–স্কলার জিপসি হতে চাও? ম্যাথু আর্নল্ডের স্কলার জিপসি—যে জীবনের গভীর রহস্য খোঁজবার জন্য নিজের সমাজ-সংসার ফেলে উধাও হয়ে গিয়েছিল–
–হ্যাঁ, ঠিক বলেছো। স্কলার জিপসি আমার খুব প্রিয় কবিতা। অমন জীবন পেলে আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়
দুই বন্ধুতে গল্প করিয়া প্রায় সারারাত কাটাইয়া দিল। আলোচনা করিতে করিতে প্রভাত ক্রমে স্বীকার করিল তাহারও যে অ্যাভেঞ্চারের স্বপ্ন নাই এমন নয়। বস্তুত একবার সে ভাবিয়াছিল ক্যাপটেন কুক যে পথে সমুদ্রযাত্রা করিয়াছিলেন সেই পথে নৌকা লইয়া ভ্রমণে বাহির হইবে। প্রবেশিকা পরীক্ষা দিবার আগেই সে একটা খাতায় অভিযানের খসড়া পর্যন্ত করিয়া ফেলিয়াছিল। গঙ্গার মোহনা দিয়া বঙ্গোপসাগর, তারপর পোর্ট ব্লেয়ার হইয়া রেঙ্গুন। সেখান হইতে জাভা, বোর্নিও এবং সুমাত্রা ছুঁইয়া নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া। ইহার পর উত্তরে ওশিয়ানিয়ার অজস্র ছোট ছোট দ্বীপ, নারিকেলশ্রেণী বেষ্টিত হলুদ তীবভূমি—পথে অবশ্য আঙ্কোর ভাট দেখিয়া লইতে হইবে। সব পরিকল্পনা করা আছে। কিন্তু আর তিনবছর পর তাহার বাবা চাকুরি হইতে অবসর লইবেন। ছোট বোনের বিবাহ এখনও হয় নাই। দিদির বিবাহের দেনার জন্য বাড়ির দলিল মহাজনের নিকট বন্ধক আছে, সেখানা ছাড়াইবার ব্যবস্থা করিতে হইবে। আগামী চার বছরের মধ্যেই সংসারের যাবতীয় ভার তাহাকে লইতে হইবে। এ অবস্থায় পলিনেশিয়াব চন্দ্রালোকবিধৌত দ্বীপভূমির স্বপ্ন না দেখাই ভালো।
কাজল উৎসাহে বিছানায় উঠিয়া বসিল, কেন? এতই কি অসম্ভব? বেশ তো, প্রভাত বোনের বিবাহ দিক, বাড়িখানা মহাজনের হাত হইতে ফিরাইয়া আনুক—ততদিন চাকুরি করিলে ক্ষতি নাই। কত সময়ই বা লাগিবে? পাঁচবছর বড়ো জোর-তখনও তাহারা এমন কিছু বৃদ্ধ হইয়া পড়িবে না। ত্রিশও হইবে না বয়েস। বরং দায়িত্ব মিটাইয়া বাহির হওয়াই ভালো। অভিযান সারিয়া ফিরিতে বছরদেড়েক লাগিবে, তখন তাহারা বিখ্যাত হইয়া পড়িবে, চাকুরি পাওয়ার অসুবিধা থাকিবে না।
দুইজনেই তরুণ, সম্মুখে অনন্ত জীবনের ইশারা। প্রভাতও বেশিক্ষণ নিজের বাস্তববাদী চরিত্র বজায় রাখিতে পারি না। দুইবন্ধুতে অভিযানের বিভিন্ন দিক আলোচনা করিতে করিতে সকাল হইয়া গেল।
০৩. পিকনিক করিতে গিয়া
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পিকনিক করিতে গিয়া কাজল এমন একটি অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হইল যাহা তাহার জীবনে এই প্রথম। মানবমনের এক বিশিষ্ট অনুভূতির সঙ্গে আজ পর্যন্ত তাহার পরিচয় ছিল না, মধ্য পৌষের এক পড়ন্ত অপরাহে সেই আশ্চর্য সুন্দর অনুভূতির ব্যঞ্জনা তাহার হৃদয়ের তীতে জাগিয়া উঠিল।
শেয়ালদহ হইতে ট্রেন ধরিতে হইবে, সকাল সাড়ে-সাতটার মধ্যে সকলের সেখানে একত্র হইবার কথা। একটি ছোট দল রান্নার ঠাকুর এবং অন্যান্য তৈজসপত্রাদি লইয়া আগের দিন চলিয়া গিয়াছে। তাহারা রান্নার কাজ আরম্ভ করিয়া দিবে। পৌঁছাইয়াই চা-টোস্ট-ডিম তৈয়ারি পাওয়া যাইবে আশা করা যায়।
জামাকাপড় পরিয়া রাস্তায় বাহির হইয়া প্রভাত বলিল—আজ একটা মজার ব্যাপার হবে। নরেন্দ্রর পিসতুতো বোন আমাদের সঙ্গে পিকনিকে যাচ্ছে–
—আমাদের সঙ্গে? সে কী! আর কোনোও মেয়ে যাচ্ছে নাকি?
–নাঃ।
কাজল একটু অবাক হইয়া বলিল—তাহলে একা নরেনের বোন ছেলেদের সঙ্গে যাবে?
–হ্যাঁ হে, মিশনারী কলেজে পড়া মেয়ে। দেরাদুন না সিমলা কোথায় যেন থাকে, ছুটিতে বেড়াতে এসেছে। বাঙালি, মধ্যবিত্ত ঘরের ললিত-লবঙ্গলতা নয়, ছেলেদের ভয় পায় না।
কাজল কথা ঘুরাইবার জন্য বলিল—না হয় যাচ্ছেই, তাতে কী হয়েছে?
—কী হয়েছে একটু পরেই বুঝতে পারবে।
তারপর অর্থপূর্ণ হাসিয়া বলিল—একেবারে অগ্নিশিখা, জানো? দুতিনদিন আগে পিকনিকের ব্যাপারে কথা বলতে নরেনের বাড়ি গিয়ে দেখে এলাম। আজ ছেলেমহলে একেবারে হৈ-হৈ পড়ে যাবে
কাজলের একটু কৌতূহল হইলেও সে অন্য কথা পাড়িয়া তখনকার মতো প্রসঙ্গটা চাপা দিল। বলিল—এসো, দু-প্যাকেট সিগারেট কিনে নেওয়া যাক। যেখানে যাচ্ছি সেখানে কাছাকাছি সিগারেট কিনতে পাওয়া যাবে কিনা কে জানে—
গ্লোব নার্সারির সামনে দলটার জড়ো হইবার কথা। কাজল ও প্রভাত নির্দিষ্ট স্থানে আসিয়া দেখিল তখনও আর কেহই পৌঁছায় নাই। তাহারা একটা করিয়া সিগারেট ধরাইয়া অপেক্ষা করিতে লাগিল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই গোপাল আসিল, তাহার একটু বাদেই জগন্ময় ও শরদিন্দু। এক এক করিয়া প্রায় সবাই আসিয়া গেল, ট্রেন ছাড়িতে আর মিনিটদশেক দেরি। কিন্তু নরেন্দ্র আর তাহার মিশনারী কলেজে পড়া পিসতুতো বোন কই? কাজল আড়চোখে একবার প্রভাতের দিকে তাকাইল। প্রভাতও একটু ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। পুরা দলটাকে পিকনিকের জায়গায় পৌঁছাইয়া দেওয়ার ভার তাহারই উপর। সে স্টেশনের বড়ো ঘড়িটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করিয়া বলিল—ওহে, তোমরা সব গিয়ে ট্রেনে উঠে পড়। আমি আর অমিতাভ পাঁচমিনিট দেখে চলে আসছি—জায়গা রেখে আমাদের জন্য।
বন্ধুরা প্ল্যাটফর্মের দিকে চলিয়া গেলে প্রভাত বলিল—নরেনের বোনের যে যাবার কথা আছে সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না এলে খুব মজা হত। কেন যে দেরি করছে—বলিতে বলিতেই প্রভাত সামনে তাকাইয়া কনুই দিয়া কাজলকে ঠেলা দিল। কাজল বলিল—কী?
-ওই যে, এসে গিয়েছে।
স্টেশনের সামনে স্টেটসম্যানের ভ্যান হইতে খবরের কাগজ নামানো ইতেছে। তাহার পাশ দিয়া নরেন্দ্র এবং একটি মেয়ে আসিতেছে বটে। তাহাদের দেখিতে পাইয়া নরেন্দ্র হাত নাড়িল। কাছে আগাইয়া আসিতে প্রভাত বলিল—ব্যাপার কী, এত দেরি? আমরা তো আর মিনিট দুই দেখে চলে যাচ্ছিলাম। চল, চল–