ফুপু।
কী?
তুমি চিন্তা কববে না। ফুপু, আমি তোমার দলে।
আমি কোনো চিন্তা করছি না। আর শোন, আমি কোনো দল কবছি না।
তোমার স্যারকে নিয়েও তুমি চিন্তা কববে না। আমি ব্যবস্থা করছি।
তুমি ব্যবস্থা করছি মানে?
সব মানুষ ক্ষেপে যাবে। ওলা থানা আক্রমণ করবে। ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবে। সাংঘাতিক মজার ব্যাপার হবে।
কী বলছ তুমি?
আমি কোনো মিথ্যা কথা বলি না ফুপু। সন্ধ্যার মধ্যে ভয়ঙ্কর কাণ্ড শুরু হবে।
জেবা হাসল খিলখিল করে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব আনন্দিত।
নীলগঞ্জ থানার ওসি সাহেব অস্থির বোধ করছেন। দুপুরে তিনি বাসায় ভাত খেতে যান নি। শুধু তিনি কেন, থানার কেউই দুপুরে খায় নি। সেপাইদের সবাইকে রাইফেল হাতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। ওসি সাহেব বিপদের ঘাণ পাচ্ছেন। মানুষ ক্রমেই বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে দূর দূর থেকে মানুষ আসছে। অনেকের হাতেই বর্শা। বর্শা হলো এ অঞ্চলের যুদ্ধান্ত্র যার স্থানীয় নাম অলংগা। কারো কারো হাতে লম্বা বাঁশের লাঠিও আছে। এখনো সন্ধ্যা হয় নি। কিন্তু অনেকেই হারিকেন নিয়ে এসেছেন। মনে হয় তাদের সারারাত জেগে থাকার পরিকল্পনা। ওসি সাহেব মবিনুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। হাজতের দরজা খুলতেই মবিনুর রহমান বিস্মিত গলায় বললেন, এত লোক কেন চারদিকে?
ওসি সাহেবের প্রথমেই মনে হলো, ব্যাটা সব জেনেশুনে ঠাট্টা করছে। পরমুহুর্তেই মনে পড়ল। এই লোক মিথ্যা বলে না। ঠাট্টাও করে না। চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে সত্যি কথাই বলেছিল।
মবিন্নুর রহমান আবার বললেন, এত লোক কেন?
ওসি সাহেব ভুরু কুঁচকে বললেন, জানি না। আপনি কি চা খাবেন?
জি-না।
সিগারেট? সিগারেট লাগবে? আনিয়ে দেব?
জি-না।
ওসি সাহেব কথা বলার আর কিছু পেলেন না। নিজের অফিস ঘরের দিকে ফিরে চললেন। লোক আরো বাড়ছে। দ্রুত কোনো একটা বুদ্ধি বেব কবে এদের দূর করতে হবে। ভয় দেখিয়ে দূর কবা যাবে না। এক মানুষ ভয প।ায়। জনতা ভয় পায় না। মবিনুর বহমানকে ছেড়ে দিলেও কোনো লাভ হবে না। এরা তাহলে নিজেদের বিজয়ী ভাববে। বিজয়ী মানুষদের জয় উল্লাসও ভয়াবহ হয়ে থাকে। আনন্দেই এরা হয়তো থানা জ্বালিয়ে দেবে। এমন কিছু করতে হবে যাতে মবিনুব রহমানের কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে নিয়ে আসা যুক্তিযুক্ত মনে হয়। কীভাবে তা সম্ভব? অতি দ্রুত কিছু ভেবে বের করতে হবে। অতি দ্রুত। এমন কিছু বলতে হবে যাতে সবাই বলে কোমবে দড়ি বেঁধে থানায় আনার প্রয়োজন ছিল।
ওসি সাহেব তাঁর অফিসে ঢুকেই দেখলেন, নীলগঞ্জ হাই স্কুলের ধর্ম শিক্ষক জালালুদ্দিন বসে আছেন। জালালুদ্দিন সাহেবের মুখ অতিরিক্ত গম্ভীর।
কেমন আছেন জালালুদ্দিন সাহেব?
জি জনাব, ভালো। আপনার কাছ থেকে একটা বিষয় জানতে এসেছি।
অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছেন। এর মধ্যে কী জানতে চান?
অবস্থা সম্পর্কেই একটা প্রশ্ন। মবিনুর বহমান সাহেবকে আপনারা কোমরে দড়ি বেঁধে হাজতে এনেছেন। কী জন্যে এনেছেন? গম চুরিব একটা মিথ্যা মামলার কারণে না অন্য কিহুচ?
অন্য কিছু।
বলুন শুনি।
ওসি সাহেব সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন–অন্য ব্যাপার। সামান্য কারণে তার মতো লোককে তো এভাবে থানায় আনা যায় না। পুলিশ হয়েছি বলে তো আর আমরা অমানুষ না। মানী লোকের মান আপনারা যেমন বুঝেন আমরাও বুঝি। উনার বিরুদ্ধে অসামাজিক কাৰ্যকলাপের গুরুতর অভিযোগ আছে।
কী বললেন?
ওসি সাহেব নিজেকে গুছিয়ে নেবার জন্যে কিছুটা সময় নিলেন। সিগারেট ধরালেন। সুন্দর একটা গল্প ফাঁদতে হবে। বিশ্বাসযোগ্য গল্প। সিগারেট টানতে টানতে কঠিন মুখে বললেন— একটা রেপ কেইস হয়েছে। ভিকটিমের জবানবন্দি অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।
রেপ কেইস?
জি, রেপ কেইস। এই কারণেই কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় এনেছি।
জালালুদ্দিন হতভম্ব মুখে তাকিয়ে আছেন।
ওসি সাহেব এই হতভম্ব দৃষ্টি দেখে খানিকটা সাত্ত্বিনা পেলেন। মনে হচ্ছে কাজ হবে। জালালুদ্দিন যখন তাঁর কথায় হকচকিয়ে গেছে তখন অন্যরাও যাবে। এই ঘটনায় লোকজন বুঝবে কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় আনা উচিত ছিল। বাতাস ঘুরে যাবে। মবের চিন্তা-ভাবনা একদিন থেকে অন্যদিকে অতি দ্রুত ঘুরতে পারে। এখন যা করতে হবে তা হচ্ছে মামলা সাজানো। একটা মেয়ে জোগাড় করতে হবে, যে হবে ফরিয়াদি। তেমন মেয়ে জোগাড় করা কঠিন হবে না। পুলিশের কাছে কোনো কাজই কঠিন নয়।
তানভির বাগানে একা একা বসে ছিল।
রূপা বারান্দায় আসতেই সে ডাকল, রূপা শুনে যাও তো।
রূপা শান্তমুখে বাগানে নামল। তানভির বলল, তোমার স্যারের কাণ্ড শুনেছ? রফিক ভাই এইমাত্র বলে গেলেন। তিনি বাজার থেকে শুনে এসেছেন। তুমি শুনতে চাও?
না।
না কেন? একটা মানুষকে ঠিকমতো জানতে হলে তার ভালো-মন্দ সবই জানতে হয়।
আপনার বলার ইচ্ছা খুব বেশি হলে বলুন, শুনব।
জোর করে শুনাতে চাচ্ছি না। তবুও আমি মনে করি তোমার শোনা উচিত। তোমার স্যার একটা মেয়েকে নির্জন বাড়িতে রেপ করেছেন, যে কারণে পুলিশ তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে গেছে।
আপনি কি এটা বিশ্বাস করেন?
বিশ্বাস না করার তো কিছু দেখছি না। নারীসঙ্গবৰ্জিত একজন মানুষ নির্জন জায়গায় একা একা থাকে…।
নারীসঙ্গবৰ্জিত অনেক সাধক মানুষও নির্জন জায়গায় একা একা থাকে।
তোমার ধারণা উনি সাধক মহাপুরুষ?
হ্যাঁ।
তাহলে তো আর কিছু বলার নেই।