পিতৃত্বের অনুভূতির জোয়ার নিজস্ব তীব্রতায় কাজলকে ভাসাইয়া লইয়া চলিল।
মায়ের কোলে না দিয়া ছেলেকে সে বুকের কাছে ধরিয়া বলিল—দেখেছ তোমার ছেলের কাণ্ড? কেবল দুষ্টুমি, ঠিক তোমার মতো—দুষ্টু মায়ের দুষ্টু ছা–
হৈমন্তী আনন্দে দিশাহারা হইয়া গেল। কাজলকে সে একেবারে শিশু অবস্থায় পায় নাই, একটি শিশুকে সম্পূর্ণ নিজের হাতে মানুষ করিয়া তুলিবার যে সুপ্ত কামনা নারীর মনে সেই পুতুলখেলার সময় হইতে লুকাইয়া থাকে, হৈমন্তীর সে কামনা পূর্ণ হয় নাই। পৌত্রে মধ্য দিয়া এইবার তাহা সার্থকতা লাভ করিল। দুইমাসের শিশুর ভিতর সে এমন সব গুণ আবিষ্কার করিতে লাগিল বাস্তবে যাহার মাথামুণ্ডু কিছুই নাই। পৃথিবীতে আর কোনো শিশু এমন করিয়া হাসে না, এমন করিয়া হাতপা নাড়ে না, এমন বুদ্ধিমানের মতো তাকায় না! তাহার নাতি ছাড়া দুনিয়ার আর সব শিশুকে মালক্ষ্মীর বাহনের মতো দেখিতে! যে এইসব মতের বিরোধিতা কবে, সে ঈর্ষায় জ্বলিতেছে বলিয়াই সেইরুপ করে! ব্যাপার দেখিয়া কাজলের হাসি পাইত। তাহার মা গল্প লেখে, বাবার একখানা বড়ো জীবনী লিখিতেছে, উপনিষদের শ্লোক আবৃত্তি করে, মা তো আর যে-সে লোক নয়—সেই মায়ের এমন কাণ্ড! নাঃ, স্নেহ সত্যই অতি বিষম বস্তু!
ছেলে একটু বড়ো হইবার সঙ্গে সঙ্গে কাজল তুলিকে আবার অনেকখানি ফিরিয়া পাইল, কারণ নাতির ভার প্রায় সবটাই হৈমন্তী নিজের হাতে তুলিয়া লইয়াছে। সকালবেলা ভালো করিয়া আলো ফুটিবার আগেই ছেলে জাগিয়া ভয়ানক চেঁচামেচি শুরু করে। পৃথিবী ভোরের আলোয় তখনও চোখ মেলে নাই, তুলিকে জাগাইতে কাজলের মায়া হয়, সে নিজেই ছেলেকে কোলে লইয়া বারান্দায় পায়চারি করে, বলে—ওই দেখ কেমন একটা পাখি, ওই নিমগাছের ডালে। কি পাখি জানিস? ওটা হল কাক–
ছেলে বড়ো বড়ো চোখ করিয়া অবাক বিস্ময়ে কাক দেখে। এই আলো-পাখি-গানের জগতে সে সদ্য আগত। সবই তাহার ভালো লাগে। পাঁচিলের ওপর দিয়া বিড়াল হাঁটিতেছে, উঠানের মাটিতে গাছের পাতার ফাঁক দিয়া আলোছায়ার খেলা, ছেঁড়া খবরের কাগজের একটা টুকরা বাতাসে উড়িয়া কোথায় ভাসিয়া গেল—সবই বেশ কেমন সুন্দর!
নাতির কোলাহলে হৈমন্তী বারান্দায় আসিয়া বলে-দে, আমার কোলে দে। তুই ঘুমুবি আর একটু?
–না মা, উঠেই যখন পড়েছি, বরং লেখাটা একটু এগিয়ে রাখি।
হৈমন্তী নাতিকে কোলে লইয়া উঠানের ছোটো বাগানে নামিয়া পড়ে। একধারে একটা আমগাছ আছে। অল্পবয়েসে কাজল আম খাইয়া আঁটি পুঁতিয়া দিয়াছিল। তাহা হইতে বেশ বড়ো গাছ হইয়াছে, গত বৎসর হইতে ফলও ধরিতেছে। পৌষের শেষ হইতে মঞ্জরী আসে, ফার্মুনের প্রথমে বউলের মাতাল করা গন্ধ পরিবেশকে আকুল করিয়া তোলে। একটা মাঝারি ধরনের কৃষ্ণচূড়া আছে। আর আছে রঙ্গন, টগর, কলাবতী, হৈমন্তীর শখ করিয়া পোঁতা বড়ো এলাচের ঝাড়। মাধবীলতা বারান্দার থামকে আশ্রয় করিয়া প্রায় কুঞ্জবন সৃষ্টি করিয়াছে। নাতিকে কোলে লইয়া হৈমন্তী শিশিরে ভেজা ঘাসের ওপর দিয়া বেড়ায়, কতরকমের ছড়া বলে।
ঘরে ঢুকিয়া কাজল দেখে ইতিমধ্যে তুলির ঘুম ভাঙিয়াছে, চায়ের জল চড়ানো হইয়াছে। কাজল মুগ্ধ দৃষ্টিতে কর্মরতা স্ত্রীর দিকে তাকাইয়া থাকে। কিছু কিছু মেয়েকে ঘুম হইতে উঠিলে দেখিতে ভালো লাগে না, কেমন যেন বিশ্বস্ত আলুথালু চেহারা হইয়া থাকে, কিন্ত তুলি সবসময়েই অপরূপা। বরং ঘুম ভাঙবার পর ঈষৎ নিদ্রা জড়াইয়া থাকা তাহার মুখের দিকে তাকাইলে অকস্মাৎ তাক লাগিয়া যায়। সদ্যনিদ্রোথিতা তুলিকে দেবীর মতো মনে হয়।
তুলি ঠোঁট টিপিয়া হাসিয়া বলিল কী দেখছ অমন করে শুনি?
–রাজকন্যা দেখছি। গরিব মানুষ, রাজকন্যে তো আগে কখনও দেখিনি–
–সাহস তো কম নয়। কোথাকার কে ঠিক নেই, লুকিয়ে রাজার মেয়ে দেখা হচ্ছে!
কাজল কাছে সরিয়া আসিয়া বলিল—শুধু কি দেখা? একেবারে হরণ করে এনেছি।
—যাও, কী হচ্ছে! মা এক্ষুনি আসবে ঘরে।
জীবন বেশ সুন্দর। রোজ পোলাওকালিয়া-মাংস খাইতে হয় না, ভালো ভালো জামাকাপড় পরিয়া গাড়িতে চড়িয়া বেড়াইতেও হয় না, ডাল-ভাত খাইয়া সাধারণভাবে জীবনযাপন করাটাই বড়ো আনন্দের। রোজ সকালে যে সূর্য উঠিতেছে, পাখি ডাকিতেছে, কষ্ট দুঃখ উল্লাস মিলাইয়া জীবনের স্রোত বহিয়া চলিয়াছে, তাহা আশ্চর্যের নয়? শোক দুঃখ বঞ্চনা আছেই, বাঁচিতে গেলে তাহার বিরুদ্ধে লড়াইও করিতে হইবে, কিন্তু সমস্ত আঘাত আর বিরুদ্ধতার মধ্যেও জীবন আনন্দের। জীবনের জন্য লড়াই, যেন লড়াইটাই প্রধান হইয়া না দাঁড়ায়—তাহা হইলে গৃহকোণের এই সরল সুখ, শিশুর গায়ের ঘ্রাণ, প্রিয়ার উষ্ণ সান্নিধ্য সব মিথ্যা হইয়া যাইবে।
তুলি তাহাকে সেই সরল সুখের সন্ধান দিয়াছে।
চা আসিল। সকালের প্রথম চায়ের কাপটির গভীর প্রারম্ভিক মূল্য আছে। ধূমায়িত কাপ হাতে লইয়া কাজল বলিল–বোসো তুলি, চা খেতে খেতে গল্প করা যাক—
কাজের পৃথিবীটা তাহার বাস্তব চেহারা সইয়া পুরোপুরি জাগিয়া উঠিবার আগে যে একটা মিন্ধ অবকাশ থাকে, এখন সেই দৈবী সময়। কত কী মনে পড়ে, সারাদিন ধরিয়া অয়নপথে সূর্যের পরিক্রমার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন দিক হইতে রৌদ্র আসিয়া পৃথিবীর গায়ে এলাইয়া থাকে, বুকের মধ্যে অদ্ভুত এক আনন্দের জন্ম দেয়—সে কথা কাহাকেও ঠিকমত বুঝাইয়া বলা যায় না।
কোথায় যেন যাইবার কথা ছিল। সেখানে গেলে মনে শান্তি আসিয়ে, পরিপূর্ণতা ফিরিবে।