কী বললেন? চন্দ্রবোড়া সাপ?
জি।
ভেরি গুড। আমার কিছু চন্দ্রবোড়া সাপই দরকার।
ওসি সাহেব নিজেই দরজা খুললেন এবং ছিটকে বের হয়ে এলেন। দুটি চন্দ্রবোড়াব একটি তিনি দেখতে পেয়েছেন। সেই দৃশ্য খুব সুখকর নয়। তখনই তিনি ঠিক করেছেন এই আসামির সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। মবিনুর রহমান যখন বললেন, আমি কি আমার দুরবিনটা সঙ্গে নিতে পারি?
ওসি সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, অবশ্যই পারেন। অবশ্যই। সঙ্গে আরো কিছু নিতে চাইলে তাও নিতে পারেন।
না, আর কিছু না। হাজতে কি আমাকে দীর্ঘদিন থাকতে হবে?
এখন বলা যাচ্ছে না। নির্ভর করে.
কীসেবা ওপর নির্ভর করে?
ওসি সাহেব তার জবাব দিলেন না। তার মন বলছে এই লোকটির সঙ্গে বেশি। কথাবার্তায় যাওয়া ঠিক হবে না।
রাস্তায় লোক জমছে। তারা অবাক হয়ে মবিনুর রহমানকে দেখছে। মবিনুর রহমান তাদের দিকে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছেন। তাঁর সেই তাকানোয় লজ্জা-সংকোচ কিছুই নেই। বিব্রত একটা ভঙ্গি আছে, এর বেশি কিছু না।
কালিপদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে বালতি ভর্তি পানি নিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছিল। পুলিশের দল দেখে থমকে দাঁড়াল। উঁচু গলায় বলল, কী হইছে? মবিন্নুর রহমান বললেন, কেমন আছ কালিপদ?
আপনেরে কই নিয়া যায়?
থানায় নিয়ে যাচ্ছে।
কেন?
আমার বিরুদ্ধে গম চুরির কেইস আছে।
কালিপদ বালতি নামিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। পরবর্তী এক ঘণ্টা সে তার জায়গায় বসেই রইল, নড়ল না।
পুলিশের দলটা থামল আফজাল সাহেবের বাড়ির সামনে। ওসি সাহেব বাড়ির গেট খুলে বাইরের বাবান্দায় ঢুকলেন এবং গম্ভীর গলায় ডাকলেন, আফজাল সাহেব আছেন?
আফজাল সাহেব বের হয়ে এলেন।
ওসি সাহেব বললেন, এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পাবেন?
এদিকে কোথায় এসেছিলেন?
আসামি নিয়ে থানায় যাচ্ছি।
বসুন চা খেয়ে যান।
চা অবশ্যি এক কাপ খাওয়া যেতে পারে।
ওসি সাহেব পুলিশের দলটির দিকে তাকিয়ে বললেন, এ্যাই, তোমরা একটু দাঁড়াও। পুলিশের দল মবিনুর রহমানকে নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে রইল।
এরকমই কথা ছিল। আফজাল সাহেব বলে দিয়েছিলেন কোমরে দড়িবাঁধা অবস্থায় মবিনুর রহমানকে গেটের বাইরে দাড়া করিয়ে ওসি সাহেব তার বাড়িতে চা নাশতা খবেন।
ওসি সাহেব এই কাজটিই এখন করছেন। তবে কাজটি করতে তাঁর খুব ভালো লাগছে না। লোক জমছে। অনেক মানুষ জড়ো হয়ে গেছে। মানুষ বেশি জমলেই তারা একসঙ্গে এক জাতীয় চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। যার নাম মব সাইকোলজি। এই চিন্তা হঠাৎ কোন দিকে যাবে বলা মুশকিল। জড়ো হওয়া মানুষগুলি যদি মনে করে কাজটা অন্যায় হয়েছে তাহলে মুহুর্তের মধ্যে ক্ষেপে যাবে। ক্ষেপা জনতা— ভয়ঙ্কর।
রূপা বারান্দায় এসে শান্ত চোখে দৃশ্যটা দেখল। একবার মবিনুর রহমানের দিকে তাকিয়ে সে তাকাল তার বাবার দিকে। তারপর তাকাল ওসি সাহেবের দিকে।
ওসি সাহেব বললেন, আপনার মেয়ে?
আফজাল সাহেব বললেন, জি। এর নাম রূপা।
ওসি সাহেব বললেন, কেমন আছ মা?
রূপা বলল, ভালো আছি। আপনি স্যারকে কোমবে দড়ি বেঁধে আমাদের বাড়ির সামনে দাঁড়া করিয়ে রেখেছেন কেন?
আসামিকে থানায় নিয়ে যাওয়ার এইটাই পদ্ধতি, আসামি যে-ই হোক না কেন তাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যেতে হবে।
স্যারের বাড়ি থেকে থানায় যাবার রাস্তা তো এটা না। আপনি অনেকখানি ঘুরে আমাদের বাড়ির সামনে এসেছেন। কেউ নিশ্চয়ই এই কাজটা করার জন্যে আপনাকে বলেছে। তাই না?
ওসি সাহেব আফজাল সাহেবের দিকে তাকালেন।
আফজাল সাহেব কড়া গলায় বললেন, ভেতরে যাও রূপা।
রূপা কয়েক মুহুর্ত বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেল।
বাড়ির সামনে লোক বাড়ছে।
ওসি সাহেব চা শেষ না করেই উঠে পড়লেন। ব্যাপারটা আর ভালো লাগছে না। এত লোক জমছে কেন?
মবিনুর রহমানকে হাজতে ঢোকানোর তিন ঘণ্টার ভেতর থানার চারপাশে দুতিন হাজার মানুষ জমে গেল। তারা হৈচৈ, চিৎকার কিছুই করছে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই শান্ত। এই লক্ষণ ভালো না। খুব খারাপ লক্ষণ। এরা থানা আক্রমণ করে বসতে পারে। থানায় আগুন লাগিয়ে দিতে পারে। থানায় টেলিফোন আছে–অতিরিক্ত ফোর্স চেয়ে টেলিফোন করা যায়। কিন্তু টেলিফোন গত এক সপ্তাহ থেকে নষ্ট।
ওসি সাহেব থানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বললেন, আপনারা সরকারি কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছেন। এর ফলাফল ভালো হবে না। আমরা আসামি ধরে এনেছি। আসামিকে কোর্টে চালান করে দেব। সেখান থেকে জামিন হবে। যান, আপনারা বাড়ি চলে যান। ভীড় বাড়বেন না।
কেউ নড়ল না।
দুপুর গড়িয়ে গেল। মানুষ বাড়তেই থাকল।
ওসি সাহেব সেকেন্ড অফিসারকে বললেন হেড অফিসে খবর দিতে। আসামিকে ছেড়ে দিলে এখন কোনো লাভ হবে না। হিতে বিপরীত হবে। লোকজন থানান্য আগুন ধরিয়ে দিতে পারে। এই রিস্ক নেয়া যায় না।
সেকেন্ড অফিসার সাহেব থানা ছেড়ে বেরুতে গেলেন, লোকজন তাকে ঘিরে ফেলল। নিরীহ গলায় বলল, স্যার কোথায় যান?
তা দিয়ে আপনি কী করবেন?
যেতে পারবেন না স্যার।
যেতে পারব না। মানে? এটা কি মগের মুলুক নাকি?
সেকেন্ড অফিসার ভয়াবহ পুলিশী গর্জন দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। লোকজন কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। এই দৃষ্টির সঙ্গে তিনি পরিচিত। এই দৃষ্টির নাম–উন্মাদ দৃষ্টি।
জেবা চা খাচ্ছে। পিরিচে করে চা খাচ্ছে।
পিরিচ ভর্তি চা নিয়ে চুকচুক করে চুমুক দিচ্ছে। তাকে কেন জানি খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। রূপা ঘরে ঢুকে জেবাকে দেখল। জেবা বলল, ফুপু আমি চা খাচ্ছি। বলেই খিলখিল করে হাসল। চা খাওয়ার মধ্যে হাসির কী আছে রূপা বুঝতে পারছে না। আসলে এখন সে কিছুই বুঝতে পারছে না। তার কাছে সবই এলোমেলো হয়ে গেছে।