ওই বসন্তের রৌদ্র, ওই প্রস্ফুটিত আম্রমুকুলের সৌরভ আরও যেন কত কী কথা মনে আনিয়া দিয়াছিল। কবেকার হারাইয়া যাওযা হাসিকান্না এবং জীবনযাপনের ইতিহাস—এই জন্মের কয়েকটা বৎসর মাত্র নয়, অতীত ও বর্তমানের সীমারেখার ঊর্ধ্বে কোন নিত্য আনন্দের রাজ্যে যে শাশ্বত জীবনপ্রবাহ চিরবহমান, সেদিনের আমের বউলের মাদকতাময় গন্ধ সেই দৈবী জীবনের স্পর্শ এক খণ্ডমুহূর্তের জন্য বহন করিয়া আনিয়াছিল।
তার পর হইতে কাজল মাঝে মাঝে এখানে বেড়াইতে আসে। নির্জন স্থান আরও আছে, কিন্তু দিগন্তপ্রসারী বিলের ধারে পিটুলি ফলের গাছের নিচে তাহার প্রিয় জায়গাটিতে বসিলেই চোখে কে যেন স্বপ্নের তুলি বুলাইয়া দেয়। অন্য স্থানে সহসা এমন হয় না। জায়গাটার গুণ আছে মানিতেই হইবে।
বিলের ধারে পৌঁছাইতে বৈকাল সাড়ে তিনটা বাজি গেল। এ বৎসর প্রায় কালীপূজা পর্যন্ত বেশ ভালোরকম বৃষ্টি হইয়াছে। ফলে অন্যান্য বৎসবেব মতো হেমন্তের শেষে বিল শুকাইয়া যায় নাই, এখানে-ওখানে জল বাধিয়া আছে। পিটুলি গাছের তলায় যেখানে সে বসে তাহার কাছেই হাঁটুসমান জল ও কাদার মধ্যে দাঁড়াইয়া একটা লোক লম্বামতো অর্ধমগ্ন কী জিনিস লইযা ভযানক ধস্তাধস্তি করিতেছে। ব্যাপার কী দেখিবার জন্য কাজল তাহার কাছে গিযা দাঁড়াইল।
রহস্যময় প্রচেষ্টায় সাময়িক ক্ষান্তি দিয়া লোকটা সোজা হইয়া কোমরে জড়ানো গামছা খুলিয়া কপালের ঘাম মুছিতে লাগিল। কাজল বলিল—কী করছছা ভাই? ওটা কি জলের মধ্যে?
লোকটা মুখ তুলিয়া কাজলকে দেখিল—এবং কিছুমাল বিস্মিত হইল না। কাজল কে, কোথা হইতে আসিয়া এই মাঠের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে, সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র ঔৎসুক্য প্রকাশ না করিয়া এমন সহজ স্বরে কথা বলিতে আরম্ভ করিল যে, শুনিলে মনে হইতে পারে গত একঘণ্টা ধরিয়া সে কাজলের সহিত তাহার সমস্যার বিষয়ে গভীর আলোচনা করিতেছে।
–আর বলেন কেন দাদাবাবু! রোজই তো সাবধান করি, করি না? তবু এমন বজ্জাতি করলে ঠাণ্ডা মানুষের মাথায় রক্ত ওঠে কিনা আপনিই বলেন? বলি, পয়সা দিয়া কেনা জিনিস তো-নাকি মাগনার? আপনার কাছে আর মিথ্যে বলি কেন, গণেশ ছুতোর,এখনও তিন গণ্ডা টাকা পাবে এর দরুন। পইপই করে বারণ করি রোজ, রোজ তবু সেই একই কাণ্ড!
কাজল মাথা চুলকাইয়া বলিল—কিন্তু জলের মধ্যে ওটা কী?
-নৌকো দাদাবাবু, নৌকো। বিলের ভেতর মাছ ধরে র্যা দু-পয়সা পাই তাতে কষ্টেস্ৰেষ্টে সংসার চলে, আর গরমেন্টের রাস্তার ধারে নতুন গাঁয়ের ছেলেগুলো রোজ করবে কি, নৌকোখানা ডুবিয়ে রেখে যাবে! একবার ধরতে পারলে ঠেঙিয়ে বেন্দাবন দেখিয়ে দেব
কোমরে গামছা জড়াইয়া লোকটা আবার কিছুক্ষণের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় জলমগ্ন নৌকাটি সোজা করিয়া ভাসাইয়া তুলিল। জিনিসটাকে নৌকা বলিলেও চলে, ডিঙি বলিলেও মিথ্যা বলা হয় না। পাড়ে রাখা হোট হাতজাল, দুই-তিনটা মেটে কলসী আর একখানা দাঁড় গুছাইয়া লইয়া লোকটা নৌকায় গিয়া উঠিল। দাঁড়ের ধাক্কায় সে পাড় হইতে দূরে সরিয়া যাইবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় কাজল বলিল–আমি উঠব তোমার নৌকোয়? নেবে আমায়?
লোকটার শরীরে কৌতূহল বলিয়া জিনিস নাই। কাজল কে, কেনই বা সে নৌকায় সঙ্গী হইতে চাহিতেছে এসব কালক্ষেপকারী অকারণ প্রশ্ন না তুলিয়া সে সহজ গলায় বলিল—উঠবেন? উঠে পড়ন তাহলে–
–উলটে যাবে না তো?
গণেশ ছুতাবের তৈয়ারি এই অপূর্ব শিল্পকীর্তি সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করাতে লোকটা কিঞ্চিৎ চটিয়া গেল। বলিল—ডুবে যাবে জানলে কী উঠতে বলতাম?
আর বাক্যব্যয় না করিয়া কাজল সন্তর্পণে নৌকায় উঠিয়া পড়িল। নৌকা বিপজ্জনকভাবে দুইদিকে কয়েকবার দুলিয়া আবার সমান হইল বটে, কিন্তু কাজল দেখিল গৌরবার্থে নৌকা বলিয়া প্রচারিত এই সংকীর্ণ ডিঙিতে দাঁড়াইয়া থাকা সম্ভব নয়। সে সাবধানে উবু হইয়া বসিয়া দুইদিকের কানার কাঠ চাপিয়া ধরিল। লোকটা তাহা দেখিয়া বলিল—কী, ভয় করছে বুঝি?
কাজল হাসিয়া বলিল—না, ভয় করবে কেন? তবে অভ্যেস নেই তো, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না!
তারপর জলের দিকে তাকাইয়া বলিল—অবশ্য পড়ে গেলেই বা কী? এখানে জল বোধহয় এক কোমরও হবে না, তাই না? আমি শীতকালে এসে শুকনো মাঠ দেখে গিয়েছি।
—জল কম, কিন্তু কাদা বেশি। পড়লে থকথকে কাদায় গেঁথে যাবে বুক অবধি। তাছাড়া এ বিল বড়ো খারাপ জায়গা, এখানে জলের নিচে কালামনিষ আছে—
কাজল অবাক হইয়া বলিল–কালামনিষ আবার কী?
–তা জানিনে। তাকে তো কেউ দেখতে পায় না। কেবল জলে পড়ে গেলে, কিংবা নৌকো থেকে পা ঝুলিয়ে বসলে কালামনিষ সাঁই করে জলের নিচে টেনে নেয়।
কাজল বলিল–বিলের এটুকু জল তো আর ক-দিনের মধ্যেই শুকিয়ে যাবে, তখন কালামনিষকে দেখতে পাওয়া যাবে না?
লোকটা একবার চোখে কাজলের দিকে তাকাইল, তারপর বলিল—না, জল শুকোনোর আগেই কালামনিষ মাটির তলায় চলে যায়। একবচ্ছর মাটির নিচে ঘুমোবার পর নতুন বর্ষার জল পেলেই তার ঘুম ভাঙে। সেজন্য প্রথম বর্ষার সময়টা বড্ড খারাপ দাদাবাবু কালামনিষের পেটে তখন দারুণ খিদে, বছরভোর খায়নি কিনা। নির্জন বিলের মধ্যে একা পেলেই হল, সে মানুষকে আর ফিরতে হচ্ছে না।
-তোমার পরিচিত কাউকে কখনও কালামনিষ ধরেনি?
–ধরেনি আবার! এই তো তিনবছর আগেকার কথা, আষাঢ়ের শেষ, বুঝলেন? চার-পাঁচদিন ধরে উপুরঝান্ত বিষ্টি হচ্ছে, দুপুরবেলা মেঘে সন্ধের মতো অন্ধকার। আর কী বাজ পড়া! গড়ম গুড়ম আওয়াজে কানে তালা লেগে যায়! শোঁ শো করে ভেজা বাতাস বইছে সারাদিন। এর মধ্যে দুপুরে কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তাভাত খেয়ে আমাদের গ্রামের নবীন হালদারের ছেলে হারাধন খ্যাপলা জাল আর পোলো নিয়ে বিলে গেল মাছ ধরতে। তার ঠাকুরমা বারণ করেছিল-হারু, এই দুজোগে বেরুস না মানিক আমার! তা দাদাবাবু, হারাধনকে তখন কালে ধরেছে, সে ভালো কথা কানে তুলবে কেন? তারপর দুপুর যায়, বিকেল যায়, হারাধন আর ফেরে না। তার ঠাকুরমা কান্নাকাটি শুরু করাতে গ্রামের লোকজন দল বেঁধে খুঁজতে বেরিয়ে বিলের ওপারে হারাধনের দেহ দেখতে পায়। কাদাজলের ভেতর মুখ-গুজড়ে পড়ে ছিল, পোলোটা পাশে পড়ে, কিন্তু খ্যাপলা জালখানা আর পাওয়া যায়নি।