কী বলছ তুমি রূপা?
সত্যি কথা বলছি ভাবি।
সত্যি কথা বলছ?
হ্যাঁ, সত্যি কথা বলছি।
তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
হ্যাঁ ভাবি মাথা খারাপই হয়েছে। অব কিছু বলবে?
মিনু বলার মতো কিছু পেল না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। রূপা বলল, তুমি কি আরো কিছু বলবে?
বলব।
বলো, আমি শুনছি…।
মিনু কিছু বলতে পারল না, কারণ তার মাথা পুরোপুরি গুলিয়ে গেছে। মাথায় কোনো কিছুই আসছে না। রূপাকে দেখে এখন তার মনে হচ্ছে কিছু বলে লাভ নেই। এই মেয়েটি এখন আর কিছুই শুনবে না। সে বাস করছে অন্য জগতে।
রূপা বলল, ভাবি, আমি এখন যাই। তুমি আমাকে কী বলবে ভেবে ঠিকঠাক করে রাখ। পরে শুনব।
বাইরের ঘরের বারান্দায় তানভির হাঁটাহঁটি করছে। তার হাতে জ্বলন্ত সিগাবেট। বাবান্দা অন্ধকার, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। জ্বলন্ত সিগারেটের উঠানামা থেকে বোঝা যায় এখানে একজন মানুষ আছে যে বারান্দার এ-মাথা থেকে ও-মাথায় যাচ্ছে।
কাঁপা বারান্দায় এসে তীক্ষ্ণ গলায় ডাকল, একটু শুনে যান তো! তানভির এগিয়ে এলো। রূপা বলল, আপনাকে বলেছিলাম কাউকে কিছু না বলতে। আপনি সবাইকে বলে বেড়িয়েছেন, তাই না?
তানভির বলল, বলা প্রয়োজন বোধ করেছি বলেই বলেছি।
প্ৰয়োজন বোধ করলেন কেন?
ভয়ঙ্কর কোনো ভুল কেউ করতে গেলে তাকে ভুল দেখিয়ে দিতে হয়। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হয়।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ, তাই। তোমান বয়স কম। কাজেই তুমি বুঝতে পারছি না। তুমি কী বলছি কিংবা কী করছ।
আপনার ধারণা আমি ভয়ঙ্কর একটা ভুল করেছি?
অবশ্যই।
কেউ যদি ইচ্ছা কবে ভুল করতে চায় তাকে কি ভুল করতে দেয়া হবে না?
না।
কোনটা ভুল কোনটা শুদ্ধ তা আপনি নিজে জানেন?
সব জানি না। তবে তোমার চেয়ে বেশি জানি।
আপনার বয়স আমার চেসে বেশি, তাই বেশি জানেন?
বয়স একটা ফ্যাক্টব তো বটেই!
যে গাধা সে আশি বছবেও গাধা থাকে, বয়স কোনো ফ্যাক্টর না।
রূপা, আমি গাধা নাই।
তা নন। তবে আপনি খুব বুদ্ধিমানও নন।
খুব বুদ্ধিমান নই তা কেন বলছ?
খুব যারা বুদ্ধিমান তারা তাদের বুধিব ধার অন্যকে দেখাবার জন্যে ব্যস্ত থাকে না। অল্পবুদ্ধির মানুষরাই অন্যদের বুদ্ধির খেলা দেখাতে চায়। অন্যদের চমৎকৃত করতে চায়। বুদ্ধিমানরা তা চায় না। কারণ তারা জানে তার প্রয়োজন নেই।
আমি কী বুদ্ধির খেলা দেখাতে গিয়েছি?
অবশ্যই গেছেন। আপনার কিছু তৈরি গল্প আছে। যে সব গল্প বলে আপনি চমক লাগাবার চেষ্টা করেন। যেমন–মোনালিসার গল্প। গল্প বলার সাজ-সরঞ্জামও আপনার সঙ্গে থাকে। মানিব্যাগে থাকে ছোট্ট মোনালিসার ছবি। এই গল্প আমাদের বলার আগে আপনি শ খানেক লোককে আগে বলেছেন। সবাই চমৎকৃত হয়েছে।
তুমি হও নি?
আমিও হয়েছিলাম। কিন্তু যেই মুহুর্তে আপনি মানিব্যাগ থেকে ছবি বের করলেন। সেই মুহুর্তেই বুঝলাম মানুষ হিসেবে আপনি খুবই সাধারণ।
তোমার ঐ স্যার বুঝি মানুষ হিসেবে অসাধারণ।
হ্যাঁ। আমার কাছে অসাধারণ।
তোমার কাছে অসাধারণ হলেই সে মানুষ হিসেবে অসাধারণ হবে? আমার তো ধারণা সে এভারেজ ইন্টেলিজেন্সের একজন মানুষ। দুরবিন নিয়ে কিছু কায়দা-কানুন করছে যা দেখে তোমরা চমৎকৃত হচ্ছি।
রূপা চুপ করে রইল। যদিও তার ইচ্ছা করছে কঠিন কিছু বলে লোকটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। কিছু মনে পড়ছে না। তানভির হাতের সিগাবেট ফেলে দিয়ে আরেকটি ধরাল। তার ভাবভঙ্গিতে আগের অস্থিরতা নেই। তবে রূপা মেয়েটিকে এখন সে আগেব মতো তুচ্ছ বালিকা হিসেবে অগ্রাহ্য করছে না। সে বুঝতে পারছে এই মেয়েটিব সঙ্গে সাবধানে কথা বলতে হবে।
রূপা!
জি।
পাড়াগায় যারা থাকে তাদের জীবন মোটামুটি নিস্তরঙ্গ। বড় ধরনের কিছু চারপাশে ঘটে না। দুরবিন নিয়ে কেউ উপস্থিত হলে তাকেই মনে হয় গ্যালিলিও। আসলে তার প্ৰতিভা হয়তো ঐকিক নিয়মে ভালো অঙ্ক করায় সীমাবদ্ধ। কাউকে স্পেসিফিক্যালি মিন করে আমি বলছি না। তুমি রাগ করো না।
আমি রাগ করছি না। ব্যাপারটা সত্যিা হলে রাগ হতো। সত্যি না বলেই রাগের বদলে হাসি পাচ্ছে।
তোমার স্যার সম্পর্কে আমি এমন একটা কথা জানি যা শুনলে তুমি হয়তো রাগ করবে।
বলুন।
শুনেছি তিনি গম চুরি করেছেন। স্কুলের বরাদ্দ একশ মণ গম লোপাট করে দিয়েছে। তার নামে কেস হয়েছে।
কে বলেছে আপনাকে?
এটা কোনো গোপন ব্যাপার না। আমি তোমার বাবার কাছ থেকেই শুনেছি।
তিনি আপনাকে কখন বললেন, আজ?
হ্যাঁ।
বাবা খুব ভালো করেই জানেন এটা মিথ্যা। তার পরেও তিনি এটা আপনাকে কেন বলেছেন তা কি আপনি বুঝতে পারছেন?
না।
জানি বুঝতে পারবেন না। কারণ আপনার এত বুদ্ধি নেই। যদি আপনার খানিকটা বুদ্ধি থাকত তাহলে আপনি বুঝে ফেলতেন যে বাবা এটা আপনাকে বলছেন যাতে আপনার সব রাগ গিয়ে ঐ মানুষটার উপর পড়ে। যাতে আপনি ভাবতে শুরু করেন যে, সব দোষ ঐ চোর মানুষটার। রূপা নামের মেয়েটার কোনো দোষ নেই।
তানভিরের বিস্ময়ের সীমা রইল না। রূপা মেয়েটি তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। গ্রামে বড় হওয়া বাচ্চা একটা মেয়ে এমন গুছিয়ে কথা বলছে–আশ্চর্য!
তানভিব বলল, এই চেয়ারটায় বস রূপা। মেজাজ ঠাণ্ডা কর, তারপর কথা বলি। রূপা বলল, আমার মেজাজ খুব ঠাণ্ডা আছে। কেন আমার মেজাজ এত ঠাণ্ডা তা জানেন?
না।
একদিন না একদিন এ-রকম একটা ব্যাপার ঘটবে তা আমি জানতাম! একদিন সবাই জানবে। তুমুল হৈচৈ শুরু হবে। মা ক্রমাগত কাঁদতে থাকবেন। বাবা স্তম্ভিত হয়ে বাবান্দায় ইজি চেয়ারে বসে থাকবেন। এটা আমি জানতাম। এই ঘটনার জন্যে আমার মানসিক প্ৰস্তৃতি ছিল বলেই আমি এত সহজভাবে সব কিছু নিতে পারছি।