তুলি তাহার দিকে তাকাইয়া বলিল—যুধিষ্ঠির বিরাটরাজের চাকরি স্বীকার করেছিলেন, ভীম রাঁধুনির কাজ করতেন, দ্রৌপদী রানীর পরিচারিকা চিলেন। তাঁরা কি সম্মানে কারও চেয়ে কম ছিলেন? অবস্থায় রকমফের সবারই হয়, তার জন্য মানুষ ছোট হবে কেন? আজ বাবার যে দেশজোড়া খ্যাতি, মানুষ তাকে উপনিষদকাব ঋষির সঙ্গে তুলনা করছে, সে খ্যাতি আর সম্মানের কাছে জমিদারির গর্ব দাঁড়াতে পারে? আজ কোথায় আমাদের সে জমিদারি? কোথায় সে সম্মান? আর বাবাকে দেখ, তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে মাথা তুলে উঠেছেন।
তারপর একটু হাসিয়া বলিল—আচ্ছা আমি তোমাদের রাঁধুনি হয়ে সবকিছু শোধবোেধ করে দেব, তাহলে হবে তো?
বিমলেন্দু বাজার হইতে ফিরিলেন। তুলি উঠিয়া রান্নার জোগাড় দেখিতে গেল। অন্যমনস্ক কাজল অনেকক্ষণ বাদে খেয়াল করিল তুলি তাহাকে কখন যেন তুমি সম্বোধন করিতে শুরু করিয়াছে। কখন হইতে এটা ঘটিল? সে খেয়াল করে নাই তো!
সারাদিনে তুলির সঙ্গে আর বিশেষ কথা হইবার সুযোগ হইল না। খাওয়া সারিয়া বিমলেন্দু কাজলকে লইয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিলেন এবং ক্রমাগত একালের দোষ ও সেকালের গুণ বর্ণনা করিতে লাগিলেন। কোনো কোনো প্রসঙ্গে কাজল তাহার সহিত একমত হওয়া সত্ত্বেও সে আলোচনায় যোগ দেওয়ার উৎসাহ পাইল না।
মাথার মধ্যে যেন কেমন করিতেছে। অথবা ঠিক মাথার মধ্যে নয়, সমস্ত চেতনায় কেমন একটা অস্থিরতার ভাব।
অনেকদিন আগে, তাহার বাবার কৈশোরে যে নাটক শুরু হইয়াছিল, এতদিনে বোধহয় তাহা স্থির পরিণতির দিকে অগ্রসর হইতেছে। মৃত্যুর ওপারের জগৎ হইতে তাহার বাবা ও তুলির মা নিশ্চয় তৃপ্তিলাভ করিবেন। নিজেদের বিচ্ছেদ সন্তানের মিলনে পূর্ণতা লাভ করিবে। মহাকালের কী বিচিত্র গতি।
বিকালে বিদায় লইবার সময় সে বিমলেন্দুকে বলিল—মামা, আপনি একবার আমাদের বাড়ি যাবেন না?
বিমলেন্দু বলিলেন–হাঁ, সে তো যাবো নিশ্চয়। দেখি এইবার–
হঠাৎ থামিয়া তিনি তীক্ষ্ণচোখে কাজলের দিকে তাকাইয়া বলিলেন—তুমি কি—মানে, বিশেষভাবে যাওয়ার কথা বলছো?
মাথা নিচু করিয়া কাজল বলিল–আজ্ঞে হ্যাঁ। আমি আপনার কাছ থেকে ভেবে দেখবার জন্য সময় চেয়ে নিয়েছিলাম, আমি মনস্থির করে ফেলেছি, এবার আপনি একবার চলুন—
বিমলেন্দুর মুখ দেখিয়া মনে হইল তিনি আগেই আন্দাজ করিয়াছিলেন, কাজল আজ এই কথা বলিবে। তিনি বলিলেন—তোমার মা?
-মায়ের অমত হবে না।…
বিমলেন্দু চুপ করিয়া একমুহূর্ত কী ভাবিলেন, তারপর বলিলেন—আমার দিদির জীবনের সব কথা কি তোমার মা ঠিকঠাক জানেন? সমাজ খুব হিংস্র অমিতাভ, মানুষ মানুষকে পীড়ন করে বড়ো সুখ পায়। বিয়ের পর যদি কেউ এসব পুরোনো কথা দিয়ে ঘাটাঘাটি করে।
কাজল বলিল—আমার মা সব জানেন। সমাজকে তিনি মানেন, কিন্তু সমাজের অন্যায় আচরণকে ভয় পান না। তাছাড়া বাবা যাকে সমর্থন করে গিয়েছেন, সে কাজ করতে মায়ের কোনো দ্বিধা হবে না। ও নিয়ে চিন্তা করবার কারণ নেই।
বিমলেন্দুর মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন—আমি যাব, খুব শিগগীরই যাব, তোমার মাকে বোলো। অমিতাভ, তুমি যে আমাকে কতবড় দায় থেকে উদ্ধারের আশা দিলে, তা আমি কী করে বোঝাবো? পিতার উপযুক্ত সন্তান তুমি, তোমার মঙ্গল হোক—
ছুটির দিনের সন্ধ্যার ট্রেনে বেশি ভিড় নাই। জানালার ধারে বসিয়া কাজল বাহিরে তাকাইয়া ছিল। একটু একটু করিয়া অন্ধকার নামিতেছে, ঝোপঝাড় বাড়িঘর সস পিছাইয়া যাইতেছে।
কাজলের মন এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরিয়া উঠিল। কবেকার ফুরাইয়া যাওয়া আতরের শিশি খুলিলে যেমন অস্পষ্ট সুগন্ধের রেশ মনকে উদাস করে, তেমনি তাহাদের পরিবারের ইতিহাস, তাহার বাবার পুণ্যস্মৃতি, তুলির মায়ের ব্যর্থ জীবন, নিশ্চিন্দিপুর আর মৌপাহাড়িতে কাটানো তাহার স্বপ্নের শৈশব–সমস্ত তাহার চেতনার পটে একসঙ্গে ভাসিয়া উঠিল।
বাবা যদি বাঁচিয়া থাকিত।
কত কথা বলিতে ইচ্ছা করে, ছোটবেলার মতো চুপ করিয়া বাবার পাশে শুইয়া থাকিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু উপায় নাই। নির্মম মহাকাল তাহার বাবাকে কোন অজানা দেশে লইয়া গিয়াছে। বাবা এখন কেবলমাত্র অতীতের এক সুখস্মৃতি।
কিংবা সত্য কি তাই? বাবাকে কি সে প্রতিমুহূর্তে নিজের রক্তের ভিতর, চেতনা ও উপলব্ধির ভিতর অনুভব করিতেছে না? বাবার চাইতে তাহার কাছে আর কে বেশি করিয়া জীবিত?
মায়ের শরীর ভালো নয়। তুলি আসিয়া মাকে যত্ন করিবে, মায়ের হাত হইতে কাজ তুলিয়া লইবে। সামনে কঠিন কাজ আসিতেছে, বাবার স্মৃতিরক্ষার কাজ, সেই কাজে তাহাকে সাহায্য করিবে। যে কাজ প্রকৃত গুরুত্বপূর্ণ, একান্ত আপন ছাড়া তাহাতে কেহ সহায়তা করিতে পারে না।
একজন খুব কষ্ট পাইবে। সবদিক দিয়াই সে বঞ্চিত হইল।
বাহিরে অন্ধকারে চাহিয়া কাজল মনে মনে তাহার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করিল। সেদিন রাত্রে She walks in beauty, like the night পড়িতে পড়িতে ঘুম আসিল। আলো নিভাইবার পর ঘুমাইয়া পড়িবার আগে পর্যন্ত যে স্তিমিত চেতনার রাজত্ব, সেইখানে কাজলের মন সামান্য সময়ের জন্য দাঁড়াইয়া গেল।
ঈর্ষা, যুদ্ধ, লোভ আর মৃত্যুর সীমাবদ্ধতার পরপারে অনন্ত শূন্যের ভিতর দিয়া সৌরবাতাস বহমান। বিশ্বের ইতিহাস মেসোপটেমিয়া, শানিদার গুহাবাসী নিয়ানডার্থাল কিংবা জলচর ট্রাইলোবাইটদের সিরিয়ান যুগে শুরু হয় নাই, পৃথিবীর জন্মেরও আগে-নক্ষত্রদের জন্মের আগে, নক্ষত্ৰ-নীহারিকা,মহাশূন্য-মহাকাল যখন একটিমাত্র বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত সম্ভাবনা হিসাবে বিরাজমান ছিল, ইতিহাসের প্রথম পাতা তখন লেখা হইয়াছে। বিশ্বের রঙ্গমঞ্চে মানুষ আসিয়াছে এই সেদিন, কিন্তু সৃষ্টির সেই আদিম মুহূর্ত হইতে চরাচরব্যাপী এক মহাচেতনা দেশকালে ব্যাপ্ত হইয়া ছিল। তাহা হইতেই জগৎ, তাহা হইতেই যাবৎ বস্তুপিণ্ড। প্রেম, কবিতা, দর্শন, বিজ্ঞান—যে ছোট ফুলটি সুবর্ণবেখার তীরে সে ঘাসের মধ্যে ফুটিয়া থাকিতে দেখিয়াছে, সেটি হইতে দূর ভবিষ্যতে সময়ের শেষ ভগ্নাংশ পর্যন্ত সমস্ত কিছু সৃষ্টিপূর্ব ওই মহাচেতনাব মধ্যে লুকাইয়া ছিল।