কোন-কোনদিন খুব ভোরে উঠিয়া কাজল মা আর স্ত্রীকে লইয়া বেড়াইতে বাহির হয়। ঘাসের ওপর তখনও শিশির শুকায় নাই, সূর্য উঠি উঠি করিতেছে। বাতাসে সকালের পবিত্রতা, কতরকম পাখি ডাকিতেছে গাছে গাছে। শহর হইতে বাহির হইয়া যে রাস্তাটা নদীর ধারে গিয়াছে তাহার দুধারে তেঁতুল, মেহগনি, শিরীষ, বকাইন আর কাঠবাদাম গাছ। মাঝে মাঝে দুয়েকটা জারুল বা ছাতিম। পথের ধারেই ঘন ঝোপঝাড়। এধারে বিশেষ বসতি গড়িয়া ওঠে নাই-শান্ত, স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মাখিয়া গল্প করিতে করিতে বেড়াইবার কী আনন্দ।
কঠ-র-র-র শব্দে কী একটা পাখি ডাকিয়া উঠিল। হৈমন্তী তুলির দিকে তাকাইয়া বলিল— শুনলে বৌমা?
–হ্যাঁ মা, কী পাখি ওটা?
–বলল তো কী?
তুলি চুপ করিয়া একটু ভাবিয়া বলিল–জানি না। তুমি বলে দাও—
হৈমন্তী হাসিয়া বলিল–ও হচ্ছে কাঠঠোকরা। ওটা ঠিক ডাক নয়, গাছের ডালে ঠোঁট ঠুকে ওইরকম আওয়াজ করে। ডাক অন্যরকম, শুনিয়ে দেবখন যদি ডাকে—
একটু একটু করিয়া তুলির জীবন সম্পূর্ণ বদলাইয়া গেল। ইহার পূর্বে সে বিশেষ বাড়ির বাহিরে পা দেয় নাই, প্রকৃতির সহজ মজাগুলির সঙ্গে পরিচিত করাইয়া দিবার কেহ ছিল না। এখন শাশুড়ি ও স্বামীর মধ্যে দুইজন পরম সহানুভূতিশীল শিক্ষক পাইয়া তাহার জীবনের প্রকৃত শিক্ষা সবেগে অগ্রসর হইল। হৈমন্তী ঠিক সাধারণ মাপের নারী নহে, অপুর সঙ্গে অতিবাহিত জীবন তাহার অন্তরের সুর অনেক চড়া পর্দায় উঠাইয়া দিয়াছিল। পুত্রবধূকে হৈমন্তী সেই শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে লাগিল।
কাজল বাবার ডায়েরিতে তাহার শাশুড়ি লীলার কথা পড়িয়াছে, কিন্তু কখনও তাহার ছবি দেখে নাই। বিবাহের পর সে বিমলেন্দুর কাছ হইতে চাহিয়া লীলার একখানা ছবি জোগাড় করিয়াছে এবং ছবিখানা অ্যালবামে অপর্ণার ফোটোগ্রাফের পাশে লাগাইয়াছে। মাঝে মাঝে সে একান্ত মুহূর্তে ছবি দুটি দেখে।
হ্যাঁ, বাবা অথবা অন্যেরা মিথ্যা বলে নাই, তাহার শাশুড়ি দেখিতে সুন্দরী ছিলেন। দক্ষ শিল্পীর হাতে গড়া মূর্তির মতো অপার্থিব, অলৌকিক সৌন্দর্য পৃথিবীর পথেঘাটে এমন দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু–
কিন্তু তাহার মা যেন আরও সুন্দর।
পাতাকাটা চুল, পানের পাতার মতো মুখের গড়ন। ঠোঁটের সুকুমার ভঙ্গি তাহার মায়ের চেহারায় এক আশ্চর্য দেবীত্ব দান করিযাছে। কাহারও সঙ্গে তুলনা হয় না।
নাঃ, এসব ছেলেমানুষি দুজনেই মা, মায়েব রূপের তুলনা চলে না।
এইসময় হঠাৎ কাজলের কবিতা লিখিবাব ঝোঁক বাড়িয়া উঠিল। তুলির উদ্দেশে কবিতা লিখিয়া স্লিপগুলি ভাঁজ করিয়া বালিশের নিচে, টেবিলক্লথেব তলায় কিংবা তুলি যে বইখানা পড়িতেছে তাহার ফাঁকে রাখিয়া দিত। কবিতাগুলিকে বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য রতন হিসাবে উল্লেখ করা হয়তো একান্তই বাড়াবাড়ি হইবে, কিন্তু তুলি সেগুলি পাইযা ভারি খুশি হইত। ক্রমে ঘবের সমস্ত সম্ভাব্য-অসম্ভাব্য স্থান কিছুক্ষণ বাদে খুঁজিযা দেখা তুলির অভ্যাসে দাঁড়াইয়া গেল। কবিতা না পাইলে তাহার অভিমান হইত, মুখ গম্ভীর হইত। নিজের সৃষ্ট বিপদে কাজল আরক্ষ ডুবিয়া গেল। তুলির মুখ ম্লান হইলে তাহার জগৎ অন্ধকার হইয়া যায়, কিন্তু পত্নীকে প্রফুল্ল রাখিবার জন্য প্রতিদিন ডজনখানেক কবিতা স্বয়ং মহাকবি কালিদাসও লিখিতে পারিতেন কি? প্রাণের দায়ে কাজল এই অসম্ভব কাজেও প্রায় অভ্যস্ত হইয়া আসিল।
এক ছুটির দুপুরে সদ্য আবিষ্কৃত গোটাদুই কবিতা পাঠান্তে তুলি বলিল—বেশ হয়েছে, তোমার কবিতার হাত বেশ ভালো। আমি একটাও হারাই নি, জানো তো? সবগুলো একজায়গায় করে বাক্সে রেখে দিয়েছি। এই এত মোটা হয়েছে। আচ্ছা, তুমি ছবি আঁকতে পারো না? কবিতার সঙ্গে ছবি থাকলে দেখতে কত ভালো লাগে–
প্রিয়ার অনুরোধ রক্ষার জন্য যুগে যুগে মানুষ রাক্ষস-রক্ষিত সরোবর হইতে সোনার পদ্ম তুলিতে গিয়াছে, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে দ্বৈরথ যুদ্ধ করিয়াছে, স্বর্ণমৃগের সন্ধানে গহন বনে ফিরিয়াছে, ছবি আঁকা আর এমন কী কাজ?
কাজল চিত্রশিল্পীতে পরিণত হইল।
সাধনার পথে কিছুদূর অগ্রসর হইয়া কাজল বুঝিল বিপদ এইবার গভীরতর। কিছুটা সাহিত্যপ্রতিভা থাকিলে যা হোক করিয়া একটা কবিতা দাঁড় করাইয়া দেওয়া যায়, বিশেষ করিয়া যে কবিতা মধুসূদন বা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করিয়া পড়া হইবে না, বস্তুত মাত্র একজন ব্যতীত সমস্ত পৃথিবীতে যে কবিতার আর পাঠকই নাই। কিন্তু ছবি আঁকিতে গেলে কিঞ্চিৎ বেশি দক্ষতা ও স্বভাবনৈপুণ্যের প্রয়োজন হয়। কাজে নামিয়া কাজল বুঝিল এ কাজ তাহার নয়। পাখি আঁকিলে বিকলাঙ্গ জিরাফের ছানার মতো দেখায়, মেঘের আড়াল হইতে সূর্যরশ্মি বাহির হইতেছে আঁকিলে মনে হয় বড়ো একতাল ময়দার মধ্যে কয়েকটা সরু কাঠি গোঁজা আছে। একবার তুলির মুখখানিকে পদ্মের সঙ্গে তুলনা করিয়া পুকুরে অনেক পদ্মপাতার মধ্যে একখানি ফুল ফুটিয়া আছে এমন একটি ছবি আঁকিতে চেষ্টা করিল। আঁকা শেষ হইলে মনে হইল জলে অনেকগুলি তেলেভাজা মশলাপাপড় ভাসিয়া আছে, তাহার মাঝখানে একটা জটিল কী যেন—আর যা হউক, সেটি পদ্ম নয়।
প্রায় হতাশ হইয়া পড়িবার মুখে আশার আলো দেখা দিল।
কাজল আবিষ্কার করিল সে খুব সহজেই বেড়াল আঁকিতে পারে। সেগুলি যে অবিকল বেড়াল হয় এমন নয়, কিন্তু সাদৃশ্যের যাবতীয় গুরুতর অসঙ্গতি সত্ত্বেও তাহাদের চিনিতে ভুল হয় না। তুলির স্বভাব, চেহারা ইত্যাদির সঙ্গে বেড়ালছানার তুলনা করিয়া কাজল একখানি দুইপাতাব্যাপী কবিতা লিখিল এবং স্থানে স্থানে গোটাকতক মার্জারশাবকের বিভিন্ন ভঙ্গিমার ছবি আঁকিয়া বসাইয়া দিল। একরঙা ছবিতে মজা নাই, তাই রঙপেন্সিল দিয়া ছবিগুলিকে মনোহারী রঙে রঞ্জিত করিল। নেহাত প্রেম যৌক্তিকতার ধার ধারে না তাই রক্ষা, নহিলে নীল, সবুজ আর ম্যাজেন্টা রঙের চৌখুপিওয়ালা শতরঞ্চির ডিজাইনের বেড়াল দেখিলে স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টাও চমকাইয়া উঠিতেন।