–বেঁচে ছিল?
-না দাদাবাবু, মরে কাঠ। শরীলে কোনো দাগ নেই, ঘা নেই–শুধু এমনি এমনি প্রাণটা বেরিয়ে গিয়েছে—
কাজল বলিল–সাপেও তো কামড়ে থাকতে পারে?
-সাপে কামড়ালে শরীলে তার দাগ থাকবে তো? তাছাড়া সাপে কাটলে মানুষ সঙ্গে সঙ্গে মরে যায় না। তেমন হলে গামছার বাঁধন দিয়ে বাড়ি পৌঁছে যেত হারাধন।
শরীরটা যখন খায় না, তাহলে খামোকা কালামনিষ মানুষ ধরে কেন? তার পেটই বা ভরে কীভাবে?
লোকটা দাঁড় টানা বন্ধ করিয়া বলিল—কালামনিষ মাংস খায় না, রক্ত খায়। হারাধনের দেহটা ফ্যাকাসে মেরে গিয়েছিল।
বেলাশেষের আকাশ দিগন্ত প্রসারী বিলের ওপর ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। বহুদূরে একটি গ্রামের সীমারেখা দেখা যায়। প্রান্তরের উপর আসন্ন সন্ধ্যায় হাল্কা কুয়াশা জমা হইতেছে। কোথা হইতে একটা পাখি ডাকিয়া উঠিল—ট্টি-টি-ট্টি–
হারাধন সম্ভবত বজ্রাহত হইয়া মারা পড়িয়াছিল, ঝড়বৃষ্টির সময় খোলা মাঠে জলের মধ্যে দাঁড়াইয়া থাকিলে যা হয়। কিন্তু এই সরল মানুষটিকে বিজ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়াইয়া লাভ নাই। ইহার সরল জীবনযাত্রা, সামান্য দুই-একটা অপ্রাকৃতে বিশ্বাস ইহার জীবনকে সরস ও অর্থপূর্ণ করিয়াছে। যুগান্তের চর্চায় সঞ্চিত সেই জীবনদৃষ্টিকে আধুনিক বিজ্ঞানের আঘাতে ধ্বংস করিয়া তাহার বদলে কোন্ নতুন মূল্যবোধ সে ইহার হাতে তুলিয়া দিবে? না, কালামনিষই ভালো!
মুখে বিশ্বাস, ভয় এবং সম্ভ্রম একসঙ্গে ফুটাইবার চেষ্টা করিতে করিতে কাজল বলিল–সত্যি, এ ঘটনা শোনবার পরে আর অবিশ্বাস থাকে না বটে। তুমি অনেক কিছু দেখেছে, না? আমি মাঝে মাঝে এসে তোমার গল্প শুনে যাব।
প্রাজ্ঞতার অভিমানে লোকটি একখানা বিড়ি ধরাইল।
বিলের প্রায় অপর প্রান্তে জল শেষ হইয়া চাষের ক্ষেত শুরু হইয়াছে। সংকীর্ণ একটি নালা দিয়া বিলের জল বাহির হইয়া চাষের জমিতে পড়িবার ব্যবস্থা করা আছে। নালার মুখে বেতের একটি বাক্সমতো বসানো, জল তাহার মধ্য দিয়া প্রবাহিত হয়। লোকটি জলের মধ্যে হাত দিয়া ঘোট আর মাঝারি আকারের কয়েকটি মাছ সেই বাক্সের ভিতর হইতে বাহির করিয়া মেটে কলসীতে পুরিল।
আবার এপারে ফেরা। বিলের ধারে ধারে অগভীর জলকাদার মধ্যে লম্বা লম্বা ঘাস জন্মাইয়াছে। অনেক দূরে মাঠের উপর দিয়া সাদারঙের কয়েকটা গরু সন্ধ্যার আভাস পাইয়া বাড়ির দিকে ফিরিতেছে। জলের উপর দাঁড়ের ছপছপ শব্দ। পশ্চিম আকাশে মেঘের স্তূপে যেন অগ্নিকাণ্ডের প্রতিচ্ছবি পড়িয়াছে। কাজলের মনে হইল—When barred clouds bloom the soft-dying day এখানে সময়ের আলাদা কোন মূল্য নাই, মহাকাল এখানে মানুষের নির্মিত মানযন্ত্র দ্বারা কৃত্রিমভাবে খণ্ডিত নয়। আকাশের নিচে শুইয়া থাকা এই বিস্তীর্ণ প্রান্তরে, এই বিলের প্রসারে, দূরের ওই আরছা-দেখিতে-পাওয়া গ্রামে দ্রুতগতিতে ধাবমান কাল লেনও প্রভাব ফেলিতে পারে নাই। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া শান্তভাবে দিন আসে যায়, বিলের ধারে জলজ ঘাসের সারি বাড়িয়া ওঠে—আবার ঋতুর অন্তে শুষ্ক হইয়া ঝরিয়া পড়িয়া যায়। নদী দিপরিবর্তন করে, উদ্ধত রাজচক্রবর্তীর বিজয়স্বপ্ন শরতের মেঘের মতো কোথাও কিছুমাত্র চিহ্ন না রাখিয়া মিলাইয়া যায়কেবল সরল, পরিশ্রমশীল সাধারণ মানুষের কালজয়ী জীবনপ্রবাহ সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করিয়া শাশ্বতধারায় বহিতে থাকে। সাক্ষী থাকে কেবল আকাশের নক্ষত্রেরা।
বিলের এপারে আসিয়া নামিতে নামিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। কাজল জিজ্ঞাসা করিল–-তোমার নাম কী ভাই? সেটাই তো জানা হল না—
লোকটি বলিল—আমার নাম কানাই। কানাই জেলে বললে, এখানে সবাই চিনবে।
-আমি কিন্তু সময় পেলেই আসব তোমার কাছে। গল্প শুনব।
কানাই জেলে গল্প বলিতে পারে বটে, কিন্তু ব্যক্তিগত সংলাপ খুব বেশিক্ষণ চালাইবার ব্যাপারে তাহার পারদর্শিতা নাই। সে সংক্ষেপে বলিল—আসবেন।
কাজল পেছন ফিরিয়া কয়েক পা চলিয়া আসিয়াছে, কানাই জেলে পিছন হইতে ডাকিল দাদাবাবু, ও দাদাবাবু!
কাজল তাকাইয়া দেখিল কানাই কী একটা হাতে লইয়া তাহার দিকে আগাইয়া আসিতেছে। সে বলিল—কী হয়েছে কানাই? কিছু বলবে?
তাহার হাতে কচুপাতায় জড়ানো একখানি আন্দাজ দেড়পোয়া ওজনের শালমাছ দিয়া কানাই বলিল–নিয়ে যান, রান্না করে খাবেন–
সরল মানুষটির আর কিছু নাই। প্রথম পরিচয়ের নিদর্শনস্বরুপ তাই সে তাহার সারাদিনের পরিশ্রমের কিছু অংশ কাজলকে দিল।
০২. অপুর বইগুলি বিক্রি হইতেছে
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
অপুর বইগুলি বিক্রি হইতেছে মন্দ না। সব বইয়ের একাধিক সংস্করণ হইয়া গিয়াছে, দু-একখানার তো পঞ্চম মুদ্রণ চলিতেছে। মোট বিক্রয়ের দিক হইতে দেখিলে অবশ্য এমন কিছু একটা হৈ-হৈ ব্যাপার নয়—কারণ বাজার-চলতি অনেক সস্তা নাটক-নভেল বা গোয়েন্দাকাহিনী ইহা অপেক্ষা বেশি বিক্রি হইয়া থাকে কিন্তু নতুন একজন লেখকের আত্মপ্রকাশ করিবার সঙ্গে সঙ্গে এমন বাজার পাওয়া একটু অদ্ভুত ব্যাপার বইকি। পৃথিবীর মহৎ উপন্যাসগুলির পটভূমি কাজল পড়িয়া দেখিয়াছে—অজস্র প্রকাশক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হইবার পর কোনও ক্ষুদ্র সংস্থা অনাদরে ছাপিয়াছে। লেখকের জীবদ্দশাতে হয়তো প্রথম সংস্করণই শেষ হয় নাই। পঞ্চাশ বৎসর পরে সেই বই লইয়া সবাব কী মাতামাতি। কিন্তু সমস্তটা যাহার সাধনার ফল, সেই লেখক ততদিনে দারিদ্র্যে ভুগিয়া অনাহারে কষ্ট পাইয়া মারা পড়িয়াছে। তখন আর তাহার স্মৃতিতে প্রতিবছর সভা করিলে বা রাস্তার মোড়ে একশত ফিট উচ্চ স্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করিলে সে বেচারার কী লাভ? কাজল হারম্যান মেলভিল-এর জীবনী পড়িয়া দেখিয়াছে, মেলভিলের ঠিক এরূপ হইয়াছিল। মবি ডিক মেলভিলের জীবৎকালে মাত্র তিন-চারশত কপি ক্রিয় হয়, চরম দারিদ্র্য এবং কষ্টের ভিতর লেখক মারা যান। সরকারের সৎকার সমিতি আসিয়া তার দেহ সমাধিস্থ করিবার ব্যবস্থা করে। অনেকদিন পরে যখন সবাই মবি ডিক-কে পৃথিবীর দশটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম বলিয়া মত দিল, প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ কপি বই বিক্রি হইতে লাগিল, তখন মেলভিলের সমাধিতে মালা দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া ভক্তেরা আবিষ্কার করিল–সমাধিটাই খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না! কবর দিবার সময়ে সরকারি লোকেরা তো আর ভাবে নাই যে, একদিন এই ভিখারিটা বিখ্যাত লোক হইবে! তাহারা মেলভিলের নামটা পর্যন্ত সমাধিস্তরে লিখিয়া রাখে নাই।