যাহার জন্য ছবি সে কিন্তু খুব খুশি হইল।
কবিতা পড়া হইলে ছবিগুলি ভালো করিয়া আবার দেখিতে দেখিতে উজ্জ্বলমুখে তুলি বলিল—তুমি ছবিও আঁকতে পারা কখনও বলল নি তো! চমৎকার বেড়াল, বেশ বেড়াল।
কাজল বলিল–বেড়ালছানাগুলো কিন্তু তোমাকে ভেবে আঁকা–
—আমাকে? কেন?
—তুমিও ওইরকম নরম নবম, তুলতুলে—
তুলি লজ্জা পাইল, বলিল—যাঃ, যতসব বাজে কথা—
তাহার পর কী ভাবিয়া বলিল—তা হোক, তুমি কবিতার সঙ্গে বেড়াল এঁকো।
অতঃপর কাব্য ও শিল্পচর্চা সমান্তরালভাবে সমানবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল।
কাজল চিরকালের অভ্যাসমত অনেকরাত অবধি পড়াশুনা করে। এক-একদিন বই হইতে চোখ সরাইয়া দেখিত তুলি তাহার পাশে পরম নির্ভরতায় ঘুমাইয়া আছে। রবীন্দ্রনাথ নৌকাডুবিতে যেমন লিখিয়াছেন, তাহার মুখখানি যেন তেমনই সমস্ত বিশ্বচবাচরে একটিমাত্র দেখিবার জিনিসের মতো ফুটিযা আছে। তুলিব ঘুমন্ত মুখে গার্হস্থ্য শান্তি আলো।
মনে কেমন একটা আনন্দ। দুর্লভ বস্তু একান্তভাবে লাভ করিবার আনন্দ।
সরল পৃথিবীর যে স্বপ্নের মধ্যে কাজলের বড়ো হইয়া ওঠা, তাহা একটু একটু করিয়া ভাঙিয়া যাইতেছিল। এবার একটি ঘটনায় সে বুঝিল মানুষের মুখ মোটেই তাহার মনের দর্পণ নয়। তিক্ততার মূল্যে সে কিছু বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিল।
একদিন সকালে নিশ্চিন্দিপুর হইতে একজন লোক আসিয়া উপস্থিত হইল। কাজলকে দেখিয়া সে বলিল—দাদাবাবু না? নমস্কার দাদাবাবু, ভালো আছেন? কাকীমা কই?
কাজল বলিল—তোমাকে তো ভাই চিনলাম না! কে তুমি?
–চিনবেন আর কী করে? দেশে যাতায়াত বড্ডই কমিয়ে দিয়েছেন কর্তামশাই থাকলে চিনতে পারতেন। আমার নাম শিবু রায়, আপনাদের গাঁয়েরই চড়কতলার মাঠের ধারে আমার বাড়ি। তা পরিচয় দেবার মতো কিছু নেইও, ব্রাহ্মণবংশে জন্ম—এইমাত্র। গরিব ঘরে জন্মেচি দাদাবাবু, পয়সার অভাবে লেখাপড়া শিখতে পারিনি, জন খেটে পেট চালাই। কাকীমাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হল, তাই চলে এলাম। ভোর রাত্তিরের ট্রেন ধরিচি–
হৈমন্তীকে প্রণাম করিয়া এবং স্বৰ্গত কর্তামশাইকে স্মরণ করিয়া শিবু কাঁদিয়া আকুল হইল, তুলিকে দেখিয়া বার বার মা যেন আমার সাক্ষাৎ জগদ্ধাত্রী বলিল, এবং বাহিরের বারান্দায় বসিয়া পরোটা, আলুচচ্চড়ি ও আখের গুড় সহযোগে অবিশ্বাস্য-পরিমাণ জলখাবার খাইল। তাহার হাঁটু পর্যন্ত খাটো কাপড়, ছেঁড়া নীলরঙের হাতকাটা ময়লা হাফশার্ট ও বুভুক্ষু চেহারা দেখিয়া কাজলের মায়া হইল! আহা, বেচারা ভালো করিয়া খাইতে পায় না। তাহারই গ্রামের লোক, উহাকে আজ দুপুরে ভালো করিয়া খাওয়াইতে হইবে।
কাজল বলিল—তুমি খেয়েদেয়ে একেবারে ওবেলা যাবে কিন্তু। মাংস খাও তো?
শিবু রায় আকর্শ হাসিল।—আজ্ঞে, খাই বইকি। খুব ভালোবাসি। তবে পাচ্ছি কোথায়? আমরা গরিব-গুরবো লোক, মাংস কি কিনে খেতে পারি? আজ আপনার দয়ায়–
শিবুর উচ্ছাসকে বাড়িতে না দিয়া কাজল ব্যাগ হাতে বাজারে বাহিরে হইল।
দুপুরে খাইবার সময় বোঝা গেল সকালে শিবুর জলখাবার খাইবার যে বহর দেখিয়া কাজল বিস্মিত হইয়াছিল, সেটা শিবুর প্রকৃত আহারগ্রহণ ক্ষমতার সামান্য ভূমিকামাত্র। আর একটু হইলেই কাজলকে সে-বেলা সপরিবারে উপবাসে থাকিতে হইত।
বেলা তিনটা নাগাদ শিবু ফিরিবার ট্রেন ধরিবার জন্য তৈরি হইয়া হৈমন্তীকে বলিল—ভালো কথা কাকীমা, আপনাদের অনেক জমি তো গ্রামে এমনি পড়ে রয়েছে, কাউকে দিয়ে চাষ করান না কেন? গ্রামের ভেতরের জমিতে তৈরি তবি-তরকারি লাগালে ভালো ফসল পেতেন। ফেলে রেখে লাভ কী? কখন বেদখল হয়ে যায়—বুঝলেন না?
হৈমন্তী বলিল—ওসব ঝামেলা কে করে বাবা? আমার তেমন লোক কই?
শিবু হাতজোড় করিয়া বলল—কেন, আমিই তো আছি কাকীমা। আপনাদের পুরোনো ভিটের পাশ দিয়ে যদি এখন বেগুনের চারা বসানো যায় তাহলে এবাব শীতে বেগুন খেয়ে শেষ করতে পারবেন না। দিন দেখি আমায় পঞ্চাশটা টাকা, আমি ভুই তৈরি করে চারা বসিয়ে দেব। তদারকও আমিই করব। ফসল অর্ধেক আমার, অর্ধেক আপনার।
কথাটা হৈমন্তীর ভালো লাগিল। বেগুন এমন কিছু জিনিস নয়, কিন্তু নিজেদের জমিতে তাহা উৎপন্ন হইবে ভাবিলে আনন্দ হয়। টাকা দিলে গরিব লোকটারও কিছু উপকার করা হইবে। নিজ শ্রমের বিনিময়ে শিবু শীতকালে কিছু উপার্জন করিয়া লইতে পারিবে।
হৈমন্তী তাহার হাতে পঞ্চাশটা টাকা দিল।
পনেরো-কুড়িদিন বাদে বাদে শিবু আসিতে লাগিল। প্রথমবার আসিয়া সে বলিল–চারা লাগানো হয়ে গিয়েছে কাকীমা। অনেকদিন পড়ে থাকা ভুই, চারা লাগানোমাত্র চট করে ধরে নিয়েছে, একেবারে নতুন করে বাড়ছে। তা গোটাকুড়ি টাকা যদি দেন তো বড়ো ভালো হয়, পাহারা দেবার জন্য একটা ছোঁড়াকে লাগাবো। এই বয়েসে রাত জাগতে পাবিনে আর–
টাকা পাইয়া সে চলিয়া গেল।
দিনকুড়ি বাদে আবার আসিয়া হাজির। হৈমন্তী বলিল—কী বাবা, জমির খবর কী?
-ওঃ, খুব ভালো কাকীমা। গাছে বেগুন ধরেছে। দেখবেন এখন এক-একখানা কেমন নিকাটা মুক্তকেশী বেগুন হবে। ইয়ে হয়েছে, গোটা পঁচিশ টাকা যে দরকার—
–আবার টাকা কী হবে?
—নিড়েন দিতে হবে জমিতে। আগাছায় ভরে যাচ্ছে। একা কি আর পারি?
মোট টাকা যা গেল প্রাপ্ত ফসলের দামের সহিত তাহার সঙ্গতি থাকিবে না বলিয়াই মনে হইল। কিন্তু এখন আর থামা যায় না।
শীতের প্রায় মাঝামাঝি শিবু সের দুই মাঝারি আকারের বেগুন গামছায় বাঁধিয়া আনিল।