টিফিন পিরিয়ডে কালিপদ হেড স্যাবের ঘরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। একজন জ্ঞানী মানুষকে নিজ থেকে কিছু বলা মুশকিল। হেড স্যার বললেন, কী ব্যাপার কালিপদ?
কালিপদ মাথা চুলকাতে লাগল।
কিছু বলবো?
একটা কাজ ছিল স্যার।
তোমার আবার কী কাজ? তোমার কাজ তো একটাই। স্কুলের বাবান্দায় হাঁটাহাটি করা।
কালিপদের মন খারাপ হয়ে গেল। স্কুলের শতেক কাজ সে করে, তারপরেও কেউ যদি বলে তার কাজ শুধু হাঁটাহাঁটি কবা তাহলে মনে লাগারই কথা।
ছুটি চাও না-কি?
জি। টিফিন টাইমে চলে যাব।
টিফিন চাইমে চলে যাব? মামার বাড়ির আব্দার? স্কুলটা কী তোমার মামার বাংলা ঘর? যাও যাও বিরক্ত করবে না।
কালিপদ হতভম্ব হয়ে বের হয়ে এলো। আজ সকালেও সে হেড স্যারের একগাদা কাজ করেছে। হেড স্যারের গাইয়ের জন্যে ঘাস কেটে দিয়ে এসেছে। পুঁই গাছের জন্যে মাচা বেঁধেছে।
কালিপদ লক্ষ করল তার অসম্ভব রাগ হচ্ছে। রাগ হলেই তার হাত-পা কাঁপতে থাকে। এখনো তার হাত-পা কাঁপছে সে রাগ কমানোর জন্য বড় একটা বালতি নিয়ে পানি আনতে রওনা হলো। কাজকর্মে ব্যস্ত থাকলে রাগ কমে যায়। হেড স্যার হচ্ছেন জ্ঞানী মানুষ, স্কুলের প্রধান। তার উপর রাগ করা উচিত না।
স্কুলের টিউব ওয়েলটা নষ্ট। অনেক দূর থেকে পানি আনতে হয়। টিউবওয়েলটা ঠিক করা উচিত। কেউ ঠিক করছে না। সামান্য একটা ওয়াসারের জন্য টিউবওয়েল নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। কালিপদ ঠিক করে ফেলল। ময়মনসিংহ যাওয়া হলে সে নিজেই একটা ওয়াসার কিনে আনবে। এতে একটা ভালো কাজ করা হবে। সে তার জীবনে ভালো কাজ কিছুই করে নি। কখন ডাক এসে যাবে কে জানে। চিত্রগুপ্ত খাতা খুলে বসে আছেন। ডাক এলেই হাজিরা দিতে হবে। যমরাজ বলবেন, ওহে কালিপদ, তুমি মর্ত্যধামে ভালো কর্ম কী কী করিয়াছ? সে তখন বলতে পারবে, স্যার স্কুলের টিউবওয়েলের জন্য একটা ওয়াসার কিনেছি।
ইহা ছাড়া অন্য কোনো সৎকর্ম কি আছে?
জি-না।
খারাপ কর্ম কী কী করিয়াছ?
খারাপ কাজ কিছু করি নাই স্যার।
এইটাই কালিপদের একমাত্র ভরসা।
সে খারাপ কিছু করে নি। করবেও না।
কালিপদ পানির ভারি বালতি স্কুলের বারান্দায় রাখতে রাখতে লক্ষ করল যে, তার রাগ কমে গেছে। সে স্বস্তি বোধ করল। রাগ বেশিক্ষণ পুষে রাখা ঠিক না। তাছাড়া হেড স্যার অনায্য কিছু বলেন নি। সত্যি তো স্কুল কি আর তার মামার বাড়ির বাংলা ঘর?
কালিপদ পানির বালতি রেখে মুড়ি কিনতে গেল। স্যারদের জন্যে টিফিন তৈরি হবে। এক সের মুড়ি, তিন ছটাক বাদাম। মুড়ি বাদাম, পেঁয়াজ, কাচামরিচ দিয়ে মাখানো হবে। খুব ঝাল হতে হবে। শিক্ষকরা টিফিন টাইমে তা খাবেন। তেল মরিচ দিয়ে মুড়ি মাখানো কোনো জটিল কাজ না। বাদামের খোসা ছড়ানোর কাজটা জটিল। কালিপদের আঙুলে তেমন জোর নেই। ভারী কাজ করতে কষ্ট হয় না। কিন্তু বাদামেব খোসা ছাড়ানোর মতো ছোট কাজ করতে কষ্ট হয়।
কালিদেব মন এখন একটু বিষন্ন, কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে একগাদা কঠিন কথা শুনতে হবে। স্যাররা যখন ঝালমুড়ি খান তখন কালিপদকে অনেক কথা শুনতে হয়।
যেমন–
লবণ দিয়ে তো বিষ বানিয়ে ফেলেছ। এতদিনেও মুড়ি বানানো শিখলে না।
বালি কিচকিচ করছে, ব্যাপারটা কী? এর মধ্যে খুব কম হলেও এক পোয়া বালি আছে।
নাতাচ্যাত মুড়ি কোথেকে কিনলে? মুড়িও চেন না?
এইসব কথার কোনো জবাব কালিপদ দেয় না। মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে। শুধু দুজন লোক কখনো তাকে কিছু বলেন না। একজন মবিনুর রহমান, অন্যজন জালালুদ্দিন স্যার। মুড়ির বাটি জালাল স্যারের সামনে রাখা মাত্র তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ পাক তোমার ভালো করুন কালিপদ।
আজও তাই বললেন।
কালিপদ বলল, স্যারের শরীর ভালো?
হ্যাঁ, শরীর ভালো। মনটা ভালো না। শোন কালিপদ, তোমরা জন্য একটা চিঠি আছে।
কালিপদ বিস্মিত হয়ে বলল, চিঠি?
হুঁ। চিঠি। গতকাল মবিনের কাছে গিয়েছিলাম। সে তোমাকে চিঠি দিয়েছে। চিঠি পড়তে পোর?
জি স্যার, পারি। উনার শরীর কেমন?
বেশি ভালো না।
মুখ বন্ধ খাম নিয়ে কালিপদ আড়ালে সরে গেল। চিঠি পড়তে পারে কি-না এটা জিজ্ঞেস করায় সে মনে কষ্ট পেযেছে। স্কুলে চাকরি করে আর সে একটা চিঠি পড়তে পারবে না? ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে। বাবা মরে যাওয়ায় আর পড়াশোনা হলো না। জালাল স্যার পুরনো লোক। উনি কেমন কবে এই ভুল করেন?
কালিপদ টিউবওয়েলের পাশে বসে পরপর চারবার চিঠিটা পড়ল।
কালিপদ,
অমি খুব লজ্জিত যে যথাসময়ে তোমাকে বাড়ি ভাড়া বাবদ একশ টাকা দিতে পারি নি। আমার মনে ছিল তবু দেয়া হয় নি। শরীর বিশেষ ভালো না বলে স্কুলে যাচ্ছি না। তোমার সঙ্গে দেখাও হচ্ছে না। তোমার অসুবিধা সৃষ্টি করায় আমি ক্ষমাপ্রার্থী। এখন টাকাটা পাঠালাম।
ইতি
মবিনুর রহমান
কালিপদের চোখে পানি এসে গেল। মবিন স্যারের মতো একজন জ্ঞানী লোক বলছেন ক্ষমাপ্রার্থী। সে কে? সে কেউ না। সে একজন অধম দপ্তরি।
কালিপদ ঠিক কবে ফেলল। আজ সন্ধ্যায় স্যারকে দেখতে যাবে। খালি হাতে যাবে না। কিছু-একটা নিয়ে যাবে। পাকা পেঁপে, কলা। শরীব বেশি খারাপ দেখলে বাতে থেকে যাবে। যদিও ঐ মাডিতে থাকতে তার ভয় লাগে। সাপের ভয়। যত ভয়ই লাণ্ডক সে যাবে। হেড স্যারের গাইকে ঘাস এনে দিয়েই রওনা হবে।
সন্ধ্যাব পরপর কালিপদের যা য়া হলো না। কারণ হেড স্যার হঠাৎ সদরে যাবেন বলে ঠিক করেছেন। তাঁর সুটকেস স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসতে হবে। স্টেশন এখান থেকে পাঁচ মাইলের মতো দূরে।