স্বামীর মতো ছেলেও। শৈশব হইতে যাহাকে নিজের অপূর্ণ মাতৃত্বের বঞ্চনা ভুলিয়া মানুষ করিয়াছে, সেও সম্পূর্ণ নিজের হইল না, অর্ধেক আরেকজনের রহিল।
কাল তুলির আশীর্বাদ। কিছুদিন পরেই এ সংসারে একজন বহিরাগত আসিবে। অন্য কিছু না, নিজের ওপর তাহার বিশ্বাস আছে, সে নিশ্চয় যে কোনো অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াইয়া লইতে পারিবে, কিন্তু ছেলের ওপর যে অর্ধেক অধিকার তাহার ছিল, আবার তাহার অর্ধেক আর একজনকে ছাড়িয়া দিতে হইবে।
ছাড়িয়া দেওয়াই নিয়ম। ছাড়িয়া দেওয়াই তো উচিত।
সব ঠিক ঠিক, সব যুক্তিসঙ্গত, কিন্তু তাহার শেষ সম্বলটুকুরও অর্ধেক ছাড়িয়া দিতে হবে। কাজল একাধারে তাহার ছেলে ও স্বামীর প্রতিনিধি। যদি সবটাই ছাড়িতে হয়?
এমন তো হয় সে শুনিয়াছে। তাহারও হইবে না তো?
আশঙ্কায় তাহার বুকের ভিতরটা কেমন হিম হইয়া গেল!
পরক্ষণেই ছেলের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাইয়া তাহার সুপ্ত মাতৃত্ব স্নেহের স্তন্যধারায় উৎসারিত হইয়া উঠিল। না, তাহার ছেলে তাহাকে ভুলিবে না। তেমন হইতেই পারে না।
জীবনে কিছু বিপ্লব আসে সরবে, ঢাকডোল পিটাইয়া। কিছু আসে নিঃশব্দে, মসৃণ সঞ্চারে, কিন্তু সমস্ত জীবনে এক ব্যাপক, সার্বিক পটপরিবর্তন ঘটাইয়া দেয়। তুলির সহিত বিবাহ কাজলের জীবনে সেই আশ্চর্য রূপান্তর লইয়া আসিল। প্রেম মানে যে কেবল শরীর নয়, বিবাহ মানেই কেবল শয্যা নয়, সেকথা কাজল জানিত। কিন্তু একটি তরুণী, সুন্দরী, মৃদু নারীর সান্নিধ্য মানুষকে যে কী স্বর্গের সন্ধান দিতে পারে তাহা সে এবার বুঝিল।
হৈমন্তীকে কিন্তু সত্যিই অনেকটা ছাড়িতে হইল। আগে নিজের লেখা ও পড়ার সময় বাদ দিয়া বাকি অবসরের সবটুকুই কাজল মাকে দিত। এখন হৈমন্তীর নিঃসঙ্গতা বাড়িয়া উঠিল। এক-একদিন ভুলিয়া ছেলের সঙ্গে কথা বলিবার জন্য দরজা পর্যন্ত গিয়া হৈমন্তী ফিরিয়া আসিয়াছে। ভিতরে পুত্রবধূর সঙ্গে ছেলে গল্প করিতেছে। কিছুই না, ব্যবধান কেবল একটি ভেজানো দরজা অথবা টানিয়া দেওয়া পর্দার, কিন্তু একদিন যেখানে অসংকোচ বিচরণের অধিকার ছিল, এখন সেখানে স্বপ্রযুক্ত বিচ্ছেদেব প্রান্তর।
হৈমন্তী ঘরে ফিরিয়া আসিয়া একটা বই খুলিয়া বসে।
তাহার আছে বই, আছে অপুর স্মৃতি, আছে জানালার বাহিরে রুদ্রপলাশ গাছে সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত পাখি আর কাঠবেড়ালির খেলা, দিনের বিভিন্ন সময়ে আকাশের রঙ বদলানো। বয়েস বাড়িবার সঙ্গে সঙ্গে এইসব জিনিসকে হৈমন্তী অপরিবর্তনীয় এবং প্রকৃত সত্যের প্রকাশ হিসাবে নিজের জীবনে লাভ করিয়াছে।
এই অবস্থার অবসান ঘটিল আপনিই।
একদিন দুপুরের পর আকাশ কালো করিয়া মেঘ ঘনাইয়া আসিল। নিবিড় মেঘের ছায়ায় পৃথিবী মেদুর জলভরা ঠাণ্ডা বাতাস বহিতে শুরু করিযাছে, বৃষ্টি নামিল বলিয়া। পুরোনো দিনের অভ্যাসমত হৈমন্তী ডাকিয়া উঠিল-ওরে খোন, দেখে যা কেমন সুন্দর মেঘ করেছে!
ডাক শুনিয়া ছেলের আগে ঘরে ঢুকিল তুলি। পেছন পেছন কাজল।
হৈমন্তীর একেবারে কোল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া তুলি বলিল—তাই তো মা, কী সুন্দর দেখাচ্ছে! তোমার ঘরের জানালা দিয়ে বেশি ভালো করে দেখা যায়। এদিকে একটু সরে যাও, আমরা তোমার কাছে বসি। আচ্ছা মা, নিশ্চিন্দিপুরে বা মৌপাহাড়িতে থাকার সময় এমন দিনে বাবা আর তুমি কী করতে বলল না—
তৃপ্তিতে হৈমন্তীর মন ভরিয়া গেল। সে বলিল—এরকম মেঘ দেখলেই তোমার শ্বশুরমশাই বলতেন-দ্যাখো দ্যাখো, কাকের ডিমের মতো মেঘ করেছে–
তুলি জিজ্ঞাসা করিল–কাকের ডিমের মতো মানে?
হৈমন্তী সস্নেহে বলিল—তুমি দেখ নি কখনও, না? কাকের ডিম কালোরঙের হয়। মেঘ ঘনিয়ে আসছে দেখলেই আমরা বেরিয়ে পড়তাম বেড়াতে–
–বৃষ্টি এলে ভিজতে না?
–ভিজতাম তো! হয়তো কুঠির মাঠ কিংবা কাচিকাটার পুলের কাছে চলে গিয়েছি, এমন সময় ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি নামতো। সেখানে আর কোথায় আশ্রয়? একটা গাছতলায় দাঁড়ালাম হয়তো, তা একটু পরে পাতা ফুড়ে সেখানেও জল পড়তে শুরু করল। তখন আবার হাঁটতে শুরু করতাম, দাঁড়িয়ে ভেজার চেয়ে হাঁটতে হাঁটতে ভেজা আনন্দের। তোমার শ্বশুরমশাই গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করে দিতেন, আমিও গাইতাম–
তুলি বলিল—বাবার গানের গলা খুব সুন্দর ছিল, না মা?
—হ্যাঁ বৌমা। তোমার শ্বশুরবংশে সবাই কিছু কিছু গাইতে পারে, তোমার বাবা খুব ভালো গাইতেন। দরাজ গলা ছিল। সুরের বোধ ছিল। নদীতে স্নান করবার সময় বিশুদ্ধ সংস্কৃতে শ্লোক উচ্চারণ করতেন, স্তবগান করতেন। সে সব গান আবার আমাকে শেখাতেন—
তুলি আরদারের সুরে বলিল—সে গান একটা শোনাও না মা—
লজ্জিতমুখে হৈমন্তী বলিল–না, সে কি আর এখন পারি বৌমা? সে থাক–
–না মা, একটা গান গাইতেই হবে, আমি তুলে নেব তোমার কাছ থেকে।
নদীতে স্নান করিবার সময় আরক্ষ জলে দাঁড়াইয়া অপু যে সংস্কৃত মন্ত্রটি গাহিত হৈমন্তী সেটি শুনাইল। তাহার গলা এখনও বেশ ভালো আছে, উচ্চারণও সুন্দর।
কয়েকদিন পরে কাজল অবাক হইয়া শুনিল তুলি ঘরের কাজ করিতে করিতে গুনগুন করিয়া সেদিনের শেখা গানটি গাহিতেছে। সে বলিল—বাঃ, এর মধ্যে শিখে নিলে গানটা?
—হুঁ মাকে আবার গাইতে বললাম, দু-তিনবারে উঠে গেল—
–বেশ, ভালো। তুমি গান শিখবে তুলি? তোমার গলা তো খুব সুন্দর!
তুলি রাজি হইল। কাজল স্থানীয় এক প্রবীণ গায়ককে অনুরোধ কৰায় তিনি সপ্তাহে একদিন তুলিকে গান শিখাইয়া যাইতেন। গানের ব্যাপারে তুলির স্বাভাবিক দক্ষতা কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশ পাইল। সমস্তু গানই সে অনায়াস দক্ষতায় শিখিয়া ফেলিত। শিক্ষক ভদ্রলোক একদিন কাজলকে বলিলেন—বৌমার সুরের বোধ খুব উঁচুদরের। অনেকদিন ধরে গান শেখাচ্ছি, এমনটি কমই দেখেছি। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত কিংবা টপ্পা অঙ্গের গান বৌমার গলায় খুব ভালো আসে। ওসব কঠিন গান সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী শিখতে চায় না, তারা চায় হালকা বাজার-চলতি গান চটপট তুলে নিতে। বৌমাকে শিখিয়ে আমার গান সার্থক হল–