আশ্চর্য অনুভূতিতে তাহার মন ভরিয়া উঠিল। কী বিশাল এই গ্ৰহজগৎ, এই নাক্ষত্রিক বিশ্ব, এই জীবন। অর্থ ও প্রাচুর্যের প্রয়োজন নাই, সাধারণ গৃহস্থের মতো কেবলমাত্র বাঁচিয়া থাকাটাই একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা। কিন্তু মন শক্ত করিতে হইবে, পৃথিবীর তাবৎ প্রলোভনকে উপেক্ষা করিতে শিখিতে হইবে। ঐহিক কামনা লইয়া এই আনন্দের ভেজে যোগ দিবার অধিকার লাভ করা যাইবে না।
বিশ্বের একদিক হইতে অন্যদিক পর্যন্ত আনন্দের তরঙ্গ প্রবাহিত হইতেছে। ক্ষুদ্রতা নাই, বন্দীত্ব নাই—এই বিপুল প্রসারে সৌন্দর্যময় মুক্তির অনুভূতি প্রতিমুহূর্তে স্পন্দিত হইতেছে।
সেদিন প্রায় সমস্ত রাত্রি তাহার ঘুম আসিল না।
শীতের মাঝামাঝি কাজল কলেজের বন্ধুবান্ধবের সহিত কলিকাতা হইতে মাইল ত্রিশেক দূরের একটা বাগানবাড়িতে বনভোজন করিতে গেল। প্রভাত তাহার সহিত রিপনে পড়ে, ছেলেটি ভালো-ইংরাজি কবিতা পড়িতে খুব ভালোবাসে, থাকে পটুয়াটোলা লেনে। সেও বনভোজনে যাইবে। কাজলকে ডাকিয়া সে বলিল–অমিতাভ, পিকনিকের আগের দিন রাত্তিরে তুমি বরং আমার বাড়িতে এসে থাকো, নইলে অত সকালে কি তুমি এসে উঠতে পারবে? ভোববেলাই তো রওনা দিতে হবে—
কাজল রাজি হইয়া আগের রাত্রে প্রভাতের বাড়ি চলিয়া আসিল। বাড়ির মানুষেরা খুব ভালো, বিশেষ করিয়া প্রভাতের বাবা কাজলের সহিত সমবয়েসী বন্ধুর মতো ব্যবহার করিলেন।
একতলার কোণের দিকে প্রভাতের ঘর। এইখানে সে পড়াশুনা করে এবং ঘুমায়। রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সারিয়া দুইবন্ধু খাটে আধশোয়া হইয়া গল্প শুরু করিল। প্রভাতের বাড়ির অন্যরা দোতলায় থাকেন, কাজেই আড্ডায় বাধা পড়িবার ভয় নাই।
প্রভাত বলিল–সিগারেট খাবে? যাই বলো, সিগারেট না হলে আড্ডা জমে না–
—এখানে খাবো? কেউ আসবে না তো?
–দূর। রাত্তিরে আর কেউ নামবে না। তাছাড়া সিঁড়ির মুখের দরজা বন্ধ করে দিয়ে এসেছি। এই নাও, ধরাও–
দুইজনে সিগারেট ধরাইয়া কোলে একটি করিয়া বালিশ লইয়া বসিল।
প্রভাত বলিল—অনেকদিন থেকেই তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো ভাবি, সুযোগ হয়ে ওঠে না। আমাদের ছেলেমানুষির বয়েস কিন্তু ফুরিয়ে এল, ভবিষ্যতে কী করবে কিছু ভেবেছো?
ভবিষ্যতের কথা কাজল কিছু ভাবে নাই। জীবনের যে দিকটায় আলো পড়ে, যে দিকটা জ্ঞানে, বিস্ময়ে এবং আনন্দে উজ্জ্বল, সেই দিকটাকেই সে বড়ো করিয়া দেখিয়াছে। জীবনের অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামের বিষয়ে সে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নাই। সে বলিল–তুমি কি প্রফেশনের কথা বলছো?
—কিছুটা বটে। মানুষকে তো একটা বৃত্তি অবলম্বন করতেই হয়। কেউ কেউ যে কোনো বৃত্তিতেই নিজেকে বেশ খাপ খাইয়ে নিতে পারে, কিন্তু তুমি বোধহয় তা পারবে না। এখন না ভাবলে পরে কষ্ট পাবে–
কাজল বলিল—তুমি যাকে বৃত্তি বলছে তার একটাও আমার কাছে অনারেল বলে মনে হয়। দেখ আমার জীবনটা আমার নিজের, যে ভাবে ভালো লাগে সেভাবে বাঁচার অধিকার আমার থাকা উচিত, তাই না?
প্রভাত সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিল—তোমার কীভাবে বাঁচতে ভালো লাগে?
–আমি বিশুদ্ধ, নির্মল আনন্দ লাভের জন্য বাঁচতে চাই।
—এটা তুমি কিছু নতুন কথা বললে না। আনন্দ হল একধরনের সুখানুভূতি, জীবমাত্রেই সেজন্য বাঁচে।
-সেটা অ্যানিমাল কমফর্ট, আমি সে ধরনের ফিজিক্যাল প্লেজাবের কথা বলছি না। আমি বলছি ইনটেলেকচুয়াল প্লেজারেব কথা—
প্রভাত হাসিয়া বলিল–তুমি একটা হামবাগ, নিজেকেই নিজে ইনটেলেকচুয়াল বলে আঁক করছো?
কাজল লজ্জা পাইয়া বলিল–তুমি বুঝলে না। আমি মোটেও নিজেকে পণ্ডিত বা ওইরকম কিছু বলছি না। আমি বলছি, এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ড আর জীবন সম্বন্ধে আমার মনে কতগুলো স্বাভাবিক প্রশ্ন আছে-সেগুলো সম্বন্ধে ভাবতে বা তাদের উত্তর খুঁজতে আমার ভালো লাগে। এটা হচ্ছে joy of pure learning, প্রফেশনের সঙ্গে এর সম্বন্ধ নেই। তাছাড়া নীরস নলেজ-এর কথা বাদ দাও, বিশ্বের অদ্ভুত সৌন্দর্যের দিকটা ভেবে দেখেছো? কে জানে মৃত্যুর পরে আর চেতনা থাকে কিনা, আবার জন্ম হয় কিনা। আমি যতটা সম্ভব এই জন্মেই দেখে যেতে চাই। দিস মে বি মাই অনলি অপরচুনিটি—
–না খেয়ে?
কাজল অন্য জগতে ছিল। বিস্মিত হইয়া বলিল—আঁ?
–বলছি, সেই জ্ঞান এবং সৌন্দর্য আহরণের কাজটা কি না খেয়ে খালি পেটে করবে? সাবসিসটেন্সের দিকটাও তো ভাবা চাই।
কাজল রাগিয়া বলিল—তুমি বড়ো আনরোম্যান্টিক। বাস্তবের বিরাট বাধা তো আছেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও কি পৃথিবীতে বড় কাজ হয়নি? তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে
-আমি তো এতক্ষণ সেই কথাই বলছি। সেই প্রস্তুত হর কাজটা তোমার কতদূর এগিয়েছে?
কাজল কোনদিকেই কিছুমাত্র অগ্রসর হয় নাই। সে কেবল পড়াশুনা করিয়াছে এবং মাঠে বেড়াইতে গিয়া গাছের নিচে বসিয়া বই পড়িয়াছে। পৃথিবীর সঙ্গে তার পরিচয় পুথির পাতার ভিতর দিয়া।
কাজলকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া প্রভাত হাসিতে হাসিতে বলিল—back to square ‘A’, কেমন? না অমিতাভ, যাই করতে চাও, তার জন্য জীবনটাকে একটু ছকে নেওয়া দরকার। নইলে তোমার মতো ট্যালেন্টেড ছেলে পরে কষ্ট পাবে।
কাজল কোণঠাসা হইয়া বলিল–তুমি কী ঠিক করেছে?
–আমি? আমার সব ঠিক করা আছে। এম.এ. পাশ করে আমি কলেজে পড়ার।
কাজল বলিল—আমি যা হতে চাই তা কী করে হওয়া যায় জানি নে। তুমি অরেল স্টাইনের জীবনী পড়েছে প্রভাত? ইউরোপ থেকে পিকিং অবধি প্রাচীন যুগে যে সিল রুট ছিল, যে পথে মার্কো পোলো তার বিখ্যাত ভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, সেই হারানো সিল বুট নতুন করে খুঁজে বের করার জন্য অরেল স্টাইন প্রায় সারাটা জীবন ব্যয় করেছিলেন। ভাবো তো, মধ্য এশিয়ার সেই গোবি, তাকলামাকান মরুভূমি—পৃথিবীর ছাদ পামির, উত্তর মঙ্গোলিয়ার নিবিড় অরণ্য, কোথাও দিদিশাহীন মরুপ্রান্তরে দুরন্ত বালির ঝড়, কোথাও হাত-পা জমে-যাওয়া কনকনে শীত! সিল রুটের খোজে খোলা প্রান্তরে তাঁবু খাঁটিয়ে থাকা, রাত্তিরে তাঁবুর বাইরে অগ্নিকুণ্ডের পাশে বসে পাইপ খাওয়া-ওঃ! অমন পরিষ্কার আরহাওয়ায় কত নক্ষত্র দেখা যায় জানো? আমি ওইরকম জীবন চাই।