কী খবর?
তোমার স্যারকে ওরা ছেড়ে দেবে। ছেড়ে না দিয়ে অবশ্যি উপায়ও নেই। হি-হি-হি।
তুমি কীভাবে জানো?
যেভাবেই হোক জানি। অনেক রাতে তিনি একা একা বাড়ি ফেবার সময। এই বাড়িতে আসবেন।
তাও তুমি জানো?
হ্যাঁ, তাও জানি। তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?
না।
আমি সব সময় সত্যি কথা বলি ফুপু। তবু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে না। তাতে কিছু অবশ্যি যায় আসে না।
তুমি মেয়েটা খুব অদ্ভুত জেবা।
সব মানুষই অদ্ভুত ফুপু। তুমিও অদ্ভুত। পৃথিবীটাও অদ্ভুত।
তুমি একেবারে বড়দের মতো কথা বলছি।
মাঝে মাঝে আমি বড়দের মতো কথা বলি। বড়রা যদি ছোটদেব মতো কথা বললে দোষ না হয় তাহলে ছোটরা বড়দের মতো কথা বললে দোষ হবে কেন? আমি ঘুমুতে যাচ্ছি ফুপু।
রাত এগারোটার দিকে এ বাড়ির সবাই ঘুমুতে গেল। ঘুমুতে যাবার আগে আফজাল সাহেব রূপাকে ডেকে বললেন, রূপা, তুমি আগামীকাল রফিকের সঙ্গে খুলনা চলে যাবে।
রূপা বলল, আচ্ছা।
ওখানেই থাকবে। পরীক্ষার সময় শুধু এখানে এসে পরীক্ষা দিয়ে যাবে।
আচ্ছা।
তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে। এখন কিছুই বলব না। পরে বলব।
আচ্ছা।
তোমার মাকে বলেছি তোমার জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিতে।
ঠিক আছে বাবা।
বাইরে ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। বাতাস শো-শো করছে। সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে একে একে। সবার শেষে ঘুমুতে গেল মিনু। সেও ঘুমুতে যাবার আগে রূপার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলল। এমনভাবে বলল যেন কিছুই হয় নি। সব স্বাভাবিক আছে। আগের মতোই আছে।
রূপা, আমাদের সঙ্গে যেতে তোমার আপত্তি নেই তো?
আপত্তি হবে কেন? খুলনা আমার খুব যেতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা ভাবি, তোমাদের ওখান থেকে সুন্দরবন কী অনেক দূব?
না–কাছেই।
আমাকে সুন্দরবন দেখাবে না?
অবশ্যই দেখাব।
সুন্দরবনে ডাকবাংলা আছে? ডাকবাংলায় থাকতে ইচ্ছা করে ভাবি।
ফবেষ্টের ডাকবাংলা আছে। তোমার ভাইকে বলে ব্যবস্থা করে দেব।
ঠিক আছে। ভাবি, তুমি ঘুমুতে যাও। খুব রাত অবশ্যি হয় নি। এগারোটা বাজে। তবু কেন জানি মনে হচ্ছে নিশুতি রাত।। তাই না ভাবি?
মিনু ঘুমুতে গেল। রূপা নিজের ঘরে ঢুকে সুন্দর করে সাজল। চুল বেণী করল। শাড়ি পাল্টাল। অনেকদিন পব চোখে কাজল পরল।
সে অপেক্ষা করছে। জেবার কথ সে বিশ্বাস করছে। এই মেয়েটা কোনো এক বিচিত্ৰ উপায়ে ভবিষ্যতের কথা বলতে পাবে। কাঁপা তার প্ৰমাণ পেয়েছে।
মবিনুর রহমানকে ছেড়ে দিয়েছে রাত এগারোটায়।
ওসি সাহেব বললেন, চলুন, আমি আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। মবিনুর রহমান বললেন, না না, পৌঁছাতে হবে না।
ওসি সাহেব বললেন, আপনি আমার ওপর রাগ করবেন না ভাই। ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করে দেবেন।
ঠিক আছে। মানুষ মাত্রেই ভুল করে।
বৃষ্টির মধ্যে যাবেন কী করে? একটা ছাতা আর টর্চ লাইট দিয়ে দি।
টর্চ লাইট লাগবে না। ছাতা দিতে পারেন।
মবিনুর রহমানকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দেবার জন্যে জালালুদ্দিন এবং কালিপদ ছিল। তিনি অনেক কষ্টে তাদের বিদেয় করলেন। তার কেন জানি একা একা বাড়ি ফিরতে ইচ্ছা! করছে। থানার সামনে জড়ো হওয়া মানুষজন কেউই এখন নেই। সবাই ভীড় করেছে নদীর তীরে। নদী ভাঙতে শুরু করেছে। এমনভাবে নদী আগে কখনো ভাঙে নি। নদী ভাঙার দৃশ্য একই সঙ্গে ভয়ঙ্কর এবং সুন্দর।
মবিনুর রহমান ভিজতে ভিজতে এগুচ্ছেন। বৃষ্টি ছাতা মানছে না। বাতাসের কারণেই খুব ভিজছেন। নিজে ভিজছেন তা নিয়ে তিনি চিন্তিত না। টেলিস্কোপটা ভিজে যাচ্ছে এই নিয়েই তিনি চিন্তিত।
রূপাদের বাড়ির কাছে আসতেই তার মনে হলো তাকে যে ছেড়ে দেয়া হয়েছেএই খবরটা রূপাদের দিয়ে যাওয়া উচিত। রাত অবশ্যি অনেক হয়েছে, তবু যাওয়া যায় কারণ বাতি জ্বলছে। এখনো কেউ না কেউ জেগে আছে। সম্ভবত রূপাই জেগে আছে। সে অনেক রাত পর্যন্ত জাগে। পড়াশোনা করে।
দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হতেই তানভির দবাজা খুলল। টেলিস্কোপ বগলে মবিন্নুর রহমান দাঁড়িয়ে। মবিনুর রহমান অপ্ৰস্তুত গলায় বললেন, ওবা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আপনারা চিন্তা করবেন। এই ভেবে খবরটা দিতে এলাম। ভালো আছেন?
জি ভালো আছি।
তানভির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার ইচ্ছা নয় মানুষটা ঘরে ঢুকুক। তানভির বলল, রফিক সাহেবের ছোটমেয়েটা অসুস্থ। সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত। এখন ঘুমুচ্ছে। কাউকে ডাকা যাবে না।
মবিনুব রহমান বললেন, আপনি খবর দিয়ে দিলেই হবে। বলবেন আমি এসেছিলাম।
আমি বলব।
কাল সন্ধ্যায় রূপাকে পড়াতে আসব। বেশ কিছুদিন মিস হলো। আর হবে না।
কাল আসতে হবে না। রূপা কাল চলে যাচ্ছে।
কোথায় যাচ্ছে?
খুলনা যাচ্ছে। রফিক সাহেব সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন।
এই সময় বেড়াতে যাওয়া কি ঠিক হবে? পরীক্ষার দেরি নেই।
সেটা ওদের ব্যাপার। ওরা যা ভালো বুঝে করবে।
শুধু ওদের ব্যাপার হবে কেন? আমারও ব্যাপার। আমি ওর শিক্ষক।
কথাবার্তার এই পর্যায়ে রূপা তানভিরের পেছনে এসে দাঁড়াল। শান্ত গলায় তানভিরকে বলল, আপনি স্যারকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন? দেখছেন না উনি ভিজছেন? দরজা ছেড়ে দাঁড়ান।
তানভির দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। রূপা বলল, স্যার ভেতরে আসুন।
এখন আর ভেতরে আসব না। রূপা। তোমাদের খবরটা দিতে এলাম। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। ভুল করে ধরেছিল। মানুষ মাত্রেই ভুল করে। ওসি সাহেব খুব লজ্জা পেয়েছেন। আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। বিশিষ্ট ভদ্রলোক।
স্যার আপনি ভেতরে আসুন। আপনাকে আসতেই হবে।