চনু রাগিয়া অস্থির হইল। জমি সে কাহাকেও ছাড়িয়া দিবে না, তাহার জন্য সে শেষ অবধি দেখিতে রাজি।
কাজল চুপ করিয়া সব শুনিল, তারপর বলিল—কাউকে পোড়াতে নিয়ে গিয়েছিস কখনও?
আলোচনার দিক বদলে থতমত খাইয়া চনু বলিল—তার মানে?
–গিয়েছিস কখনও?
–গিয়েছি তো, তাতে কী?
শান্ত গলায় কাজল বলিল—আমি প্রথম আমার দাদামশাইকে দাহ করতে নিয়ে যাই। তুই তো তাঁকে দেখেছিস-সুরপতিবাবু, মনে আছে? তার আগে আর কখনও চোখের সামনে শবদাহ দেখিনি। দাদু খুব রাশভারী মানুষ ছিলেন, লোকে তার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে সাহস পেত না। সেই দাদুকে যখন চিতায় ওঠানো হল, দেখলাম কী অসহায়ভাবে তার দেহ চিৎ হয়ে পড়ে আছে। মন্ত্র পড়া হলে শ্মশানের পুরোহিত দাদুর দেহের ওপর আরও কখানা কাঠ চাপিয়ে দিয়ে তলা থেকে টেনে তার শরীরে ঢাকা দেবার শেষ কাপড়টুকুও বের করে নিল। উলঙ্গ ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, উলঙ্গই চলে গেলেন।
চনুর গলার তেজ কমিয়া আসিয়াছে, অবাক গলায় সে বলিল—কী বকছো পাগলের মতো? কী বলতে চাও তুমি?
–বলতে চাইছি যে, সেই প্রথম আমার মনে হল—এ দুনিয়া থেকে কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারে না। আমরা সবাই কথাটা জানি, কিন্তু কেউ মনে রাখি না। খামোকা পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কয়েকটা বছর ঝামেলা করে কাটাই। ও জমি আমি কোনেদিন ভোগ করতে আসবো না চনু, ওখানে আমার বাবার স্মৃতিভবন তৈরি হবে। তাকে অনেক লোক ভালোবাসে। তাদের সেই ভালোবাসার জোর থাকলে ওখানে স্মৃতিভবন হবেই, কেউ আটকাতে পারবে না। সে বন্যার জল তুই ঠেকাতে পারবি না। যদি তা না হয়, তাহলে সেটাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নেব। তোর সঙ্গে আমার কোন ঝগড়া নেই। ততদিন কলাবাগান কর না, ক্ষতি কী–তবে আমাকে বলে কবলেই পারতিস, তাতে অন্তত আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হত না।
খাওয়া-দাওয়া করিয়া একটু বেলায় কাজল বাড়ির দিকে রওনা হইল। বানু ছোটবেলার মতো তাহার চিবুক ধরিয়া চুমু খাইয়া বলিল—তাড়াতাড়ি আবার আসবি, কেমন? একবার মাকে নিয়ে আয় না
-মায়ের শরীর মোটে ভালো যাচ্ছে না পিসি। আসলে বাবার মারা যাওয়াটা মা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি, মনের কষ্টে ভেতরটা আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যাচ্ছে। এমন দিন যায় না যেদিন বাবার কথা বলতে বলতে মা কাঁদে না
রানু বলিল–আমরা কেউ তোর বাবাকে ভুলি নি, তোর মাকে সে কথা বলিস–
গ্রামের পথ আঁকিয়া-বাঁকিয়া পাকা সড়কের দিকে চলিয়াছে। সে পথ ধরিয়া বাঁদিকে গেলে আষাঢ়, আর ওপাশে সোনাডাঙার মাঠ। অনেক-অনেকদিন আগে দুইটি গরিব ঘরের বালকবালিকা ওই পথ দিয়া রেলগাড়ি দেখিবার আশায় ছুটিয়া গিয়াছিল। তাহাদেব একজন এই গ্রামেই রহিয়া গিয়াছে, এই গ্রামেরই শান্ত নদীতীরে তাহার শেষ শয্যা রচিত হইয়াছিল। নির্জন বসন্ত দ্বিপ্রহরে এখনও কি সে গহন লতাকুঞ্জে কঁচপোকা খুঁজিয়া বেড়ায়?
কতদিন আগে স্বরূপ চক্রবর্তী গ্রামের নদীতীরে সন্ধ্যাবেলা দেবী বিশালাক্ষ্মীকে দেখিয়াছিলেন? সে কবেকার কথা? দেবী কি নিশ্চিন্দিপুর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছেন?
২০. অল্পবয়েসে জীবনটা একরকম বেশ সুখে
বিংশ পরিচ্ছেদ
অল্পবয়েসে জীবনটা একরকম বেশ সুখেই চলিতে থাকে। মাথার ওপরে একটা বড়োসড়ো আকাশ, দিগন্ত অবধি বিস্তৃত পৃথিবী তার সমস্ত আনন্দ দুঃখ হর্ষ আর পথের প্রতি বাঁকে আস্বাদিত চমক লইয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। সবকিছুই ঘটতে পারে, ঘটিবেও। আজ কিছু হইল না বটে, কিন্তু কাল নিশ্চয় হইবে। প্রত্যেকদিন সকালে উঠিয়াই আনন্দে মন ভরিয়া যায়, নতুন সম্ভাবনা লইয়া আর একটি দিন শুরু হইল। বাতাসে সমুদ্রপারের মশলাদ্বীপ হইতে ভাসিয়া আসা সুগন্ধ, চেতনায় মুক্তির সুর।
সময় কাটিতে আরম্ভ করিলে জীবনের এই পট বদলাইতে থাকে। দায়িত্ব, কর্তব্য, ছকে বাঁধা সময়সুচি আর বহুবিধ সমস্যা আসিয়া পূর্বের সরল আনন্দকে ভাসাইয়া লইয়া যায়। বাতাস আর তেমন করিয়া বয় না, আকাশের নীল বিবর্ণ হইয়া আসে। নদীর স্রোতের শব্দে আর আগের মতো প্রকৃতির রহস্যময় গোপন সংগীত বাজে না। সে বড়ো ভয়ের সময়, বড়ো কষ্টের সময়।
কাজলের এখন সেই বয়েস। যন্ত্রণা একা সহ্য করিতে হয়, সব সমস্যায় দৌড়াইয়া মায়ের কাছে আসিয়া পরামর্শ চাওয়া যায় না, অনেক সমস্যার কোন উত্তরই থাকে না। ছোটবেলার বিশ্বাস, প্রথম যৌবনের মূল্যবোধ, আজীবন সঞ্চিত যা কিছু ভালোলাগার সম্পদ—সব একে একে বদলাইয়া যায়। চেনামুখ সরিয়া যায়, অচেনা মুখ নতুন বন্ধুত্ব লইয়া আসে না—এ বড়ো কঠিন সময়।
তুলিকে সে ফেলিতে পারিবে না। তুলির সঙ্গে তাহার আজ পর্যন্ত একটাও এমন কোন কথা হয় নাই, যাহাকে মন দেওয়া-নেওয়ার ভূমিকা বলা যাইতে পারে। আর দেরি করা যায় না, অপালার প্রতি তাহার আচরণ একান্ত নিষ্ঠুর হইবে সন্দেহ নাই, কিন্তু তুলিকে স্বীকৃতি না দিলে আরও বেশি অন্যায় করা হইবে। অপালা উচ্চশিক্ষিতা, প্রতিপত্তিশালী পিতার সুন্দরী কন্যা, তাহার ভালো বিবাহ হইতে সময় লাগিবে না। কিন্তু তুলির কেহ নাই, বিমলেন্দুর বয়েস হইয়া আসিতেছে, তিনি আর কতদিন ভাগ্নীকে দেখিবেন? মায়ের কলঙ্কের জন্য কেহ তাহাকে বিবাহ করিতে রাজি হইবে না। বাঙালি সমাজে এসব কথা চাপা রাখা কঠিন, নির্যাতন করিতে পারিলে মানুষ আর কিছু চায় না।
সরল তুলি-জীবনের বিরুদ্ধ স্রোতের তীব্রতায় কোথায় ভাসিয়া যাইবে।
আচ্ছা, এমনও তো হইতে পারে যে, সে এত চিন্তা করিতেছে, কিন্তু তুলি তাহাকে পছন্দ করিবে না? সব মেয়েরই মনে স্বামী সম্বন্ধে একটা ভাবমূর্তি থাকে। তুলির কল্পনার সঙ্গে তাহার ব্যক্তিত্ব হয়তো একেবারেই মেলে না। বিমলেন্দুর ব্যবস্থা সে হয়তো নীরবে মানিয়া লইবে, কিন্তু বিবাহিত জীবনে সুখী হইবে না।