—তাও আছে। তবে প্যাঁচা তো দিনে বেরোয় না। ফেরার সময় সন্ধে হয়ে গেলে দেখা যাবে হয়তো। তুই প্যাঁচা দেখেছিস?
–হুঁ। মা দেখিয়েছে।
–মা! তোর মা প্যাঁচা পেল কোথায়?
—ছবির বইতে। দু রকম প্যাঁচা আছে, ভূতুম প্যাঁচা আর লক্ষ্মী প্যাঁচা।
–আচ্ছা দেখি, আজ তোকে জ্যান্ত প্যাঁচা দেখানো যায় কি না।
প্রথম বাসায় বড়ো ভিড়। ছেলের কষ্ট হইবে ভাবিয়া সেটা ছাড়িয়া দিল। পরের বাস আসিল মিনিট দশেক পরেই। এটায় তত ভিড় নাই। এমন কী উঠিবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দু জন লোক নামিয়া যাওয়ায় কাজল ছেলেকে লইয়া বসিবার জায়গাও পাইয়া গেল।
অনেক, অনেকদিন পরে আবার সে এই পথে বেড়াইতে যাইতেছে। প্রথম যৌবনের সেই আশ্চর্য জীবনানুভূতি, রোভরা দুপুর, সামনে বিস্তৃত না-দেখা সমগ্র জীবনটা, সমস্ত আবার মনে পড়িয়া যায়। ছেলেকে সে এই বিস্তারের মধ্যে মুক্তি দিয়া যাইবে। এইভাবেই উত্তরাধিকারের হস্তান্তর।
বাসের দরজায় দাঁড়ানো সহিসটা হাঁকিল-মোহনপুর, মোহনপুর মোড়!
কাজল বলিল—খোকা, এরপরেই আমরা নামব। চল, এগুই—
পরের স্টপেই সহিস চেঁচাইল-কাঁঠালিয়া! কাঁঠালিয়া!
নামিতে গিয়া কাজল অবাক হইয়া থামিয়া গেল।
কাঁঠালিয়া গ্রামটা কোথায় গেল? মাঠ, বাঁশবন আর ধানক্ষেত? এ তো দেখা যাইতেছে চারদিকেই নিবিড় বসতি, গায়ে গায়ে লাগা বাড়ি, ইটের পয়েন্টিং করা বাঁধানো রাস্তা পাড়ার মধ্যে ঢুকিয়া গিয়াছে। রীতিমত শহর জমিয়া উঠিবার উপক্রম। একজন আধুনিক চেহারার যুবক আবার একটা বিলাতি কুকুর চেনে বাঁধিয়া বেড়াইতেছে। কলিকাতা হইতে আর বাকি কী?
পেছন হইতে কে বলিল—দাদা, না নামলে সরে দাঁড়ান, দরজা আটকাবেন না—
ছেলেকে লইয়া কাজল সরিয়া আসিল।
সপ্তর্ষি বলিল–নামলে না যে বাবা?
-হ্যাঁ, ইয়ে—আমরা একটু গাছপালা আছে এমন জায়গায় নামব। এখানে খালি বাড়িঘর—
–তুমি যে বলেছিলে কাঁঠালিয়ায় গাছপালা আর মাঠ আছে?
কাজল ইতস্তত করিয়া বলিল—ছিল তো। একটু এগিয়ে পাওয়া যাবে এখন। দেখা যাক—
পরের দুইটা স্টপেও নামা গেল না। শিউলি, তেলিনিপাড়া চলিয়া গেল। কোথায় নামিবে সে? সভ্যতার অগ্রগতির প্রতীক হিসাবে জনপদ প্রসারিত হইয়াছে। এখানে বসিবার মতো ঘাস নাই, দেখিবার মতো দিগন্ত নাই, ভাবিবার মতো সময় নাই। পুত্রকে লইয়া সে এখন কোথায় যায়?
দেবপুকুরে গিয়া কাজল বাস হইতে নামিল। এখানে রাস্তার ধারে এখনও মাঠ, ঝোপজঙ্গল। দেবপুকুরে সে আগেও আসিয়াছে। তখন এসব জায়গা অজ পাড়াগাঁ ছিল। এখন দুই-একটা বাড়ি উঠিতে শুরু করিয়াছে। এখানেও শহর গ্রামকে স্পর্শ করিল বলিয়া। কাজল মনকে প্রবোধ দিবার চেষ্টা করিল—ভালোই তো, দেশের উন্নতি হইতেছে, ভালোই তো। কিন্তু মনের নিভৃতে গোপন কান্না বাজিতে থাকে। পরিচিত, প্রিয় সবকিছু হারাইবার কান্না।
তাহার হাত ছাড়াইয়া সপ্তর্ষি মাঠের মধ্যে দৌড়াইয়া বেড়াইতেছে। পড়ন্ত বৌদ্রে পৃথিবী মায়াময়। সে আর কিছু চায় না, শুধু এই পৃথিবীর মাটিতে মাটি হইয়া মিশিয়া থাকিতে চায়। গাছের গুড়িতে হেলান দিয়া দুরে তাকাইয়া দেখিতে চায় কীভাবে সন্ধ্যা নামে, আকাশে প্রথম তারাটি ফুটিয়া ওঠে, পাখির ডানায় দিনের আলো মুছিয়া যায়। মাটিতে কান পাতিয়া সে চলমান জগতের স্পন্দন শুনিতে চায়।
তারপর একদিন আসিবে, আসিবেই, যখন সে এই মাটিতে, আলো আর বাতাসে নিঃশেষে মিশিয়া যাইবে। আর সে ঘুম হইতে উঠিবে না, কুলের অম্বল দিয়া ভাত মাখিয়া খাইবে না, প্রিয় বইয়ের সন্ধানে পুরোনো বইয়ের দোকানে ঘুরিয়া বেড়াইবে না।
অনেক বই না-পড়া থাকিয়া যাইবে, অনেক লেখা বাকি থাকিবে।
তবু সে তো চেষ্টা করিল। সে ফাঁকি দেয় নাই, নিজের বিশ্বাসের কথা, মানুষকে ভালোবাসিবার কথা, ব্রহ্মাণ্ডের প্রতি কণার মধ্য দিয়া বহমান বিশ্বসংগীতের কথা লিখিয়াছে। মানুষ নেয় ভালো, নহিলে সে আর কী করিবে?
আলের পথ দিয়া একজন হাঁটিয়া আসিতেছিল। সাধারণ গ্রামের মানুষ। কাজলকে দেখিয়া সে বলিল–বাবু কী করছেন এখানে? জমি কিনবেন নাকি?
-না, এমনি একটু ছেলেকে নিয়ে বেড়াতে এসেছি—
—ও, ওই যে খোকাটা, ওটা বুঝি আপনার?
-হ্যাঁ ভাই। আচ্ছা, আমি জমি কিনতে এসেছি মনে হল কেন তোমার? জমি বিক্রি হচ্ছে বুঝি খুব?
লোকটি সোসাহে বলিল—নয় তো কী! আর একবছরের মধ্যে এতটুকু জমি আর পড়ে থাকবে না বাবু। দেখেছেন তো কাঠালিয়া মোহনপুরের অবস্থা? সব বিক্কিরি হয়ে গেল বলে। রোজ দলে দলে লোক আসছে–
আঞ্চলিক উন্নতিতে তৃপ্ত মানুষটি আলপথ ধরিয়া চলিয়া গেল।
সারাটা বিকেল ছেলের সঙ্গে মাঠে মাঠে খেলিয়া বেড়াইল কাজল। দেখিল শেয়ালকাঁটার ফুলে হলুদ প্রজাপতি আসিয়া বসিতেছে। ঘাসের ডগা হইতে উড়িয়া যাইতেছে ফড়িং।
যখন আলো কমিয়া আসিল, সন্ধ্যা নামিবার উপক্রম হইল, কাজল ছেলেকে ডাকিয়া বলিলচলো বাবা, এইবার বাড়ি যাই–
নক্ষত্ৰভরা আকাশের নিচে ছেলের হাত ধরিয়া বাসরাস্তার দিকে হাঁটিয়া ফিরিতে ফিরিতে কাজল বলিল–বাবাই, তোকে একটা কথা বলব। এখন হয়তো যা বলব তার মানে বুঝতে পারবি না, কিন্তু ভালো কবে শুনে রাখ। বড়ো হয়ে তোকে একটা কাজ করতে হবে–
সপ্তর্ষি বাবার গলার স্বরে অবাক হইয়া বলিল—কী বাবা?
কাজল হাঁটু গাড়িয়া ছেলের সামনে বসিল, ছেলের দুই কাঁধে হাত রাখিয়া বলিল—তোর ঠাকুরদা বই লিখতেন জানিস তো?
–হুঁ-। দাদু লেখক ছিলেন।
-হ্যাঁ বাবা! দাদুর প্রথম বইটার দ্বিতীয় পর্ব আমি লিখেছি। দাদু যেখানে শেষ করেছিলেন সেখান থেকে আমি শুরু করেছিলাম। এটা আমাদের পরিবারের গল্প, মানুষের গল্প। এই বইখানার তিন নম্বর পর্ব তুই লিখবি। কেমন? আমি যেখানে শেষ করেছি সেখান থেকে ধরবি। মনে থাকবে?