সবটা না হইলেও সঞ্জয়ের কথা কিছুটা হয়তো ঠিক।
কী আসে যায়? অনেক লেখা প্রকাশিত হইতেই হইবে, খ্যাতি পাইতেই হইবে এমন কোনো মাথার দিব্য কেহ দেয় নাই। ভালো লাগে বলিয়া লিখিতেছে, না ভালো লাগিলে বা কেহ না ছাপিলে আর লিখিবে না। বিশ্বনিকষের প্রেক্ষাপটে তাহার চেতনার আলোকবিন্দু ফুটিয়া উঠিয়াছে, যতদিন তাহা স্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্যে জ্বলে, জ্বলুক না।
সে জানে এই জীবনদর্শন বিরূপ সমালোচনা আমন্ত্রণ করিয়া আনিবে, সঞ্জয় আবার হাসিয়া বলিবে—সফট, সফট লাইফ। তাহাতে দুঃখ নাই। এমন নিজের মতো করিয়া বাঁচিবার সুযোগই বা কজন পায়? বিশেষ করিয়া সে তো অন্য কাহারও ক্ষতি কবিতেছে না। অনন্তপ্রবাহে কেবলমাত্র ভাসিয়া চলিবারই যে কী আনন্দ!
বিকালে চা খাইবার সময় বাড়ি ফিরিয়া কাজল দেখিল রানুপিসিদের বসিবার ঘরে বেশ কয়েকজন লোক তাহার জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। ব্যাপার কী? তাহাদের মধ্যে একজন বলিল— আমরা আজই সকালে খবর পেয়েছি আপনি এসেছেন। আমাদের পল্লীমঙ্গল সমিতির ঘরে আজ সন্ধেবেলা অপূর্বাবুকে স্মরণ করার একটু ব্যবস্থা করেছি, মানে—আপনি এসেছেন শুনে সকাল থেকে লোকজনকে খবর দিয়ে সব আয়োজন করে ফেলুলম। আপনাকে কিন্তু আসতেই হবে। শুনলাম বউদিও এসেহেন, ওঁকেও আনবেন সঙ্গে দয়া করে।
দুদিনের জন্য নিজগ্রামে আসিয়া একটা সম্পূর্ণ সন্ধ্যা আটকাইয়া পড়িবারাই কাজলের ছিল, কিন্তু তাহার জীবনে বাবার নাম সঞ্জীবনী মন্ত্রের মতো কাজ করে। তাহার বাবার জন্য একদল লোক সভার আয়োজন করিয়াছে আর সে যাইবে না? নিশ্চয়ই যাইবে। সে বলিল—আপনারা রানুপিসিকেও যেতে বলুন, উনি বাবাকে খুব কান্থ থেকে দেখেছেন—
–-হ্যাঁ, হ্যা-নিশ্চয়। আমরা ওঁকে বলে যাচ্ছি–
সন্ধ্যাবেলা তুলি আর রানুকে সঙ্গে লইয়া কাজল পল্লীমঙ্গল সমিতিতে উপস্থিত হইল। ওপরে লাল টালির ছাদ দেওয়া লম্বামতো ঘর। মেঝেতে শতরঞ্চি পাতিয়া বসিবার জায়গা করা হইয়াছে, বেশ কিছু মানুষ ইতিমধ্যেই জমা হইয়াছে। উদ্যোক্তা ভদ্রলোক, সকালে যাঁহার সঙ্গে কথা হইয়াছিল, বলিলেন—আসুন অমিতাভবাবু, আসুন বউদি। পিসিমাও এসেছেন তো? বসুন, বসুন এইখানে–
বাহিরে হেমন্তের শিশিরা সন্ধ্যা নিবিড় হইয়া আসিতেছে। বক্তাদের কথা শুনিতে শুনিতে কাজল মাঝে মাঝে বাহিরে তাকাইয়া দেখিতেছিল। জীবনটা কী অদ্ভুত! এই গ্রামের পথে পথে শৈশবে খেলা করিয়া বেড়াইবার সময় তাহার বাবা কখনও কি ভাবিয়াছে যে, একদিন ভবিষ্যতের এক হেমন্ত সন্ধ্যায় এই গ্রামেই তাহার স্মরণে সভা হইবে? বাবার, ঠাকুরদার সাহিত্যচর্চা আজ সার্থক হইল।
মায়ের কাছে রাখিয়া আসা সন্তানের কথা মনে পড়িল। খোকাকে নিশ্চিন্দিপুরে আনিয়া কিছুদিন রাখিতে হইবে। এই গ্রাম তাহার সন্তানের ন্যায্য উত্তরাধিকার, ইহা হইতে সে ছেলেকে বঞ্চিত করিবে না। যদিও সে গ্রাম আর নাই, তবু–
বক্তারা বেশিরভাগই এলোমেলো কথা বলিতেছে, তাহাদের উচ্ছ্বাস যতটা, গুছাইয়া বলিবার ক্ষমতা ততটা নহে। তবু কাজলের খারাপ লাগিল না। যাহাই হউক, ইহারা তাহার বাবাকে ভালোবাসিয়াই তো সভার আয়োজন করিয়াছে।
সভা শেষ হইলে অন্ধকার গ্রাম্য পথ দিয়া তাহারা বাড়ি ফেরে। চালতা আর জামরুল গাছের ফাঁক দিয়া অসংখ্য নক্ষত্রখচিত আকাশ চোখে পড়ে। বর্ষাকাল চলিয়া গিয়াছে, ধূলিমুক্ত আকাশ বিপুল বিস্তারে প্রসারিত হইয়া আছে। দিগন্ত হইতে দিগন্ত পর্যন্ত আলোর নদীর মতো ছায়াপথ, যাহার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত অবধি আলোর গতিতে যাইতে সময় লাগে ত্রিশ হাজার বৎসর। এই দুর্বোধ্য বিশালত্বের মধ্যে সে, তাহার বাবা, তুলি, সাহিত্য-সংস্কৃতি-সভ্যতা-বিজ্ঞান এবং জীবনের আর যা যা কাম্য সার্থকতা। মানবসভ্যতা বাঁচিলেই বা কী, না বাঁচিলেই বা কী? এই অনাদ্যন্ত বিশ্বজগক্টা একইভাবে নৈর্ব্যক্তিক ঔদাসীন্যের সঙ্গে বর্তমান থাকিবে।
পরের দিন খুব ভোরে তুলিকে লইয়া সে নদীর ধারে গেল।
তখনও সূর্য ওঠে নাই। প্রভাতের দৈবী আলো পৃথিবীতে ছড়াইয়া আছে। নদীর জলে স্রোতের মৃদু টান। স্রোতাভিমুখী সরু সরু লম্বা জলজ শ্যাওলা জলের টানে সামান্য কাঁপিতেছে। যদি মানুষ লোভের বশে, হিংসা, ক্ষমতা বা হঠকারিতার বশে পৃথিবীটাকে বসবাসের অযোগ্য করিয়া না ফেলে, তাহা হইলে এই শান্ত, সুন্দর সকাল আরও অনেক আসিবে। সে যখন পাঁচশত বৎসর অতীত ইতিহাসের গর্ভে, তখনও আসিবে।
খেয়া পারাপার এখনও শুরু হয় নাই। পারের নৌকা জলের কিনারে নদীতে পোঁতা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে। জলের উপর দিয়া বহিয়া আসা বাতাস সমস্ত শরীর কেমন জুড়াইয়া দেয়। ওই যে ওখানে প্রায় জল ছুঁইয়া একটা পাখি ওপারের দিকে উড়িয়া গেল। কী পাখি ওটা?
আজ একটু পরেই স্ত্রীকে লইয়া তাহাকে শহরে ফিরিয়া যাইতে হইবে, কিন্তু তাহার সমস্ত চেতনা আর ভালোবাসা থাকিয়া যাইবে এই গ্রামের পথের বাঁকে। চিরদিন বসবাসের জন্য আর ফিরিয়া আসা হয়তো ঘটিবে না, কিন্তু মহীরুহ যত ঊর্বে মাথা তুলুক, তাহার শিকড় থাকিয়া যায় মৃত্তিকার গভীরে।
তুলি বলিল–কী সুন্দর, না?
—ভালো লাগছে তোমার?
–হুঁ।
-তাহলে এ সবই তোমাকে উপহার দিলাম।
২২. সময় কাটিতে থাকে
দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ
সময় কাটিতে থাকে। যে জীবনে নাটকীয়তা থাকে, দুর্যোগ, উত্থান-পতন কিংবা তীব্র গতি থাকে, তেমন জীবন কাজল বাছিয়া লয় নাই। এই বিশ্বকে সে ভালোবাসিয়াছে, দুর্বোধ্য রহস্যে ভরা এই বিশ্বজগৎটার দিকে বিস্ময়ের দৃষ্টি লইয়া তাকাইয়াছে, তাহাতেই সে তৃপ্ত। লোকে অবশ্য কবির ভাষায় তাহার সম্বন্ধে বলিতে পারে—অল্প একটু হেসে-খেলেই ভরে যায় এর মনের জঠর, বলুক—তাতে কিছু আসে যায় না। বিশুদ্ধ আনন্দলাভ জীবনের পরম উদ্দেশ্য, বিস্ময় মনের সবচেয়ে পুষ্টিকর খাদ্য।