তাঁর ক্লাসে ছাত্রদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকতে হয়। হাসা যায় না, পেনসিল দিয়ে পাশের ছেলের পিঠে খোঁচা দেয়া যায় না, খাতায় কাটাকুটি খেলা যায় না। মনের ভুলেও কেউ যদি হেসে ফেলে তিনি হতভম্ব হয়ে দীর্ঘসময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে কঠিন গলায় বলেন, সায়েন্স ছেলেখেলা নয়। হাসাহাসির কোনো ব্যাপার এর মধ্যে নেই। সায়েন্স পড়বার সময় তুমি হেসেছি, তার মানে বিজ্ঞানকে তুমি উপহাস করেছ। অন্যায় করেছি। তার জন্যে শাস্তি হবে। আজ ক্লাস শেষ হবার পর বাড়ি যাবে না। পাটিগণিতের সাত প্রশ্নমালার ১৭, ১৮, ১৯ এই তিনটি অঙ্ক করে বাড়ি যাবে। ইজ ইট ক্লিয়ার?
মবিনুর রহমান স্কুল থেকে প্রায় দুমাইল দূরে দুকামরার একটা পাকা ঘরে একা বাস করেন। ঘরটি জরাজীর্ণ। ভেঙে পড়তে পড়তেও কেন জানি পড়ছে না। ছোটখাটো ভূমিকম্প কিংবা দমকা বাতাসের জন্যে অপেক্ষা করছে। তাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয় না। বাড়িটি সাপেব আড্ডাখানা। বর্ষাকালে যেখানে-সেখানে সাপ দেখা যায়। বাড়ির মালিক কালিপদ রূপেশ্বর স্কুলের দপ্তরি। সাপের ভয়েই সে পূৰ্বপুরুষের ভিটায় বাস করে না। সাপের কামড়ে তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী এবং দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীর প্রথম সন্তান মারা গেছে। মবিনুর রহমান সেই বাড়িতে সুখেই আছেন। স্বপাক আহার করেন। তাকে নিরামিষভোজী বলা চলে। মাছ মাংস খান না। না খাওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে মাছ-মাংস রাঁধতে জানেন না। তার বাড়িটা রূপেশ্বর নদীর ধারে। শীতকালে এই নদীতে পায়ের পাতাও ভিজে না। বর্ষাকালে কিছু পানি হয়। গত বর্ষায় মবিনুর রহমান দেড় হাজার টাকা দিয়ে একটা নৌকা কিনেছেন। নৌকার কোনো মাঝি নেই। নৌকা ঘাটে বাধা থাকে। মাঝে মাঝে তিনি নৌকার ছাদে সারারাত বসে থাকেন। নৌকার ভেতরটাও সুন্দর। ঘরের মতো। দুদিকে দরজা আছে। বাথরুম আছে। বিছানা বালিশ দিয়ে ভেতরটা চমৎকার গোছানো। মবিনুর রহমানের প্রিয় কিছু বই নৌকায় থাকে। অধিকাংশই গ্ৰহ নক্ষত্র বিষয়ক বই।
এই জাতীয় আধাপাগল নিঃসঙ্গ মানুষকে সবাই খানিকটা ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখে। মবিন্নুর রহমানের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। এই অঞ্চলের মানুষদের প্রচুর ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। এই ভালোবাসা পাবার পেছনের আরেকটি কারণ হচ্ছে, তিনি শিক্ষক হিসেবে প্রথম শ্রেণীব। ইতিমধ্যেই অঙ্কের ড়ুবো জাহাজ হিসেবে তাঁর খ্যাতি বটেছে। ড়ুবো জাহাজ নামকরণের রহস্য হচ্ছে তিনি যে খুব ভালো অঙ্ক জানেন এটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।
আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল
আজ বৃহস্পতিবার, হাফ স্কুল।
সেকেন্ড পিবিয়ডে মবিনুর রহমানের কোনো ক্লাস নেই। তিনি টিচার্স কমনরুমে তাঁর নিজের চেয়াবে চুপচাপ বসে আছেন। তাঁর বুক পকেটের ঘড়ি শতকরা আশি ভাগ হিউমিডিটির কথা বলছে। কিন্তু আকাশে মেঘের ছিটেফোঁটা নেই। ব্যাপারটা ঠিক মিলছে না। মবিনুর রহমানের ভুরু কুঁচকে আছে এই কারণে। কমনরুমে আরো কিছু শিক্ষক আছেন। তারা সরকারি ডি এ নিয়ে আলাপ করছেন। এবারের সরকারি সাহায্য এখনো এসে পৌঁছায় নি। মবিনুর রহমান এইসব আলোচনায় অংশগ্ৰহণ করছেন না। কখনোই করেন না। স্কুলের ধর্ম ও আরবি শিক্ষক জালালুদ্দিন সাহেবের চেয়ার মবিন্নুর রহমানের চেয়ারের ঠিক পাশেই। পাশাপাশি বসতে হয় বলেই বোধহয় দুজনের মধ্যে সামান্য সখ্যতা আছে। জালালুদ্দিন সাহেব মবিনুর রহমানকে তুমি তুমি করে বলেন। তাঁর কথাবার্তা থেকে মনে হতে পারে যে বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর প্রচুর কৌতূহল। তা ঠিক না। কোনো বিষয় সম্পর্কেই তার কোনো আগ্রহ নেই। ভদ্রলোক কোনো ক্লাসই ঠিকমতো নেন না। আজও ক্লাস শেষ হবার কুড়ি মিনিট আগে বের হয়ে এলেন। মবিনুর রহমানের পাশে বসতে বসতে মধুর গলায় বললেন, তারপর মবিন, তোমার সায়েন্সের খবর কী?
কোন খবরটা জানতে চান?
বৃষ্টি হবে কী হবে না?
বৃষ্টি হবে। হিউমিডিটি ৮০।
জালালুদ্দিন পানের কোটা খুলতে খুলতে বললেন, বৃষ্টি যে হবে এটা বলার জন্য তোমার সায়েন্স লাগে না। আষাঢ় মাস, বৃষ্টি তো হবেই। পান খাবে না-কি?
জি-না।
খাও একটা জর্দা দেয়া আছে। আকবরী জর্দা। অতি সুঘ্ৰাণ।
আমি পান খাই না।
এমনভাবে তুমি কথাটা বললে যেন পান খাওয়া বিরাট অপরাধ। পান খাওয়া কোনো অপরাধ না। এটা হজমের সহায়ক। দাঁত ভালো থাকে।
জালালুদ্দিন একসঙ্গে দুটো পান মুখে দিলেন, আঙুলের ডগায় চুন নিতে নিতে বললেন, আচ্ছা মবিন, এই যে পানের সঙ্গে আমরা চুন খাই। কেন খাই? তোমার সায়েন্সে কী বলে?
আপনি সত্যি জানতে চান?
অবশ্যই চাই। আরবি পড়াই বলে সায়েন্স জানব না? সায়েন্সের সঙ্গে এরাবিকের তো কোনো বিরোধ নাই।
মবিন শীতল গলায় বললেন, পানের সঙ্গে চুন কেন খাওয়া হয়। আমি ব্যাখ্যা কবছি। মন দিয়ে শুনুন।
শুনছি। তুমি হাসি মুখে বলো। মুখ এমন শুকনো করে রেখেছ কেন?
মবিনুর রহমান ক্লাসে বক্তৃতা দেয়ার ঢং-এ বললেন, শুধু শুধু পান চিবুলে দেখবেন টক টক লাগছে। টক লাগার কারণ হচ্ছে পানে এক ধরনের এসিড বা অন্ন আছে। অম্ল টক স্বাদযুক্ত। চুন হচ্ছে এক জাতীয় ক্ষার। ক্যালসিয়াম হাইড্রক্সাইড। এই ক্ষার অম্নকে প্রশমিত করে। এই জন্যেই পানের সঙ্গে চুন খেতে হয়।
ও আচ্ছা আচ্ছা। ভালো কথা। অম্ল এবং ক্ষার। ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। অনেকদিন থেকে মনের মধ্যে একটা খটকা ছিল। আচ্ছা, এখন বলে তো দেখি, তেঁতুলের সঙ্গে চুন মিশালে কি তেঁতুলের টক-ধর্ম চলে যাবে?