শোন রূপা, এই পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির জন্ম হয়েছে। মানুষ যেমন একটি প্ৰজাতি, কীট-পতঙ্গও প্রজাতি। এদের সবার বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এদের সঙ্গে সহাবস্থানেব পদ্ধতি বের করা যেতে পারে, এদের হত্যা করা যাবে না। এদের হত্যা করার আমাদের কোনো অধিকার নেই। আমরা সীমা লঙ্ঘন করছি।
রূপার খুব ইচ্ছে করল বলে–ওদের হত্যা না করলে তো এরা ধান খেয়ে ফেলবে। তখন আমরা মারা পড়ব। কিন্তু সে কিছু বলল না। তাকিয়ে রইল। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। কথা শুনতে ইচ্ছা করছে। তার চেয়েও যা ভয়ংকিব তার ইচ্ছা করছে এই মানুষটাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে।
যাই রূপা।
স্যার একটু বসুন। একটু।
মবিন সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
আরেক কাপ চা খান, আমি বানিয়ে নিয়ে আসি।
চা তো একবার খেলাম!
ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমি ভালো করে এক কাপ বানিয়ে নিয়ে আসি।
না।
তিনি উঠে পড়লেন। রূপার খুব কষ্ট হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে। হাত ধরে জোর করে তাকে স্বসিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলে আপনাকে বসতেই হবে। আপনি যেতে পারবেন। না। আপনি সারারাত এই চেয়ারে বসে থাকবেন। সারারাত আমার সঙ্গে গল্প করবেন।
তা বলা হলো না। কল্পনা এক জিনিস। বাস্তব অন্য। বাস্তবে রূপা তার স্যারকে এগিয়ে দিল গোট পর্যন্ত। স্যার চলে যাবার পরেও গোট ধরে দাঁড়িয়ে রইল। আকাশ পরিষ্কার, চাঁদ উঠেছে। চাদের আলোয় চারদিক ঝলমল করছে। এত সুন্দর! পৃথিবী এত সুন্দর।
বাতের খাবাব শেষ হবার পর রফিক বলল, রূপা আয়, ছাদে বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব কবি। ছাদ পরিষ্কার?
হুঁ। পাটি দিতে বলব? না চেয়ার?
পাটি দিতে বল। আর কয়েকটা বালিশ। তোর ভাবিকেও আসতে বল। ছাদে বসে চা খেতে খেতে জোছনা দেখি। অসম্ভব সুন্দর জোছনা হয়েছে। অনেকদিন এমন জোছনা দেখি নি।
তোমাদের খুলনায় জ্যোৎস্না হয় না?
হয়। দেখা হয় না। পানের বাটা সঙ্গে নিয়ে আসিস, পান খাব। কাঁচা সুপারি দিয়ে পান।
ভাইয়া তাকে কী বলবে তা কাঁপা আঁচ করতে পাবছে। বিয়ের কথা বলবে। এটা বলাব জন্যে এত ভনিতা কেন কে জানে। বলে ফেললেই হয়। অনেকক্ষণ ধরেই তারা ছাদে বসে আছে। রফিক নানান কথা বলছে। মূল প্রসঙ্গে আসছে না। এক সময় রূপার ধারণা হলো হয়তো মূল প্রসঙ্গই নেই। হালকা গল্পগুজব কিবাবা জন্যেই তাকে ডাকা হয়েছে। মিনু বালিশে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছে কি-না বোঝা যাচ্ছে না।
রফিক বলল মিনু ঘুমিয়ে পড়েছ নকি?
মিনু সাড়া-শব্দ করল না। রফিক হালকা গলায় বলল, রূপা তোর ভাবির কাণ্ড দেখেছিস? ঘুম দিচ্ছে। এমন চমৎকার জোছনায় ঘুমিয়ে যাওয়া তো রীতিমতো ক্রাইম। শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
রূপা বলল, আমার নিজেরও ঘুম পাচ্ছে ভাইয়া। কয়েকবার হাই তুলেছি। রফিক বলল, সবাই যদি ঘুমে কাতর হয়ে থাকে তাহলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেই হয়। চল যাই, ফেয়ারওয়েল টু দা মুন।
তুমি কী যেন বলবে বলছিলে?
তেমন জরুরি কিছু না। ইট কেন ওয়েট। তোর বিয়ের ব্যাপাবে কথা বলব বলে ভাবছিলাম।
ও।
খুব ভালো ছেলে পাওয়া গেছে। সবদিক মিলিয়ে ছেলে জোগাড় করা তো এখন ভয়াবহ সমস্যা। ছেলে দেখতে সুন্দর হলে স্বভাব-চরিত্র হয় মন্দ। টাকা-পয়সা থাকলে বিদ্যা-বুদ্ধি থাকে না। ভালো ছেলে হলে দেখা যায় বোকা ছেলে, মন্দ হবার মতো বুদ্ধি নেই বলে ভালো ছেলে হয়ে দিন পার করছে। তাছাড়া ভালো ছেলের কনসেপ্টও পাল্টে গেছে।
যাকে পেয়েছ সে-কি সব দিকে পারফেক্ট?
এখন পর্যন্ত তো তাই মনে হচ্ছে। তুই নিজে দেখ।
আমি নিজে কীভাবে দেখব?
ছেলেটাকে এখানে আসতে বলেছি। জহির চিটাগাং থেকে আসার সময় তাকে নিয়ে আসবে।
ও!
মনে হচ্ছে খুব উৎসাহ বোধ করছিস না। রূপা কিছু বলল না। রফিক সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, ছেলেটাকে আমি দেখেছি। কথা বলেছি। আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। চমৎকার ছেলে।
চমৎকার একটা ছেলে আমার মতো একটা গ্রামের মেয়েকে বিয়ে করবে। কেন? বিয়ে করবে। কারণ তুইও চমৎকার একটা মেয়ে। ছেলেটা এখানে আসছে। তোর লজ্জায় লজ্জাবতী হয়ে থাকার কোনো কারণ নেই। তোরা কথাবার্তা বলবি। গল্প করবি। ছেলেটাকে গ্রাম দেখাবি এতে দোষের কিছু নেই। বুঝতে পারছিস আমার কথা?
পারছি।
কিছু বলবি?
ভাইয়া, ধর আমার ছেলেটাকে পছন্দ হলো। ছেলেটার আমাকে পছন্দ হলো না। তখন?
তখন বিয়ে হবে না।
তখন কি আমার খারাপ লাগবে না?
রফিক কিছু বলার আগেই মিনু বলল, মোটেই খারাপ লাগবে না। কারণ তোমাকে যেই দেখবে সেই পছন্দ করবে। তুমি যে কী সুন্দর হয়েছ তা তুমি নিজেও জানো না।
রূপা বলল, তুমি জেগে ছিলে?
হ্যাঁ, জেগে ছিলাম। ঘুমের ভান করে দেখতে চাচ্ছিলাম তোমরা ভাইবোনরা কীভাবে কথা বলো।
কীভাবে বলি?
স্মাটলি বলো। সহজ স্বাভাবিক। লজ্জা-টজার কোনো বালাই নেই। শুনতে ভালোই লাগল। কে বলবে তুমি জীবন কাটিয়েছ গ্রামে।
রফিক বলল, চল উঠা যাক। আমারো ঘুম পাচ্ছে।
মিনু বলল, না তুমি আরো খানিকক্ষণ বস। রূপা চলে যাক। আমরা দুজন খানিকক্ষণ গল্প করি। আর রূপা শোন, জেবা বলছিল সে আজ রাতে তোমার সঙ্গে ঘুমোবে। সে হয়তো তোমার বিছানায় গম্ভীর মুখে বসে আছে। ও তোমার সঙ্গে ঘুমোলে অসুবিধা হবে না তো?
অসুবিধা কী।
মিনু দুঃখিত গলায় বলল, মাঝে মাঝে জেবা দুঃস্বপ্ন দেখে বিকট চিৎকার করে। ওর এই ব্যাপারটার সঙ্গে তুমি পরিচিত না। ভয় পেতে পোর।
আমি এত সহজে ভয় পাই না ভাবি।