রফিক ইতস্তত করে বলল, জেবার মধ্যে কিছু কিছু পাগলামি ভাব আছে। রূপা, তুই ওর কোনো কথায় বেশি গুরুত্ব দিবি না। যা বলে মেনে নিবি। ওকে নিয়ে আমরা একটু সমস্যায় আছি। ঢাকায় নিয়ে ডাক্তার দেখাব।
রূপা বলল, তোমরা শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছি। জেবা চমৎকার মেয়ে। দেখো অল্পদিনেই আমি ওকে ঠিকঠাক করে দেব।
জেবা এখনো ঘুমোয় নি।
একটা বালিশ কোলে নিয়ে পা তুলে বিছানায় বসে আছে। মানুষ না, যেন সুন্দর পাথরের একটা মূর্তি। রূপা বলল, কী-রে এখনো জেগে আছিস? শুয়ে পড়।
জেবা যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইল। শীতল গলায় বলল, ফুপু আমাকে তুমি করে বলবেন। কেউ আমাকে তুই করে বললে ভালো লাগে না।
কণা হাসতে হাসতে বলল, আদর করে তুই বলছিলাম। আর বলব না। জেবা, তুই ছাড়া আর কোন কোন জিনিস তোমার ভালো লাগে না বলে ফেল তো, জেনে রাখি!
কেউ মিথ্যা কথা বললে আমার ভালো লাগে না।
আচ্ছা। ভুলেও আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলব না। খুব সাবধানে থাকব।
কেউ গায়ে হাত দিয়ে আদর করলেও আমার ভালো লাগে না।
কখনো তোমার গায়ে হাত দিয়ে আদর করব না। তোমার কাছ থেকে সব সময় এক হাত দূরে থাকব। রাতে ঘুমোবার সময় যদি গায়ের সঙ্গে গা লেগে যায়। তাতে অসুবিধা নেই তো?
অসুবিধা আছে।
শোবার সময় রূপা একটা কোল বালিশ এনে দুজনের মাঝখানে রাখতে রাখতে বলল, এই কোল বালি, টা হচ্ছে আমাদের সীমানা। একপাশে থাকবে তুমি একপাশে আমি। এবাব ঠিক আছে। জেবা?
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
এখন আরাম করে ঘুমোও।
জেবা বলল, আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে ফুপু।
রূপা হাই তুলতে তুলতে বলল, তোমাকেও আমার পছন্দ হয়েছে। তুমি একটু অদ্ভুত! তাতে কী! অদ্ভুত মানুষই আমার ভালো লাগে। আমার একজন স্যার আছেন, তিনিও অদ্ভুত। আমি তাঁকেও খুব পছন্দ করি।
আমি জানি।
কীভাবে জানো?
জেবা অস্পষ্টভাবে হাসল, কিছু বলল না। রূপা বলল, তুমি তো আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না।
আমি সব প্রশ্নের জবাব দিই না।
প্রশ্নের জবাব না দেয়াটা তো অভদ্রতা।
প্রশ্ন করাও তো অভদ্রতা।
তা ঠিক। প্রশ্ন করার মধ্যেও এক ধরনের অভদ্রতা আছে।
জেবা বলল, ফুপু আপনি ইচ্ছা করলে আমার গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে পারেন। আমি রাগ করব না।
আচ্ছা, জানা রইল। এখন ঘুমাও।
আর আমি সব সময় আপনার দলে থাকব।
আমার দল মানে?
জেবা শান্ত গলায় বলল, এ বাড়িতে দুটো দল হবে। আপনার একাব একটা দল। আর বাকি সবাব একটা দল। অন্য দলটি চাইবে একটা ছেলের সঙ্গে আপনার বিয়ে দিতে। আপনি চাইবেন না…।
এই সব তুমি কী বলছ? এমন সব অদ্ভুত কথা তোমার মাথায় ঢুকল কীভাবে?
বলব না।
জেবা পাশ ফিরল এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল। রূপার ঘুম এলো না। এগারো বছরের এই বাচ্চা মেয়ে কী বলছে, কোথেকে বলছে? নিশ্চয়ই বড়দের কথা শুনে শুনে নিজের মনে একটা-কিছু দাঁড়া কবিয়েছে। শিশুদের মনেব জগৎ খুব সহজ নয়। নামান জটিল কর্মকাণ্ড সেই জগতে হয়। শিশুবা তার খবর কখনো বড়দেব বালে না।
প্রতি মাসের তিন তা বিখ নীলগঞ্জ হাইস্কুলের দপ্তরি কালিপদ বাড়ি ভাড়া বাবদ মবিনুর রহমানের কাছ থেকে একশটা টাকা পায়। টাকাটা নিতে কালিপদের খুবই লজ্জা লাগে। যি বাড়িতে তার মতো দরিদ্র ব্যক্তি নিজে থাকতে পারে না সেই বাড়ি ভাড়া বাবদ একশ টাকা নেয়া কি অন্যায় না? বাড়িটি মানুষ বাসের যোগ্য না। একটা মাত্র ঘর কোনো রকমে টিকে আছে। তারও কড়িবারগা ঝুলে আছে। যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পাবে। যদি ঘটে। সে কী জবাব দেবে? লোকে তো তাকেই ধরবে? হেড স্যার তাকে জিজ্ঞেস করবেন, কালিপদ তুমি জেনেশুনে এই বাড়ি কী করে ভাড়া দিলে? থানার বড় দারোগা সাহেবও তাকে থানায় ধরে নিয়ে যেতে পারেন।
ঘর যদি ভেঙে না-ও পড়ে, সাপেব কামড়েও তো মানুষটা, মরতে পারে। চারদিকে সাপ কিলবিল করছে। তার ছোট মেয়েটা মরুল সাপের কামড়ে।
কালিপদ অবশ্যি সাপের কথা মবিন স্যারকে বলেছে। তিনি উদাস গলায় বলেছেন, সাপ আছে থাক না। অসুবিধা কী? সাপদের ও তো বাঁচাব অধিকার আছে। ওরাও একটা প্রজাতি।
সারের কথাবার্তার ঠিক নেই। সাপ আর মানুষ এক হলো! সাপ কি স্কুলে পড়াশোনা করে? বিএ, এমএ পাস করে?
ত এই সব কথা স্যারকে কে বলবে? কালিপদের বলার ইচ্ছা করে। সাহসে কুলায় না। সার হচ্ছেন জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে সে মহামুর্থ দপ্তরি কী কথা বলবে? তবে একটা ভালো ব্যাপার হচ্ছে মবিন স্যারের সঙ্গে সব কথা বলা যায়। তিনি চুপ করে শোনেন। এমনভাবে শোনেন যেন খুব জ্ঞানী একজন মানুষের কথা শুনছেন। হেড স্যারের মতো কথার মাঝখানে ধমক দেন না। কথার মাঝখানে বলেন না–চুপ কর গাধা।
আজ মাসের সাত তারিখ। এ মাসের বাড়ি ভাড়া বাবদ একশ টাকা কালিপদ এখনো পায় নি। মবিন স্যার স্কুলে আসছেন না। অথচ টাকাটা তার বিশেষ প্রয়োজন। সে ঠিক করুল মবিন স্যারের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। টিফিন টাইমে হেড স্যারকে বলে ছুটি নেবে। তার ধারণা ছুটি চাইলে হেড স্যার না বলবেন না। কারণ তাঁর অনেক কাজ সে করে দেয়। গত মাসে হেড স্যার একটা দুধেল গাই কিনেছেন। সেই গাইয়ের জন্য ঘাস কেটে আনাব সব দায়িত্ব তার। এই দাযিত্ব সে নিঃশব্দে পালন করে। এমনভাবে করে যে তাকে দেখলে মনে হতে পারে এই দায়িত্ব পালন করতে পেরে সে বিমলানন্দ উপভোগ করছে। অবশ্যি কারো জন্যে কিছু করতে কালিপদের খারাপ লাগে না। ভালোই লাগে। মবিনুর রহমান স্যারের জন্যেও তার সব সময় কিছু করতে ইচ্ছা করে। এখন পর্যন্ত তেমন কিছু করার সুযোগ পায় নি।