মশারি ফেলে মশারির ভেতর চুপচাপ বসে আছে। রূপা বিক্ষিত হয়ে বলল, এখনো জেগে?
হুঁ।
কেন?
ঘুম আসছে না?
না।
রূপা হালকা গলায় বলল, আমরা সুন্দর ম্যাজিক দেখলাম। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকলে তোমারও ভালো লাগত। এসো এখন ঘুমানো যাক। ঘুমানোর আগে কি পানি খাবে? বাথরুমে যাবে?
না।
বাতি নিভিয়ে রূপা মশারির ভেতর ঢুকতেই জেবা বলল, ফুপু ঐ লোকটা তোমাকে পছন্দ করেছে। খুব বেশি পছন্দ করেছে। এখন সবাই মিলে ঐ লোকটার সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে দেবে।
রূপা হালকা গলায় বলল, দিলে দিবে। কী আর করা।
জেবা রূপার কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল, এখন থেকে এই বাড়িতে দুটা দল হলো। ঐ লোকটাব একটা দল। সবাই সেই দলে। আর তোমার একার একটা দল। তোমাল দলে শুধু আছি আমি একা।
রূপা বলল, কী সব অদ্ভুত কথা যে তুমি বলো। এখন ঘুমাও তো।
জেলা বলল, আমি মোটেও অদ্ভুত কথা বলছি না। আমি যে অদ্ভুত কথা বলছি না তুমি তাও জানো। খুব ভালো করে জানো।
কাঁপা বলল, ঘুমাও তো জোরা। প্লিজ ঘুমানোর চেষ্টা করি!
আচ্ছা।
জেবা পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল। রূপা ঘুমোতে পারল না। রাত জাগা তার অভ্যাস হয়ে ছে? জেগে থাকতে খারাপও লাগছে না। তক্ষক ডাকছে। গভীর বাতে তক্ষকগুলি অন্যািরকম কবে ডাকে। দিনে তাদের ডাক এক রকম, বাতে অন্য রকম। স্যারকে একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। উনি নিশ্চয়ই চমৎকার কোনো ব্যাখ্যা দেবেন। স্যারকে একটা ধাঁধাও জিজ্ঞেস কবিতে হবে। তব্দে ধাঁধা জিজ্ঞেস করলে উনি খানিকটা হকচকিয়ে যান এবং এমন অস্থিবি বোধ করেন যে রূপারই খারাপ লাগে। একবার সে স্যারকে জিজ্ঞেস করল, স্যার বলুন তো এটা কী–আমবাগানে টুপ করে শব্দ হলো। একটা পাকা আম গাছ থেকে পড়েছে।
যে দুজন শুনল সে দুজন গেল না।
অন্য দুজন গেল।।
যে দুজন গেল সে দুজন দেখল না।
অন্য দুজন দেখল।।
যে দুজন দেখল সে দুজন তুলল না।
অন্য দুজন তুলল।।
যে দুজন তুলল সে দুজন খেল না।
অন্য দুজন খেল।।
স্যার এখন বলুন ব্যাপারটা কী? তিনি গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। করুণ গলায় বললেন–ব্যাপারটা তো মনে হচ্ছে খুব জটিল।
মোটেই জটিল না স্যার। অত্যন্ত সহজ।
তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, জটিল জিনিসের ব্যাখ্যা খুব সহজ হয়। সহজ জিনিসের ব্যাখ্যাই জটিল।
রূপার মনে হলো স্যারের কথাটা তো খুব সত্যি। ভালোবাসা ব্যাপারটা অত্যন্ত সহজ কিন্তু ব্যাখ্যা কি অসম্ভব জটিল না?
তক্ষক ডাকছে। জেগে আছে রূপা। আজ রাতটাও মনে হচ্ছে তাকে জেগেই কাটাতে হবে।
কিছু-একটা হয়েছে রূপাদের বাড়িতে
কিছু-একটা হয়েছে রূপাদের বাড়িতে।
সবার মুখ হাসি হাসি। সবার মধ্যে চাপা উত্তেজনা। বড় ধরনের আনন্দের কোনো ঘটনা। এ-বাড়িতে ঘটে গেছে কিংবা ঘটতে যাচ্ছে। তবে এই ঘটনা নিয়ে কেউ আলোচনা কবীতে চাচ্ছে না। আলোচনা করতে না চাইলেও রূপার ধারণা সে ব্যাপারটা আঁচ করতে পারছে।
বিকেলে মিনু বলল, বরূপা শুনে যাও তো। এসো আমার সঙ্গে।
কোথায়?
ছাদে।
কোনো গোপন কথা?
গোপন কথা কিছু না, প্রকাশ্য কথা–ছাদে তোমার চুল বাঁধতে বাঁধতে বলব।
রূপা ছাদে গেল। মিনু তার চুল বাঁধতে বাধতে বলল, তানভিব জায়গাটা ঘুবে ফিরে দেখতে চায়। তুমি তাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোবে।
এটাই তোমার প্রকাশ্য কথা?
না এটা প্রকাশ্য কথা না। প্রকাশ্য কথা হলো–তানভির কাল রাতে মুজিকের আসর শেষ হবার পরে তোমার ভাইয়াকে বলেছে–সে তোমাকে পছন্দ করেছে। শুধু পছন্দ না, অসম্ভব পছন্দ করেছে।
ও আচ্ছা!
ঘটনা এইখানেই শেষ না। আজ ভোরে সে বলেছে, সে এই বাড়িতেই তোমাকে বিয়ে করতে চায়। তারপর বউ নিয়ে চলে যাবে।
এত তাড়া কেন?
তাড়া না। কথা এমনই ছিল। সে খুব খেয়ালি ছেলে। আমাদের এখানে আসার আগে তার বাবা তোমার মেজো ভাইকে খবর দিয়ে নিয়ে যান এবং বলেন–আমার ছেলে যদি কোনো মেয়েকে পছন্দ করে ওকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেবে। এই ছেলে বড় যন্ত্রণা করছে। কিছুতেই তাকে বিয়ে করাতে রাজি করানো যাচ্ছে না।
রূপা বলল, বিয়েটা হচ্ছে কবে? আজই না-কি?
বিয়ে দিয়ে দেয়া। তা তো সম্ভব না। সবাইকে খবর দিতে হবে। ছেলের আত্মীয়স্বজনদের জানাতে হবে। দিন সাতেক তো লাগবেই।
এই সাতদিন আমি ভদ্রলোককে নিয়ে গ্রাম দেখাব, নদী দেখাব?
হ্যাঁ, বন্ধুর মতো পাশাপাশি থাকবে। প্ৰেম প্রেম খেলবে।
রূপা সহজ গলায় বলল, আচ্ছা।
মিনু বলল, তোমার ভাগ্য দেখে আমার ঈর্ষা হচ্ছে রূপা।
রূপা বলল, আমার নিজেরই ঈর্ষা হচ্ছে, তোমার তো হবেই। আমি বৃশ্চিক রাশির মেয়ে। বৃশ্চিক রাশির মেয়েদের ঈর্ষা না করে উপায় নেই। এরা হয় খুব উপরে উঠবে। কিংবা ধুলার সঙ্গে মিশে যাবে। এদের কোনো মধ্যম পন্থা নেই।
কে বলেছে?
রাশিচক্র বলে একটা বই পড়ে সব জেনে বসে আছি।
রূপা অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসল। এই হাসি মিনুর ভালো লাগল না। তবে সে সাজগোজ করতে মোটেই আপত্তি করল না। আকাশী রঙের একটা শাড়ি পরল। যা কখনো করে না। তাই করল, মার কাছ থেকে চেয়ে গয়না পরল। দীর্ঘ সময় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। জেবা পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। জেবাকে বলল, কেমন দেখাচ্ছে জেবা?
জেবা হাসল। জবাব দিল না।
বলো তো আমাকে ইন্দ্ৰাণীর মতো লাগছে কি-না?
জেবা এই প্রশ্নোবও জবাব দিল না। আবারো হাসল। যেন সে রূপার ছেলেমানুষিতে খুব মজা পাচ্ছে।