কী করা যায়? সে কি সংকোচ কাটাইয়া সরাসরি তুলির সঙ্গে কথা বলিবে? নাঃ, সে তাহা পারিবে না। চিঠি লিখিয়া মন জানিতে চাহিবে? না, তাহাও বড়োই নাটকীয় হইয়া যাইবে। অবশ্য এমনি একবার দেখা করিতে যাওয়া যায়। কে কেমন আছে জানিতে যাওয়াটা এমন অন্যায় কিছু নয়।
অনেক ভাবিয়া সে যাওয়াই ঠিক করিল।
তবে সঙ্গে সঙ্গে সে বুঝিতে পারিল যে, কেবলমাত্র কুশল প্রশ্ন করিবার আগ্রহে সে ছুটিয়া যাইতেছে না। নমুখী এক সুন্দরী তরুণীর সহিত দেখা হইবার সম্ভাবনা তাহাকে প্ররোচিত করিতেছে। অবশ্য তাহাতে কিছু আসে-যায় না, নিজের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করিয়া কী লাভ? সে যে তুলিকে ভালোবাসিতে শুরু করিয়াছে ইহাতে তত সন্দেহ নাই।
সিদ্ধান্ত লইবার পরদিনই কাজল খুব সকালের ট্রেনে কলিকাতায় রওনা হইল। বিমলেন্দুর বাড়ি পৌঁছাইয়া দেখিল তিনি বাহিরের ঘরে বসিয়া স্টেটসম্যান পড়িতেছেন। তাহাকে দেখিয়া বিমলেন্দু যথার্থই খুশি হইলেন, বলিলেন–তোমার খবর কী হে? কলকাতায় আর আসছ না নাকি, মা কেমন আছেন?
যথাবিহিত কুশল বিনিময়াদির পর বিমলেন্দু বলিলেন—এত সকালে এসেছ মানে নিশ্চয় কিছু খেয়ে বের হওনি? দাঁড়াও, তোমার জলখাবারের ব্যবস্থা করি। এমনি কি বিশেষ কোনো কাজ আছে কলকাতায়? নেই? তাহলে দুপুরেও এখানে খেয়ে একেবারে ওবেলা যাবে। কী ভালোবাসো বলমাংস না মাছ? আমি নিজে তোমার জন্য বাজার করব
কাজল বাধা দিবার চেষ্টা করিল, বলিল—অকারণে বাজারে ছুটির প্রয়োজন নাই, বাড়িতে যা আহে তাহই যথেষ্ট।
বিমলেন্দু সে-সবে কর্ণপাত করিলেন না, গলা উঠাইয়া ডাকিলেন-তুলি! তুলি!
কাজলের বুকের মধ্যে কেমন করিয়া উঠিল। এইবার দেখা হইবে—এইবার তুলি আসিবে।
একখানি বেগুনী রঙের শাড়ি পরনে, মামার ডাকে তুলি আসিয়া ঘরে ঢুকিল।
সামাজিকতা ভূলিয়া কাজল অবাক হইয়া তাকাইয়া রহিল।
এই সকালেই তুলির স্নান সারা হইয়া গিয়াছে। ভেজা চুল পিঠের উপর বিন্যস্ত। মুখে কোনো প্রসাধনের চিহ্ন নাই, তবু তুলিকে দেবীর মতো দেখাইতেছে। বাবার ডায়েরিতে তুলির মায়ের কথা কাজল পড়িয়াছে। মেয়েকে দেখিলে মায়ের সে সৌন্দর্য আন্দাজ করিতে পারা যায়।
তুলির মা সুখী ছিলেন না, মেয়েরও কি সেই ভাগ্যই হইবে?
না, তুলিকে সে সমস্ত কষ্ট হইতে রক্ষা করিবে। তাহার গায়ে রৌদ্র লাগিতে দিবে না।
বিমলেন্দু বলিলেন–তোমার ইয়ে, কী বলে—অমিতাভদা এসেছেন। চট করে কিছু লুচি ভেজে দাও।
কাজল বলিল—কেমন আছো তুলি? আর দুর্বলতা নেই তো?
তুলি হাসিয়া বলিল—ভালো আছি। আপনারা কেমন আছেন? মা?
কাজলের ভালো লাগিল, তুলি মাসিমা বা কাকিমা বলিয়া হৈমন্তীকে নির্দেশ করিল না, একেবারে মা বলিয়া ডাকিল। চেহারায় আচরণে এমন কমনীয় মেয়ে সে আর কখনও দেখে নাই।
জলখাবার তৈরি করিবার জন্য তুলি বাড়ির ভিতরে গেলে বিমলেন্দু তাহার সঙ্গে সাহিত্য, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ইউ.এন.ও-র অপদার্থতা, সেকালে সবকিছুই ভালো ছিল ইত্যাদি লইয়া আলোচনা করিতে লাগিলেন। কাজল বলিল—সে কী মামা, পৃথিবীসুদ্ধ লোক ইউ এন.ও. নিয়ে এত মাতামাতি করছে, আর আপনি বলছেন ও দিয়ে কোনো কাজ হবে না!
–হবে না তো! তুমি মিলিয়ে দেখে নিয়ে আমার কথা খাটে কিনা। লীগ অফ নেশনস হবার পরে কেউ কি আর ভেবেছিল আরও একটা মহাযুদ্ধ হবে? আসলে মানবজাতির চবিত্রের মধ্যে বর্বরতার বীজ আছে। সভ্যতার পালিশ দিয়ে আমরা সেটা ঢেকে রাখি মাত্র। সে পালিশটাও খুব হালকা, মাঝে মাঝেই নিচের কালো রঙটা বেরিয়ে পড়ে। যুদ্ধ আবার হবেই, আজ না হোক বিশ পঞ্চাশ কী সত্তর বছর পরে হলেও হবে। আর ছোটখাটো ঘরোয়া ক্ষেত্রে তো যুদ্ধ চলছেই, তাই না? সংসারে কর্তৃত্বের জন্য, অফিসে ক্ষমতা আর পদোন্নতির জন্য, রাজনীতিতে সর্বশক্তিমান হবার জন্য, যে কোনো উপায়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার জন্য যুদ্ধ চলছেই। এসবই বাড়তে বাড়তে একদিন বৃহৎ আকারে ফেটে পড়ে।
কাজল বলিল—ইউনাইটেড নেশনস ব্যর্থ হবে বলছেন, তাহলে মানুষের বাঁচবার উপায় কী?
বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করিয়া বিমলেন্দু বলিলেন—লোভ ত্যাগ করা। অল্পে সন্তুষ্ট থাকা।
–তাহলে তো জ্ঞান-বিজ্ঞান, কল-কারখানা, সভ্যতার অগ্রগতি সব থেমে যাবে। লোভই বলুন আর যাই বলুন, মানুষ নিজের অবস্থার আরও উন্নতি ঘটাতে চায় বলেই বিজ্ঞানের আবিষ্কার ঘটে, দেশ এগিয়ে যায়
–না, সম্পূর্ণ ভুল। কল-কারখানা বা ঐশ্বর্য দিয়ে সভ্যতার অগ্রগতি মাপা যায় না, সেটা মাপা হয় সংস্কৃতির মান দিয়ে। শেকীয়ার কিংবা কালিদাস অথবা ব্যাসদেবের সময়ে প্রযুক্তি তার শৈশবে ছিল, কিন্তু তাদের কীর্তি নিয়েই তো আমরা গর্ব করি, গবেষণা করি। আমি বলছি না যে বিজ্ঞানচর্চা ছেড়ে দাও, প্রযুক্তি থামিয়ে দাও—আমি বলছি এ ধরনের উদ্যোগকে একটা সীমার মধ্যে আরদ্ধ রাখো। ভোগের তৃষ্ণা বাড়ালেই বাড়ে, সময়মত না থামালে সর্বনাশ!
তুলি এই সময়ে জলখাবার লইয়া আসায় বিমলেন্দুর বক্তৃতাস্রোতে বাধা পড়িল। তিনি উঠিয়া একটা জামা গায়ে গলাইতে গাইতে বলিলেন–তুমি বসে তুলির সঙ্গে কথা বলে, আমি চট করে একবার বাজার থেকে ঘুরে আসি। তুলি, দেখিস ওর আর কী লাগে—
কাজলের আপত্তিতে কর্ণপাত না করিয়া বিমলেন্দু ব্যাগ হাতে বাহির হইয়া গেলেন।
সুচি খাইবার মতো মনের অবস্থা কাজলের ছিল না। সে মাথা নিচু করিয়া খাবার নাড়াচাড়া করিতে লাগিল। তুলনায় তুলির আচরণ অনেক সহজ, কারণ শৈশব হইতে যেভাবে সে বড়ো হইয়াছে তাহাতে লজ্জার বোধ জন্মাইবার কোনো সুযোগ ছিল না। মামাকে ছাড়িয়া দিলে কাজল তাহার জীবনে প্রথম পুরুষ যাহার সঙ্গে বসিয়া সে একান্তে কথা বলিতেছে। লজ্জা করিতে সে শেখে নাই, কিন্তু তাহার ন, একান্ত মেয়েলি স্বভাব তাহাকে অনন্য করিয়া তুলিয়াছে।