রূপার চোখে পানি এসে গেছে। জেবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখ ভাবলেশহীন। তবে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি।
হেড মাস্টার হাফিজুল কবির
হেড মাস্টার হাফিজুল কবির সাহেব আজ একটু ব্যস্ত। ব্যস্ততার নানাবিধ কারণের একটি হচ্ছে নেত্রকোনা থেকে সিও রেভিন্যু এসেছেন গম চুরির তদন্তে। ভদ্রলোকের বয়স অল্প। নিতান্তই চেংড়া ধরনের। অল্পবয়স্ক অফিসাররা ঠাণ্ডা মাথায় কিছু ভাবে না। দশজনের কথা শুনতে চায় না। হুঁট করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। গরম গরম কথা বলে। মানী লোকের মান রাখতে জানে না।
হাফিজুল কবির সাহেব যত্নের চূড়ান্ত করছেন। সিও সাহেব স্কুলে পা দেয়ার পরপরই তাকে দৈ মিষ্টি দেয়া হয়েছে। চায়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। কালিপদ স্কুলের বারান্দায় কেরোসিন কুকারে চা বসিয়ে দিয়েছে। হাফিজুল কবির সাহেব এক প্যাকেট বেনসন সিগারেট এনে সিও সাহেবের সামনে রেখেছেন। তিনি প্যাকেট খুলে একটা সিগাবেটি ধরিয়েছেন। এটা আশার কথা। যদি বলতেন–সিগারেট কেন? তাহলে চিন্তার ব্যাপার হতো।
সিও সাহেব বললেন, গম চুরির ব্যাপারে আপনারা নিজেরা কোনো তদন্ত করেছেন?
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, জি না স্যার।
করেন নি কেন?
তদন্ত কমিটি কবা হয়েছে কিন্তু কমিটির বৈঠক বসে নি।
বৈঠক বসল না কেন?
সেটা স্যার আমি বলতে পারি না। আমি কমিটিতে নেই।
মবিন সাহেবকে কি আপনি সরাসরি জিজ্ঞেস করেছেন?
কী জিজ্ঞেস করব? আমি কিছু জিজ্ঞেস করি নি।
গম চুরির বিষয়ে তাঁর কী বলাব আছে তা জানতে চেয়েছেন?
জি-না।
জিজ্ঞেস করেন নি কেন? মানী লোক।
জিজ্ঞেস করতে লজ্জা লাগল।
ডাকুন, উনাকে ডাকুন। আমি জিজ্ঞেস করি…
উনি স্যার স্কুলে আসেন নি। কয়েকদিন ধরেই আসছেন না।
আই সি!
লজাতেই বোধহয় আসতে পারছেন না।
চুরি করবার সময় মনে ছিল না, এখন লজ্জায় মরে যাচ্ছেন। শুনুন হেড মাস্টার সাহেব, অ্যাডমিনিষ্ট্রেশান খুব সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নিয়েছে। আপনি জানেন কি-না জানি না। জাতীয় দৈনিকে চিঠি ছাপা হয়েছে।
বলেন কী স্যার!
হেড মাস্টার সাহেব বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলেন। চিঠি ছাপার ব্যাপারটা তিনি খুব ভালোমতো জানেন। চিঠি তারই লেখা। নেত্রকোনা গিয়ে নিজের হাতে পোস্ট করেছেন। সব কটা দৈনিকে চিঠি দিয়েছিলেন। শুধু একটাতে ছাপা হয়েছে। হেড মাস্টার সাহেব বললেন, চিঠিতে কী লেখা সারা?
সিও সাহেব ব্রিফ কেইস থেকে খবরের কাগজ বের করে এগিয়ে দিলেন। বিরস মুখে বললেন, কাগজটা আপনার কাছে রেখে দিন। হেড মাস্টার সাহেব অনেকবার পড়া চিঠি আবারো পড়লেন–
সরিষায় ভূত
নেত্রকোনা নীলগঞ্জ হাই স্কুলে সম্প্রতি গম চুরির এক কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়াছে। উক্ত স্কুলের জনৈক প্ৰবীণ শিক্ষক স্কুলের জন্য বরাদ্দকৃত ১০০ বস্তা গমের মধ্যে ৯০ বস্তা গায়েব করিয়া দেন। এই ঘট বা অত্র অঞ্চলে তমুল আলোড়ন সৃষ্টি করিযাছে। যাহাদের হাতে শিশু-কিশোরদের নীতি শিক্ষাব দায়িত্ব ন্যস্ত তাহারা যদি চৌর্যবৃত্তিতে লিপ্ত হন তাহা হইলে আমাদের ভবিষ্যৎ কী। জনগণের মনে আজ এই প্রশ্ন আলোড়িত হইতেছে।
জনৈক অভিভাবক
নীলগঞ্জ হাই স্কুল
হেড মাস্টার সাহেব শুকনো মুখে বললেন, পত্রিকায় খবর কে দিল?
সিও সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন, পত্রিকায় খবং কে দিল এটা নিয়ে চিন্তা করে লাভ কী? আমরা অ্যাকশন কী নিয়েছি সেটা হলো কথা। ক্রিমিন্যাল কেইস করা হয়েছে?
জি-না স্যার। শুধু জিডি এন্ট্রি করেছি। কেইস করে দিন। মিস এপ্ৰোপ্রিয়েশন অব পাবলিক ফান্ড। সেটা কি স্যার ঠিক হবে?
অবশ্যই ঠিক হবে। এই সঙ্গে সাসপেনশন অর্ডার দিয়ে দিন।
সাসপেনশন?
হ্যাঁ।
স্কুলে স্যার ও-রকম ব্যবস্থা নেই।
ব্যবস্থা নেই, ব্যবস্থা করুন। স্কুলে গভর্নিং বডির মিটিং দিন। মিটিং-এ ডিসকাস করুন।
আপনি বললে অবশ্যই করব।
মনে রাখবেন, বর্তমান সরকার এ-জাতীয় কেলেংকারি সহ্য করবে না। দুনীতিমুক্ত সমাজ আমাদেরই তৈরি করতে হবে। পত্র-পত্রিকায় চিঠি ছাপা হয়ে গেছে। জনমত তৈরি হয়ে গেছে। আর অবহেলা করা যায় না।
তা তো বটেই স্যার।
গভর্নিং বডির মিটিং ডাকুন। আজই ডাকুন।
জি আচ্ছা স্যার।
গভর্নিং বডির মিটিং-এ পত্রিকায় ছাপা চিঠি পড়া হলো। হেড মাস্টার সাহেব সিও বেভিনিউ সাহেব যা যা বলে গিয়েছেন সব আবারো বললেন এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কী করি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রাইভেট স্কুল হলেও সরকারি চাপ অগ্রাহ্য করা সম্ভব না। আমরা গভর্নমেন্ট ডিএ নেই। ডিএ বন্ধ হয়ে গেলে স্কুল উঠিয়ে দিতে হবে। গভর্নিং বডির একজন মেম্বাব হলেন রূপার বাবা আফজাল সাহেব। তিনি বললেন, পুরো ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য। মবিনুর রহমান এই কাজ করতে পাবেন না। কোথাও ভুল হয়েছে। অবশ্যই ভুল হয়েছে।
হেড মাস্টার সাহেব বললেন, ভুল হবার কোনো ব্যাপার না। মবিন সাহেব সিগনেচার করে গম নিয়েছেন।
আত্মভোলা মানুষ। তাকে প্যাঁচে ফেলে আটকানো হয়েছে। এটা নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করা ঠিক হবে না।
গমের দায়িত্ব তাহলে কে নিবে?
ঘণ্টাখানিক আলাপ-আলোচনা কবেও কোনো সিদ্ধান্তে আসা গেল না। আফজাল সাহেব মন খারাপ করে ঘরে ফিরলেন। মবিনুর রহমানকে তিনি অত্যন্ত পছন্দ করেন। তিনি বুঝতে পারছেন মবিনুর রহমান কোনো-একটা চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর ক্ষীণ সন্দেহ হচ্ছে এই চক্রান্তে হেড মাস্টার সাহেবের একটা ভূমিকা আছে। কিন্তু কী ভূমিকা তা ধরতে পারছেন না। মবিনুব রহমানের সঙ্গে হেড মাস্টােব সাহেবেব কোনো শক্ৰতা থাকার কথা নয়। একদল মানুষ আছে যাদেব কখনো কোনো শত্রু তৈরি হয় না। মবিনুর রহমান সেই দলের মানুষ। কিন্তু এখানে তিনি কী করে ঝামেলায় জড়িয়ে গেলেন? এই ঝামেলা থেকে মুক্তিব উপাযই বা কী?