র্যান্ডম হাউস প্রকাশিত একখানি প্রবন্ধের সংকলন পড়িতে পড়িতে চার্লস ল্যাম-এর জীবনীর এক জায়গায় তাহার চোখ আটকাইয়া গেল। নিজের জীবনের সাদামাটা অকিঞ্চিৎকর সম্বন্ধে বলিতে গিয়া ল্যাম লিখিতেছেন যে, উল্লেখ করিবার মতো কিছুই তাঁহার জীবনে ঘটে নাই। কেবলমাত্র একবার এক পার্কে বসিয়া থাকিবার সময় খপ করিয়া হাত বাড়াইয়া একটি উড়ন্ত চড়াই পাখি ধরিয়া ফেলিয়াছিলেন। ইহাকে যদি ঘটনা বা সাফল্য বলা যায়, বলা যাইতে পারে।
সুন্দর কথা। মনের মতো কথা। ভূমাতে আনন্দ নাই, সারল্যেই আনন্দ।
খোকা বড়ো হইতেছে। এখন সে গুট গুট করিয়া সারাবাড়ি হাঁটিয়া বেড়ায়, ঠাকুমার কোলে হেলান দিয়ে রূপকথার গল্প শোনে। রাত্রিতে বিছানায় বসিয়া বই পড়িতে পড়িতে কাজল ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকাইয়া দেখে। ঠিক যেন তুলির মুখের আদল। ঠোঁটের চমৎকার ভঙ্গি, রেশমের মত চুল, বড়ো বড়ো চোখের নিষ্পাপ দৃষ্টি। শেক্সপীয়ারের সনেটগুলির কথা মনে পড়িল, সন্তানের ভিতর দিয়াই তো জীবনের প্রবাহ আর ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকে। আজ হইতে অর্ধশতাব্দী পরে সে থাকিবে না, খোকা থাকিবে।
প্রথম যৌবনের তারল্য কাটিয়া তাহার জীবনে একটা সুসংবদ্ধ স্থিতির ভাব আসিতেছে। এখন মনে হয় হৈ চৈ, আনন্দ, অর্থ, খ্যাতি কিংবা ক্ষমতাই সার্থকতার নামান্তর নয়। নাটক-নভেল আর পড়িতে ভালো লাগে না, ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, জ্যোতির্বিজ্ঞান বা মহাপুরুষদের স্মৃতিকথা পড়িতে ইচ্ছা করে। সে মধ্যবয়সে পৌঁছাইল নাকি?
একটা ভয়ের ব্যাপার হইয়াছে।
আগে সে নদীর ধারে গিয়া বসিলে জলের শব্দের মধ্যে অনন্তের বাঁশি শুনিতে পাইত, তারাভরা আকাশের দিকে তাকাইলে অসীম শূন্যের পথহীন গভীরতায় সে কবিতার পংক্তি খুঁজিয়া পাইত। এখন জল শুধুই জল, রাত্রির কালো আকাশ কেবলমাত্রই খানিকটা আলোকহীনতা। জীবনের দম ফুরাইয়া গেল নাকি?
কিছুই জানা হইল না। ইস্কুল জীবনের শেষের দিকে বা কলেজে পড়ার সময় যখন জীবন আর অস্তিত্ব সম্বন্ধে যাবতীয় প্রশ্ন ধীরে ধীরে জন্ম লইতেছিল, সে সময় মনে হইয়াছিল বিশ্বপ্রকৃতির সমস্ত রহস্য সে ভেদ করিয়া ফেলিবে। সামনে এত বড়ো জীবনটা পড়িয়া আছে, সে কত পড়িবে, জানিবে, হয়তো তাহারই জন্য সবকিছু অপেক্ষা করিয়া আছে। এখন সে বুঝিতে পারিয়াছে খুব জোরে দৌড়াইলেই দিগন্তকে স্পর্শ করা যায় না।
কাজল ভূতের গল্প পড়িতে ভালোবাসে। অ্যালজারনন ব্ল্যাকউডের লেখা তাহার খুব প্রিয়। ব্ল্যাকউডের একটি গল্প পড়িতে গিয়া একজায়গায় লেখকের বক্তব্য তাহার মনে হ এক শিক্ষকের মুখ দিয়া লেখক বলাইতেছেন—What was the use of al this? What in the world was the good of all the labour and drudgery one goes through? Wherein lay the value of so much uncertain toil when the ultimate secrets of life were hidden and no one knew the final goal? How foolish was effort, discipline, work! How vain was pleasure! How trivial the noblest life!
অদ্ভুত ব্যাপার। আজ কয়েকদিন ধরিয়া যে অনির্দেশ্যতা তাহাকে কষ্ট দিতেছে, তাহারই নির্যাস যেন ব্ল্যাকউড চোখের সামনে তুলিয়া ধরিলেন। সত্যই তো, কী লাভ পরিশ্রম করিয়া? কী লাভ খ্যাতিতে, প্রতিষ্ঠায়, অধ্যয়নে? সব তো অন্ধকারই থাকিয়া যাবে। মৃত্যু সমস্ত উদ্যোগের অবশ্যম্ভাবী সমাপ্তি।
নদীর স্রোতে আর কোনো গান নাই। দিগন্তের ওপারে কোনো দেশ নাই।
বছরখানেক আগে পুরানো বইয়ের দোকান হইতে নীটশের দাস স্পেক জরথুস্ট পাঁচসিকা দামে কিনিয়াছিল। ভালো লাগে নাই বলিয়া পড়া বেশিদূর অগ্রসর হয় নাই। একদিন রাত্রিবেলা বইখানা লইয়া বিছানায় শুইল। পাশে তুলি ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। ওপাশে থোকা। মধ্যরাত্রির জীবন্ত স্তব্ধতা থমথম করিতেছে। তাহারই ভিতরে নীটশে আসিয়া বিছানার পাশে বসিলেন। বলিলেন, সুপারম্যান থিয়োরির কথা, ঈশ্বরের অনস্তিত্বের কথা। কোনো উদ্যোগেরই কোনো মূল্য নাই, কারণ পৃথিবীতে কিছুই নতুন ঘটিতেছে না। ইতিহাস নিজের পুনরাবৃত্তি করিতেছে মাত্র। বিশ্বে মানুষের অস্তিত্ব, দেশ ও কালের মধ্যে বস্তুবিশ্বের অস্তিত্ব, সমস্ত অর্থহীন। তাৎপর্যহীন বিশ্বে সে একটা তাৎপর্যহীন, ক্লান্তিকর জীবন বহন করিয়া চলিতেছে।
নীটশে পড়িতে পড়িতে রাগ হয়, আজন্মলালিত বিশ্বাস এবং সংস্কার একেবারে ভাঙিয়া পড়িবার উপক্রম হইতেছে দেখিয়া মনে ত্রাসের সঞ্চার হয়, কিন্তু ন্যায়শাস্ত্রের নিরেট যুক্তির বিরুদ্ধে কিছুই করিবার থাকে না। পণ্ডিতের প্রলাপ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া যায় না বলিয়াই ভয়টা আরও চাপিয়া বসে।
অন্ধকারে ডুবিয়া যাইবার অসহায় মুহূর্তে একটি তুচ্ছ ঘটনা তাহাকে রক্ষা করিল।
একদিন বিকালে তুলির ঘরে ঢুকিয়া কাজল দেখিল কোলের কাছে একরাশ বকুল ফুল লইয়া তুলি মালা গাঁথিতেছে। কাজল বলিল–কী ব্যাপার, হঠাৎ মালা গাঁথছো যে?
তুলি হাসিয়া বলিল—উষার মা দিয়ে গিয়েছে। সকালে মেয়েকে দেখতে এসেছিল, বলল–বৌমা, এই নাও, আমাদের উঠোনের গাছের ফুল—তোমার জন্য এনেছি। বাবা বকুলফুল খুব ভালোবাসতেন, তাই না? মালা গেঁথে বাবার ছবিতে পরিয়ে দেব
তুলি একটি একটি করিয়া ফুল লইয়া ছুঁচের মাথায় গাথিয়া সূতায় পরাইতেছে। তাহার মুখে নিবিষ্ট মনোযোগ। কাজল কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া দেখিল।