তুলির সঙ্গে তাহার যোগাযোগ সেই বিশ্ব-পরিকল্পনারই অংশ। আকস্মিক নহে নির্ধারিত।
ঘুম আসিবে—ঘুম আসিতেছে।
কোথায় যেন এক বিস্তৃত শাল-পিয়াশাল-অর্জুনের বন। সে বনের মাথায় পূর্ণিমার চঁদ উঠিয়াছে। রাতজাগা পাখি ডাকিতেছে কোথায়। দক্ষিণ হইতে আসা বাতাসে শুষ্কপত্র মর্মরশব্দে সরিয়া যাইতেছে। গানের সুর জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রিকে উতলা করিয়াছে। অজানা অদ্ভুত এক সুর, পৃথিবীর সব মানুষই সে সুর শুনিয়াছে। আন্তনাক্ষত্রিক শূন্যে সঞ্চরমাণ নীহারিকাদের সে সংগীত। যে শুনিয়াছে, ঘরে আর তাহার মন বসে না। প্রথম যৌবনে আকাশের দিকে তাকাইয়া সেই আদিম রহস্যময় সুর সে একবার শুনিতে পাইয়াছিল, তাই অল্পে সে আর ভোলে নাই। হয়তো এবার আর কিছু হইল না, এ জন্মটা হয়তো বৃথাই গেল, কিন্তু তাই বলিয়া সে নকল সোনা কিনিতে যায় নাই। যেখানে থাকুক, যাহাই করুক, বুকের পাঁজরে সেই অনির্বাণ সংগীত বাজিয়াছে।
ওই জ্যোৎস্নালোকিত অরণ্যভূমির প্রসার পার হইয়া কে যেন তাহার দিকে আসিতেছে।
কে? অপালা? তুলি? তাহার না-দেখা হারানো মা?
না, যে আসিতেছে তাহাকে সে চেনে না। সমস্ত সৃষ্টির নির্যাস লইয়া ইহার অবয়ব। সে মানব নয়, মানবীও নয়, পৃথিবীর কোনো পরিচিত আকারের স্বীকৃত মাত্রায় ইহাকে ধরা যায় না।
কাজলের জাগতিক চেতনা তখন প্রায় নিদ্রাকে স্পর্শ করিয়াছে। তবু তাহার গায়ে শিহরণ জাগিল। যে আসিতেছে তাহারই জন্য কাজলের এতদিনের অপেক্ষা ছিল। এতদিনে আসিল তবে।
কিন্তু চিরপ্রার্থিত সেই মুহূর্তটি শেষ পর্যন্ত আসিল না। যে আসিতেছিল, সে মানুষের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর লইয়া পরম সার্থকতা হিসাবে আসিতেছিল। সে পৌঁছাইবার ঠিক আগেই কাজল ঘুমাইয়া পড়িল।
সুপ্তির প্রান্ত হইতেই শুরু হয় স্বপ্নের অধিকার।
ঘুমাইয়া কাজল সেই রাত্রে অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখিল। যে গ্রহণ করিতে জানে প্রকৃতি তাহাকেই গ্রাহ্যবস্তু দেন। কাজলের সংবেদনশীল মন জীবনের প্রধান এক বাঁকে আসিয়া আরও সংবেদী হইয়া উঠিয়াছিল। স্বপ্নের জগতে সত্যকে যুক্তির জাল দিয়া ধরিতে হয় না, সত্য প্রকাশ ও সম্পূর্ণ হইয়া আপনিই ধরা দেয়। স্বপ্নের মধ্যে কাজল সমস্ত বস্তুবিশ্বকে কী এক জাদুবলে একসঙ্গে দেখিতে পাইল। সেখানে কশা কশা হাইড্রোজেন সঞ্চিত হইয়া আলোকবর্ষব্যাপী নীহারিকার সৃষ্টি হইতেছে, নীহারিকার গর্ভে জন্ম লইতেছে নক্ষত্রের দল। সীমাহীন শূন্যে জ্যোতিষ্কেরা বিশাল দূরত্বের ব্যবধানে ভ্রাম্যমাণ।
আর সেই নক্ষত্রের কেন্দ্রে আবির্ভূত হইতেছে জীবনের মৌলকণা। যে পদার্থে তাহার শরীর গঠিত, নদী পাহাড় বনস্পতি ও সমগ্র জীবজগৎ গঠিত, সেই বস্তুপুঞ্জ সমস্ত বিশ্ব হইতে ছুটিয়া আসিয়া তাহার শরীরে মিলাইয়া যাইতেছে।
মহনীয়, উদার অনুভূতিতে তাহার হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল। সে নক্ষত্রের সন্তান, মরণশীলতা দ্বারা তাহার জীবন সীমাবদ্ধ নয। সে মহাবিশ্বের তাৎপর্যবাহী অধিবাসী, সে নক্ষত্রের সন্তান।
শীতের শেষে সে বৎসর বসন্ত আসিল একখানি গীতিকবিতার মতো।
হিমের আড়ষ্টতা ভাঙিয়া সমস্ত জগৎ যখন নতুন প্রারম্ভের ভূমিকা হিসাবে কচি পাতায় আর দক্ষিণ হইতে আসা বাতাসে নিজেকে প্রকাশ করিতেছে, তেমনই এক দিনে হৈমন্তী কলিকাতায় গিয়া তুলিকে আশীর্বাদ করিয়া আসিল। সঙ্গে গেল প্রতাপ আর পরিবারের বন্ধু দু-একজন। বিবাহ হইবে আষাঢ়ের একত্রিশ তারিখে। উভয়পক্ষেরই লোকবল কম, প্রস্তুতির জন্য এই সময়টা প্রয়োজন।
আশীর্বাদের আগের দিন রাত্রে হৈমন্তী একবার কাজলের ঘরে গেল। সকাল সাতটার মধ্যে পুরোহিতের আসা প্রয়োজন, না হইলে ট্রেন ধরা যাইবে না। পুরোহিত মশাইকে খবর দেওয়া হইয়াছে তো?
ছেলের ঘরে ঢুকিয়া হৈমন্তী দেখিল কাজল ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। টেবিলের ওপর একটি পুরানো, প্রায় মলাট-ছেঁড়া অ্যালবাম আর কাজলের ডায়েরিখানা। অ্যালবামটি সে চেনে, অপুর উদাসীন, ভবঘুরে জীবনের ঘূর্ণি হইতে রক্ষা পাওয়া কিছু ছবি তাহাতে আছে।
কিন্তু বিশেষ করিয়া আজই এটি ছেলের টেবিলে কেন?
হৈমন্তী সামান্য ইতস্তত করিয়া অ্যালবাম খুলিল।
প্রথম পাতাতেই অপর্ণার একখানি ছবি কেবলমাত্র মুখ ও গলার খাজ পর্যন্ত ছবিতে দেখা যাইতেছে, দৈর্ঘ্যে বারো ইঞ্চি, প্রস্থে দশ ইঞ্চির এনলার্জমেন্ট।
হৈমন্তীর বুকের ভেতরটা একবার টনটন করিয়া উঠিল। সে সব জানিয়া, সব মানিয়াই বিবাহ করিয়াছিল। প্রথমা স্ত্রীর প্রতি স্বামীর আমৃত্যু গভীর ভালোবাসার কথা সে যে জানে না এমন নয়। তবু মন-কেমন করে। অপর্ণার প্রতি তাহার কোন ঈর্ষা নাই, স্বামীর অনির্বাণ ভালোবাসার জন্য কোন ক্ষোভ নাই—তবু মন-কেমন করে। ভাগ্যের অনিবার্যতায় স্বামীকে সে সম্পূর্ণ নিজের করিয়া পায় নাই। তাহার দেবতার মতো স্বামী, কোনদিন কষ্ট দেয় নাই, তাহার মন খারাপ হইতে পারে ভাবিয়া কখনও অপর্ণার প্রসঙ্গ তোলে নাই, স্বামীকে হৈমন্তী কোন দোষ দিতে পারিরে না। কিন্তু মেয়েদের মন বড়ো অদ্ভুত, বিচিত্র। আজ ছেলের টেবিলে মায়ের ছবি দেখিয়া অকস্মাৎ হৈমন্তী আবিষ্কার করিল অপর্ণা এই সংসারে এখনো পরিপূর্ণভাবে জীবিত। কাজল তাহার বিবাহের আশীর্বাদের আগের দিন মায়ের ছবি দেখিতেছিল, ডায়েরিতেও নিশ্চয় মায়ের কথা লিখিয়াছে। একটু ইচ্ছা হইলেও সে নিজেকে সংযত করিল। না, ছেলের ডায়েরি সে পড়িবে না।