মাথা নিচু করিয়াই কাজল বলিল—তুলি, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে,
বাড়ি খালি, ফিসফিস করিয়া কথা বলিবার কোনো প্রয়োজন নাই, তবু গোপন ষড়যন্ত্র করিবার সময় মানুষের কণ্ঠস্বর যেমন খাদে নামিয়া যায়, কাজলের গলাও তেমনই শুনাইল। এই পরিবেশে অমনভাবে কথা বলিলে তাহার একটিই অর্থ হয়। কিন্তু তুলি তো পূর্ণ নারীত্বে পৌঁছায় নাই। সে কাজলের মুখের দিকে নিঃসংকোচ দৃষ্টি রাখিয়া জিজ্ঞাসা করিল—আমার সঙ্গে? কী কথা?
এবার কাজল মুখ তুলিল, গলা পরিষ্কার করিয়া বলিল—তোমার মামা এখন বাড়ি নেই, এভাবে একথা বলা উচিত হচ্ছে কিনা জানি না। কিন্তু কথাটা কেবল তোমাকেই বলবার মতো, আর কেউ সামনে থাকলে বলা যাবে না। মনোযোগ দিয়ে শুনে তোমার উত্তর দাও
এইবার বোধহয় পরিস্থিতি তুলি কিছুটা বুঝিল। মেয়েদের স্বাভাবিক উপলব্ধির ক্ষমতা দিয়া সে বুঝিল তাহার জীবনের সম্পূর্ণ নূতন এক পর্বের প্রস্তাবনা হইতে চলিয়াছে। একটু একটু করিয়া তাহার মুখে অরুণাভা ছড়াইয়া পড়িল। এইবার সেও ফিসফিস করিয়া বলিল—বলুন!
–তুমি তো জানো, তোমার মা আর আমার বাবা বন্ধু ছিলেন। হয়তো এই বন্ধুত্ব আরও গভীর সম্পর্কের দিকে গড়াতো, কিন্তু আমার বাবা দরিদ্র ছিলেন, খুবই সাধারণ অবস্থার মানুষ দুবেলা তার খাওয়া জুটতো না। তোমরা ছিলে বড়ো ঘব, তোমার মা রাজার ঐশ্বর্যের মধ্যে বড়ো হয়েছেন। ছোটবেলায় বন্ধুত্ব হতে হয়, কিন্তু তার চেয়ে বেশি কিছু নয়। শেষপর্যন্ত তোমাদের বাড়ির দিক দিয়ে কেউ ব্যাপারটা মেনে নিতো না। অবশ্য সে প্রশ্নও ওঠে না, কারণ খুব অল্পবয়েসেই বাবা আমার ঠাকুমাব সঙ্গে তোমাদের বাড়ি ছেড়ে মনসাপোতায় চলে যান। আই.এ পাস করার পর অদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাবার বিয়ে হয়। সে গল্প হয়তো তোমার মামার কাছে তুমি শুনে থাকবে। তোমার মায়েরও বিয়ে হয়ে যায়। আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে আমার মায়ের মৃত্যু হয়। মা বলতে আমি এই মাকেই জানি, তিনিও সন্তান বলতে আমাকেই জানেন।
কাজল একটু থামিল। তুলি পূর্ণদৃষ্টিতে তাহার দিকে তাকাইয়া আছে।
—তোমার মায়ের মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বাবার সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব মধুর ছিল, ঘনিষ্ঠ ছিল। এ যে কত পবিত্র ঘনিষ্ঠতা তা আমি বলে বোঝাতে পারবো না। দুজনে পরস্পরের নিঃসীম একাকীত্বকে গভীর আত্মিক সান্নিধ্য দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছিলেন। তোমার ছোটবেলায় ভবানীপুরের বাড়িতে বাবা তোমাকে প্রথম দেখেন-তখন তোমার মা মারা গিয়েছেন। তোমাকে দেখে সেই রাত্তিরেই বাবা তার ডায়েরিতে একটা ইচ্ছের কথা লিখে যান—সে ইচ্ছে তোমাকে আর আমাকে ঘিরে।
কাজল আবার থামিল। মরিয়ার মতো অনেক কথা বলিবার পর তাহার বুক ঢিপ ঢিপ করিতেছে। তুলি কি কিছু মনে করিল? সে কি ভাবিতেছে যে, নির্জন বাড়িতে একা পাইয়া কাজল তাহাকে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত করিবার চেষ্টা করিতেছে? খুব অস্পষ্ট স্বরে তুলি বলিল—এসব আমি কিছুটা জানি। আপনি কী বলবেন?
তুলির কথায় কাজল অবাক হইল, বেশ ভালোও লাগিল। তুলি সরল, ন; কিন্তু তাহার আড়ষ্টতা নাই–সে বোকাও নয়। ঠিক কথা ঠিক সময়ে বুঝিতে পারে।
কাজল বলিল—তুমি কী করে জানলে? কে বলেছে তোমাকে?
–মামা। মানে ঠিক ওভাবে বলেন নি, তবে মাঝে মাঝেই নানা কথায় আমি বুঝতে পারছিলাম এমন একটা কিছু ঘটতে চলেছে।
কাজলের গলার কাছে কী একটা গুটলি পাকাইয়া উঠিতেছে। তুলির শরীর হইতে কেমন একটা মৃদু সুগন্ধ পাওয়া যায়, তার সবটাই এসেন্স নহে, তরুণী-শরীরের নিজস্ব ঘ্রাণ–রৌদ্রের গন্ধের মতো, বৃষ্টিভেজা কদমের গন্ধের মতো, শাশ্বতী মানবীর মতো।
সে বলিল—এমন কিছু ঘটলে তোমার কি আপত্তি হবে?
এবার তুলি চুপ করিয়া রহিল।
কাজল বলিল–চুপ করে থাকলে তো চলবে না, মামা এসে পড়ার আগে তোমার মতটা আমার জানা প্রয়োজন। তাহলে আমিও ওঁর সঙ্গে কথা বলে যাব।
—আমার মত জানা কেন প্রয়োজন?
–কারণ তুমি খেলার পুতুল নও যে, দোকান থেকে পছন্দ করে কিনে নিয়ে যাব। তাছাড়া আমার বাবা চেয়েছিলেন বলেই এতে তোমারও মত থাকবে তার কী মানে আছে? যাক, এসব ছেড়ে দিলেও তোমার দিক থেকে আরও অনেক ভাববার বিষয় থেকে যায়—
—কী?
—যেমন ধরো, আমার বাবার খ্যাতি আছে সত্য, কিন্তু আমরা বড়োলোক নই। তুমি অভিজাত ধনী পরিবারের মেয়ে, তুমি মানিয়ে নিতে পাববে তো? এ তো দুদিনের খেলা নয়, সারাজীবনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তোমার কী মত? ভেবে বলো—
তুলি কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিল, তাবপব আস্তে আস্তে বলিল–বাবা যা ঠিক কবে গিয়েছেন, তার ওপরে আমার আর বলাব কী আছে?
কাজলের সমস্ত শবীরে একটা কেমন ভালো লাগার, তৃপ্তির শিহরণ বহিযা গেল। সে বুঝিল তাহার বাবাকে তুলিও বাবা বলিয়া উল্লেখ কবিতেছে। তবু সে বলিল–না, আরও ভাববার কথা আছে।
–কী?
–আমার বলতে সংকোচ হচ্ছে, তুমি হয়তো ব্যাপারটা জানো, তবু একবার নিজের মুখে না বলে নিলে আমি শান্তি পাবো না
তুলি বিস্মিত চোখে তাকাইয়া বলিল—কী বলবে তুমি? আমি বুঝতে পাবছি না—
—দেখ, আমার ঠাকুমা সর্বজয়া দেবী, তোমাদের বাড়িতে—
কাজল থামিয়া গেল। তুলি অপলকে তাকাইয়া আছে।
মনের জোর সংগ্রহ করিযা কাজল বলিল—আমার ঠাকুমা তোমাদের বাড়িতে রাঁধুনির কাজ করতেন। আমাকে বিয়ে করলে তোমার সম্মানে আঘাত লাগবে না তো?
এইবার যাহা ঘটিল তাহা সত্যই বিস্ময়জনক। কাজল এতদিন তুলিকে নিতান্ত লাজুক আর স্বল্পভাষিণী বলিয়া ভাবিয়া আসিয়াছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় মেয়েবা যে কত সরল অথচ বলিষ্ঠভাবে নিজের কথা বলিতে পারে তাহা সে আজ দেখিল।