কাজল বলিল–চল, একবার নিশ্চিন্দিপুর থেকে ঘুরে আসি। সেই বিয়ের পরপরই যা গিয়েছিলে, আর তো যাওয়া হয়নি। যাবে? বড় মন কেমন করছে দেশের জন্য তুলি বলিল–তুমি বল কবে যাবে। ভালোই তো, অনেকদিন কোথাও বেরুনো হয়নি। কিন্তু সেদিনই তো আর ফেরা যাবে না, খোকা কি মায়ের কাছে থাকতে পারবে?
-কেন পারবে না? ও আমাদের চাইতে ঠাকুমার কাছে থাকাই বেশি পছন্দ করে–
হৈমন্তীও মত দিল, বলিল—যা, ঘুরেই আয়। খোকন আমার কাছে বেশ থাকবে। তাছাড়া ঊষা রয়েছে, ওকে আমার ঘরে বিছানা পেতে শুতে বলব এখন। একদিনের তো ব্যাপার—
–হ্যাঁ মা, আমরা পরের দিন সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসব।
হৈমন্তীর শরীর ইদানীং আগের চাইতেও ভাঙিয়া পড়িয়াছে। তুলি তাহাকে সংসারের সব কাজে সহায়তা করে, কিন্তু কাজও তো বাড়িয়া গিয়াছে অনেক, বিশেষ করিয়া কাজলের সন্তান হইবার পর। পরিচিত এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে ঊষা নামে একটি মেয়েকে পাওয়া গিয়াছে, সে ঘরের কাজকর্ম দেখে, খোকাকে দেখাশুনা করে, প্রয়োজন হইলে কোলে লইয়া ঘুম পাড়ায়। হৈমন্তীকে একেবারে একা থাকিতে হইবে না।
পরের সোমবার কী একটা পর্ব উপলক্ষে ইস্কুল ছুটি ছিল। রবিবার সকালে কাজল তুলিকে লইয়া নিশ্চিন্দিপুর রওনা হইল। সঙ্গে রানুর জন্য একটা ভালো শাড়ি লইয়াছে। গতবার রানুর সহিত দেখা হয় নাই, সে কোন এক অসুস্থ আত্মীয়াকে দেখিতে কৃষ্ণনগর গিযাছিল। বৌ দেখিতে পায় নাই বলিয়া অনেক দুঃখ করিয়া তাহার পর তিন-চারখানা চিঠি দিয়াছে। রানুপিসির সঙ্গে দেখা করাও কাজলের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
নিশ্চিন্দিপুরের সহিত বহু, বহুদিনের সঞ্চিত নানা স্মৃতি জড়াইয়া আছে। বসন্তের প্রথমে নাগরম না-ঠাণ্ডা বাতাস বহিতে আরম্ভ করিলে, শুষ্কপত্রে গাছের তলা ভরিয়া থাকিলে মনের মধ্যে যে একটা কেমন করা ভাব জাগিয়া ওঠে, যাহার ঠিক কোনো ব্যাখ্যা হয় না, সেই রহস্যময় অনুভূতির সহিত প্রত্যেকবার নিশ্চিন্দিপুর যাইবার সময় তাহার যে মনোভাব হয় তার মিল আছে। ঠাকুরদা হরিহর, তাহার বাবা, পিসি দুর্গা, ঠাকুমা সর্বজয়া—সবার হাসিকান্না মাখানো জীবনযাত্রার ইতিহাস দিয়া গ্রামখানি যেন এক রূপকথার জালে জড়ানো। বাস্তব নিশ্চিন্দিপুরের চাইতে এই ভাবরাজ্যের গ্রামটিই তাহার বেশি পরিচিত। চারিদিকে জীবন দ্রুত বদলাইতেছে। কিছুই আর আগের মতো থাকিবে না। কিন্তু তাহাদের এই গ্রাম, যে গ্রামকে তাহার বাবা ভালোবাসিয়া বিশ্বসাহিত্যে অমর করিয়া গিয়াছে, তাহা থাকিবে। বাহিরে যতই পরিবর্তন ঘটুক না কেন, মনের ভিতরের একটি শান্তিপূর্ণ গহন, গভীর কেন্দ্রে নিশ্চিন্দিপুর এক অপরিবর্তনীয় আশ্রয়ের প্রতীক হিসাবে বিরাজমান। এ যুগে সেখানে আর পৌঁছানো যায় না, তবু জীবনের সকল পদযাত্রার শেষে নিশ্চিন্দিপুর অপেক্ষা করিয়া থাকে।
তুলিকে দেখিয়া রানু আনন্দে অস্থির হইল। এটা করে, সেটা করে, কীভাবে যত্ন করিবে ভাবিয়া পায় না। তাহার অবস্থা এখন একটু ভালো, সংসারের কর্তৃত্ব অনেকখানি তাহারই হাতে। ছেলে বড়ো হইয়া কী যেন ব্যবসায় ভালোই উপার্জন করিতেছে, কাজেই ভাইয়ের সংসারে আগের মতো জুজু হইয়া থাকিবার প্রয়োজন হয় না। ছেলের বিবাহ দিবার কথাও ভাবিতেছে। সতুরও আগের সে দাপট নাই, ব্যবসায় ক্রমাগত লোকসান দিয়া সে এখন দিদির মুখাপেক্ষী। ভাগ্যচক্র এইভাবেই আরর্তিত হয় বটে!
দুপুরবেলা রানু তুলিকে লইয়া প্রতিবেশীদের বাড়ি বেড়াইতে যায়। কাজল একা গ্রামের পথে ঘুরিতে বাহির হয়। নীল আকাশের পটভূমিতে থোকা থোকা সাদা সজিনার ফুল ফুটিয়া আছে, ছোটবেলায় মতোই বিন্দুবৎ চিল ওড়ে। পথের পাশের জঙ্গল হইতে বন্য সুঘ্রাণ বাহির হয়। পৃথিবীটা একইরকম থাকে, কেবল মানুষ চলিয়া যায় কোথায়।
এই গ্রামের মাটিতে একজন জন্মগ্রহণ করিয়াছিল, তাহার বাবা, যে নশ্বর দেহে না থাকিয়াও অনেকের অপেক্ষাই বেশি করিয়া বাছিয়া আছে। কাজল নিজে সাহিত্যের ছাত্র, সে নির্ভুলভাবে উপলব্ধি করিতে পারে একটু একটু করিয়া দেশের মানুষের হৃদয়ে তাহার বাবার আসন আরও পাকা হইয়া আসিতেছে। আজ হইতে অনেক বছর কাটিয়া যাইবে, শতাব্দী অতিক্রান্ত হইবে, তখনও তাহার বাবার লেখা লোকে পড়িবে।
কেন?
না, তা সে জানে না। শুধু এইটুকু জানে যে, বাবার লেখা পড়িলে গঙ্গাস্নানের পবিত্রতা এবং তৃপ্তিলাভ হয়। কীভাবে লেখক এই অমরত্বের জাদু সৃষ্টি করেন তাহা কেহ বলিতে পারে কি? লেখে তো অনেকেই, অমর হয় কয়জন? দক্ষতা ও প্রতিভার রহস্য চিরঅভেদ্য।
একটা জিনিস সে উপলব্ধি করিতে শুরু করিয়াছে।
তাহার খুব বড়ো রকমের কিছু হওয়া ঘটিয়া উঠিবে না। লেখকের সন্তানের পক্ষে লেখক হওয়া নিতান্ত কঠিন। এমন কোনো আইন যে কোথাও লিপিবদ্ধ আছে তাহা নহে, কিন্তু সাধারণত ইহাই ঘটিয়া থাকে। সে পাহাড়ে চড়িতে পারিত, ফিলম তুলিতে, গান গাহিতে বা অভিনয় করিতে পারিত। কিন্তু সাহিত্যরচনার চেষ্টা করিলে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া সে উদ্যোগ নিভিয়া যাইবে। কাহারও দোষ নাই, দোষ বিশ্বের নিয়মের।
অথবা তাহার দুমুখ বন্ধু সঞ্জয়ের কথাই কি ঠিক? সঞ্জয বলিয়াছিল—ওহে, লেখা ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু করো। তোমার মধ্যে চেষ্টা বা প্রতিভা নেই তা বলছিনে, কিন্তু ইউ জাস্ট ডোন্ট হ্যাভ দি ফায়ার উইদিন ইউ। তোমার জীবনটা সফ। বিশেষ সংগ্রাম নেই, ক্ষোভ নেই, সামনের বড়ো কোনো প্রতিবন্ধকতা জয় করার দায় নেইমোটামুটি খেয়ে পড়ে ভালোই আছ। ইউ হ্যাভ গন সফ্ট। তুমি বইয়ের জগতে, ভাবের জগতে বাস করো। কোনো সমস্যা থাকলেও তা ওই ভাবজগতেরই সমস্যা। আমি একথা বলছি বলে আমাকে শত্রু ভেবো না, নিজের মনের মতো কথা না বললেই মানুষ সচরাচর বক্তাকে শত্রু ভাবে। আমি এ কথা বলছি যাতে ভবিষ্যতে তোমার হতাশা না আসে।