তানভির বলল, আমি তাই দেখছি। এবং খানিকটা বিস্মিতও হচ্ছি। তোমার স্যার অসাধারণ কি-না জানি না, তবে তুমি অসাধারণ।
রূপা বাবান্দা থেকে চলে এলো। আসলেই তার প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে। মনে হচ্ছে এখনো কেউ খাদ্য নি। আজ রাতে কি এ বাড়িতে খাওয়া হবে না? রূপা রান্নাঘরে ঢুকাল। রূপার মা রান্নাঘরে মোড়ায় একা একা বসে আছেন। রূপা বলল, প্ৰচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে মা। আমাকে ভাত দিয়ে দাও। আজ কী রান্না?
রূপার মা দীর্ঘ সময় মেয়েব দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, বৌমা যা বলল তা-কি अऊिा शा?
হ্যাঁ, সত্যি। এখন তোমাবা কী কববে? বটি দিয়ে কুপিয়ে আমাকে কুচিকুচি কবে নদীতে ফেলে দেবে?
রূপার মা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, তুই ঠিক কবে বল তো মা ঐ হারামজাদা মাস্টার কি তোর গায়ে হাত দিয়েছে?
রূপা শান্ত গলায় বলল, তুমি আমাকে ছোট করতে চাও, কর। কিন্তু মা উনাকে ছোট করবে না। উনি এসব কিছুই জানেন না।
রূপার মা কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতে ভাঙা গলায় বললেন, হারামজাদা জানে না মানে? হারামজাদা ঠিকই জানে। জেনেশুনে সে তোকে জাদু করেছে। তুই হচ্ছিস গাধার গাধা। মহাগাধা। তুই কিছুই বুঝতে পারিস নি। তোর বাবা ভয়ঙ্কর রাগ করেছে। সে ঐ ছোটলোকটাকে এমন শাস্তি দেবে যে সে তার বাপ-মার নাম ভুলে যাবে।
কী শান্তি দিবে? খুন করবে?
কথা বলিস না তো। তোর কথা শুনে রাগে সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে। তুই যা আমার সামনে থেকে।
তিনি শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। রূপা নিজের ঘরে চলে এলো। তার অসম্ভব ভয় লাগছে। বাবা মাস্টার সাহেবকে শাস্তি দেবেন। এটা নিশ্চিত। তার অপরাধে শান্তি পাবে অন্য একজন। কী শাস্তি কে জানে। মেরে ফেলবেন না নিশ্চয়ই। মানুষ এত নিচে নামতে পারে না। চেষ্টা করেও পারে না। স্কুলের চাকরি চলে যাবে। তাকে নীলগঞ্জ ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা হলে শাপে বর হয়। সেও স্যারের সঙ্গে চলে যেতে পারে। অনেক দূরে কোথাও। যেখানে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। কেউ না।
মিনু এসে ডাকল, খেতে আস রূপা।
রূপা বলল, ক্ষিধা মরে গেছে ভাবি। তোমরা খাও। আমি কিছু খাব না।
তোমার ভাই তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছে, খেয়ে আমার ঘরে আস।
আমি এখন কারো সঙ্গেই কথা বলব না ভাবি। আমার প্রচণ্ড মাথা ধবেছে। আমি দরজা বন্ধ করে শুয়ে থাকব।
তোমার ভাই কিন্তু রাগ করবে।
রাগ যা কবার করেছে। এখন দেখা করতে গেলেও সেই রাগের উনিশ-বিশ হবে না। আমি সকালে কথা বলব।
আফজাল সাহেব রাত এগারোটায় ভাত না খেয়েই জুতা-জামা পরে ঘর থেকে বেবোলেন। রফিক জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছেন? তিনি জবাব দেন নি। কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা এখন তার নেই। রফিক বলল, আমি কী সঙ্গে আসব বাবা?
তিনি হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।
রফিক সঙ্গে চলল। বাবা প্ৰচণ্ড রেগে আছেন। তার হাই ব্লাড প্রেসার। এ রকম অবস্থায় তাকে একা ছাড়া উচিত না। তাছাড়া আকাশের অবস্তা ভালো না। যে৬াবে মেঘ ডাকছে তাতে মনে হয় ঝড়-টড় হবে।
রাস্তায় নেমেই রফিক বলল, যাচ্ছেন কোথায় বাবা?
থানায় যাচ্ছি।
থানায়?
হুঁ। ওসি সাহেবকে বলব, ঐ শুওরের বাচ্চাকে কাল যেন কোমরে দড়ি বেঁধে হজিতে নিয়ে ঢোকায়। নীলগঞ্জের সমস্ত মানুষ যেন তাকে দেখে।
ওসি সাহেব কি এটা করবেন?
অবশ্যই করবে। থানার বড় সাহেবরা যে কোনো অন্যায় আগ্রহ নিয়ে কবে। আর এটা কোনো অন্যায় না। ব্যাটার বিরুদ্ধে কেইস আছে। গম চুরির কেইস।
রফিক বলল, হাজতে নিয়ে ঢুকানোর আইডিয়াটা মন্দ না বাবা। রূপা যদি শোনে চুরির অপরাধে ব্যাটাকে হাজতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাহলে তার মোহভঙ্গ হতে পাবে।‘
মোহভঙ্গ হোক আর না হোক, হারামজাদার বিষদাঁত আমি ভেঙে দেব। ন্যাংটো করে সারা নীলগঞ্জ আমি তাকে ঘুরাব। কুত্তা লেলিয়ে দেব। আমি খেজুরের কাটা দিয়ে ঐ কুত্তার চোখ গেলে দিব।
এত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আমরা ঠাণ্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা ট্যাকল করব। খুব ঠাণ্ডা মাথায়।
রূপা ঘুমুতে গেল বৃষ্টি নামার পর। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর ধুয়েমুছে যাবে। রূপেশ্বর এবার বান ডাকবে। নিশ্চয়ই ডাকবে। ভাবতেই রূপার ভালো লাগছে। ডাকুক, ভয়াবহ বান ডাকুক। নীলগঞ্জ ধুয়ে-মুছে যাক রূপেশ্বরের জলে।
বাতি নেভাতেই জেবা ডাকল, ফুপু।
রূপা বলল, হুঁ।
বাড়িতে এখন দুটা দল হয়ে গেছে।
হুঁ, হয়েছে।
তোমার এক দল আর বাকি সবার দল।
রূপা কিছু বলল না। আসলে কোনো কিছুই সে শুনছে না। প্রচণ্ড জ্বরের সময় যেমন হয় এখন তার তাই হচ্ছে। কোনো কথা পরিষ্কার তার মাথায় ঢুকছে না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একটু যেন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। চোখ জ্বালা করছে।
জেবা বলল, ওদের দলে এত মানুষ আর তোমার দলে আছি শুধু আমি। দুজনের দল–তাই না ফুপু?
হুঁ।
নদীর দিক থেকে শো-শো শব্দ আসছে। রাত যত বাড়ছে শব্দ ততই স্পষ্ট হচ্ছে।
রূপা বিছানায় উঠতে উঠতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, এ বছর রূপেশ্বর নদীতে বান ডাকবে।
বান ডাকলে কি তুমি খুশি হও ফুপু?
হ্যাঁ হই। জলের তোড়ে ভেসে গেলে খুশি হই। জেবা হাসল। খিলখিল হাসি। অন্ধকারে তার হাসি অদ্ভুত শোনাল। মনে হচ্ছে সে হাসি যেন কলকল শব্দে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।
ফুপু।
ফুপু ফুপু করবি না তো। ঘুমো।
একটা কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়ব। কথাটা হচ্ছে–কাল সকালটা তোমার জন্যে খুব কষ্টেব্য হলে। খুব কষ্টেল, তবে আমি তো তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবে।