যাও। বাইরে গেলে ভালো লাগবে।
স্যার, আপনার ধারণা আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
কিছু একটা গণ্ডগোল তো অবশ্যই হয়েছে। আমি উঠি, কেমন?
বাড়ি যাচ্ছেন?
হ্যাঁ।
যদি অনেক রাতে একা একা আপনার বাড়িতে উপস্থিত হই আপনি কী কববেন? আমাকে এখানে এনে দিয়ে যাবেন?
অবশ্যই দিয়ে যাব।
রূপা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দেখতে দেখতে তার চোখ ভিজে উঠল। মবিন্নুর রহমান উঠে দাড়ালেন। তার ইচ্ছা করছে এই পাগলী মেয়েটার মাথায় হাত দিয়ে দুএকটা সান্ত্বনার কথা বলতে। তা বোধহয় ঠিক হবে না। এ কী ভয়াবহ সমস্যা! সমস্যার ধরন এখনো তার কাছে পরিষ্কার নয়। এই মেয়ে কী চায় তার কাছে?
রূপা যাই।
রূপা কিছু বলল না। চেয়ার ছেড়ে উঠেও দাঁড়াল না। মবিনুব বহমান বাবান্দায় এসে দেখেন তানভির দাঁড়িয়ে আছে। তিনি নিচু গলায় বললেন, আমি যাচ্ছি। আপনি রূপার দিকে একটু লক্ষ্য রাখবেন। ও বড় ধরনের কোনো সমস্যার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে বলে আমরা ধারণা। আপনি লক্ষ্য রাখবেন রূপা যেন রাতে বাড়ি থেকে বের না হয়।
তানভির কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মবিনুর রহমান অসহায় বোধ করছেন। তিনি বিড়বিড় করে বললেন, আপনি বরং রূপার বাবা-মাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলুন। ওদের বলুন মেয়েটার দিকে লক্ষ রাখতে।
লক্ষ্য রাখা হবে। আপনি আপনার বাড়িতে যান। রূপাকে নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।
মবিনুর রহমান বাড়িতে এসে পৌঁছেছেন। নদী আশেপাশের পুরো অঞ্চল ভেঙে দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে–আশ্চর্য তার বাড়িটি ঠিকই আছে। নৌকাও বাধা আছে। তিনি জানতেন কিছু হবে না। প্রকৃতি তাঁকে রক্ষা করবে। তিনি একজন নি। তাঁকে সব রকম সমস্যা থেকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রকৃতির। তিনি প্রকৃতির প্রিয় সন্তান।
ভেবেছিলেন রাতে নৌকায় ঘুমুবেন। নৌক যেভাবে দুলছে তাতে তা সম্ভব না। তিনি নিজের ঘরেই ঘুমুতে এলেন। যাবার সময় দরজা বন্ধ করে তালা দিয়ে গিয়েছিলেন, এখন তালা খোলা। কেউ ঘরে ঢুকেছিল নিশ্চয়ই। ঘরের জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনি আছে। যে এসেছিল সে কোনো কিছুতেই হাত দেয় নি।
চায়ের তৃষ্ণ হচ্ছে। তিনি চুলায় কেতলি বসিয়ে দিলেন। নদীর শো-শো শব্দের সঙ্গে স্টোভের শো শী শব্দ মিশে অন্য এক ধরনের শব্দ হচ্ছে। চুলার সামনে বসে থাকতে থাকতে তাঁর হঠাৎ মনে হলো, পৃথিবী শব্দময় হলে কেমন হতো? যদি এমন একটি জগৎ থাকত যেখানে সবই শব্দময়। গাছ। অনবরত শব্দ করে যাবে। একেক গাছ থেকে একেক ধরনের শব্দ আসবে। পাথর থেকে শব্দ হবে। বড় পাথরের এক ধরনের শব্দ, ছোট পাথরের এক ধবনের শব্দ। মানুষের শবীরে যেমন ঘাণ থাকে তেমনি শব্দও থাকবে। কারোর গা থেকে আসবে মধুর সঙ্গীতময় শব্দ। কারো গা থেকে আসবে বিরক্তিকর শব্দ। এ রকম একটি জগতে রূপার গা থেকে কেমন শব্দ আসবে? নূপুরে ছটফট ধরনের শব্দ?