বিসর্জনের বাজনা বাজিতে শুরু করিয়াছে, কাজল জানে। জন্মের পরে উজ্জ্বলভাবে বহুদিন জ্বলিয়া একটা নক্ষত্র যেমন ক্ৰমে ম্লান আর হলুদ হইয়া আসে, তেমনি মানুষের জীবনও। স্রোতে এবার ভাটার টান। সবাই মিলিয়া আনন্দ করিয়া বাঁচিবার দিনগুলি ফুরাইয়া আসিল। এখনও আনন্দ থাকিবে, জীবন থাকিবে, চারদিকে পৃথিবী তেমন করিয়াই চলিতে থাকিবে, কিন্তু তেমন করিয়া আর সকাল হইবে না, কী যেন একটা থাকিবে না। মা চলিয়া গেলে তাহার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্ব শেষ হইয়া যাইবে। কে আর বাবার গল্প শোনাইবে, কালো মেঘ ঘনাইলে দেখিবার জন্য ডাকিয়া আকুল হইবে।
পৃথিবী কত বদলাইয়া গেল। এমন সে কখনও দেখে নাই। মানুষ হাসে কম, ভালোবাসে কম। হাসিলে তাহার অনেকরকম অর্থ হয়, ভালোবাসিলে তাহার পেছনে অনেক কারণ থাকে। কাহারও আড্ডা দিবার সময় নাই, দু দণ্ড শান্ত হইয়া বসিয়া মানবিক গল্প করিবার সময় নাই। প্রত্যেকে আখের গুছাইবার জন্য ব্যস্ত। প্রত্যেকেই টাকা জমাইতেছে, বাড়ি করিতেছে, ছেলেকে ডাক্তার আর ইঞ্জিনীয়ার করিতেছে। এমনভাবে আর কিছুদিন চলিলে দেশে আর শিক্ষক, কবি, দার্শনিক কিংবা শিল্পী থাকিবে না। একটা জাতি একেবারে মরিয়া যাইবে।
তাহার সন্তানদের সে এ কোথায় আনিল? এ কোন উপলব্ধিহীন, মননহীন, অসুস্থ ঘোলাটে আলোয় স্তিমিত পৃথিবীতে সে তাহাদের রাখিয়া যাইবে?
পিতার কর্তব্য সন্তানকে প্রকৃত আনন্দ লাভ কবিবার পথের সন্ধান দিয়া যাওয়া। যুগ যতই পরিবর্তিত হোক, শৈশবে পিতামাতার কাছ হইতে লাভ করা শিক্ষা বুকের মধ্যে থাকিয়া যাইবে। ছোট ছেলে এখনও খুবই ছোট, কাজল সপ্তর্ষিকে মনের মতো করিয়া গড়িবার চেষ্টা লাগিয়া পড়িল।
সকালবেলা সে ছেলেকে লইয়া শিশিরভেজা ঘাসের ওপর হাঁটে, উবু হইয়া বসিয়া ঘাসফুল দেখায়। নিজের ছোটবেলার গল্প শোনায়, ঠাকুরদার কথা বলে। মাঝে মাঝে ছেলে আর হাঁটিতে চায় না, দুই হাত উঁচু করিয়া বাবার দিকে তাকাইয়া দাঁড়াইয়া থাকে। কাজল তখন ছেলেকে কোলে নেয়। সপ্তর্ষি বাবার গালে গাল ঠেকাইয়া অবাক চোখে সব কিছু দেখে। ওই একটা পাখি আসিয়া গাছেব ডালে বসিল। ওই একটা বাছুর কোথা হইতে আসিয়া মাঠের মধ্যে খুব খানিকটা দৌড়াইয়া বেড়াইল। বাবার বুকের গরমে থাকা কী আরামের। বাবা কী একটা গান গুনগুন করিয়া গাহিতেছে। বেশ সুন্দর গানটা।
তুলি তাহার জীবনকে ধন্য করিয়াছে। সুন্দরী স্ত্রী অনেকেরই থাকে, সুন্দর স্বভাবের মেয়েও পৃথিবীতে বিরল নয়। কিন্তু তুলি অনন্যা, জগতে একমাত্র। জীবন সুন্দর, কারণ সে জীবনে তুলি আছে।
কেন যেন ফেলিয়া আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ে, অনেকদিন যাহাদের দেখে নাই তাহাদের কথা মনে পড়ে। ভবঘুরে মামা প্রণব কোথায় চলিয়া গিয়াছে কে জানে। রামদাস কাকা বোধহয় আর বাঁচিয়া নাই, বাঁচিয়া থাকিলে একবার অবশ্যই আসিত। ব্যোমকেশ নিজের গ্রামে বিবাহ করিয়া শেকড় গাড়িয়া বসিয়াছে। মা অসুস্থ, খুবই অসুস্থ। হয়তো আর উঠিবে না। থাকিবার মধ্যে আছে আকাশ, বাতাস, প্রান্তর, গাছপালা। অনেকদিন আখের আলির খবর লওয়া হয় নাই। কেমন আছে মানুষটা? একবার গেলে মন্দ হয় না।
সেই বাঁশবন, বরতি বিল, দিগন্তস্পশী প্রান্তর-সন্ধ্যার আসন্ন অন্ধকারে বাঁশবনের মাথা হইতে আকাশে শয়তান উড়িয়া যায়, তাহাদের মুখ দিয়া আগুনের শিখা বাহির হয়, আখের আলি গল্প করিয়াছিল। কেমন আছে আখেরের বৌ রাবেয়া? এতদিন কেন তাহাদের কথা মনে পড়ে নাই? কিন্তু মনে পড়িতেই বুঝিতে পারিল ওই মুক্ত প্রকৃতির প্রসারেই তাহার অস্তিত্বের আসল সার্থকতা লুকাইয়া আছে। খ্যাতিতে বা অর্থে নয়, সভা-সমিতি কিংবা সামাজিক প্রতিষ্ঠায় নয়। মাঠের পারে অলৌকিক সূর্যাস্তের সৌন্দর্যে মহাজীবনের যে সংবাদ আলোর সংকেতে ফুটিয়া ওঠে, সঠিকভাবে তাহা পাঠ করিতে পারার আনন্দই জীবনের শ্রেষ্ঠ আনন্দ।
বাতাসে মাটির গন্ধ বহিয়া আসে। শুষ্ক খড়ের গন্ধ, জলের শব্দ, পাখির ডাক। মাঝখানের দশবারোটা বছর মুছিয়া যায়, আশা-আকাঙ্খায় উদগ্রীব অল্প বয়সের জীবনটা আবার ফিরিয়া আসে। অনেক দেরি হইয়াছে, আর নয়। কালই সে যাইবে, ছেলেকে লইয়া।
পরের দিন দুপুর গড়াইয়া গেলে কাজল ছেলেকে লইয়া বাহির হইল। রাস্তায় বেশ লোকের ভিড়, অনেক গাড়িঘোড়া চলিতেছে। আজকাল সারাদিনই বহু লোক বিভিন্ন কাজে কোথা হইতে কোথায় যাতায়াত করে। এত ব্যস্ততা কীসের? কাহারও এতটুকু সময় নাই। সকলেই জীবনযাত্রার মান আর একটু বাড়াইয়া লইবার জন্য দিশাহীন ছুট লাগাইয়াছে। ডায়োজিনিসের কথা মনে পড়ে। সামান্য ডালসিদ্ধ খাইয়া সারাদিন পড়াশুনা করিতেন। শিষ্যদেব উপদেশ দিতেন। স্টোইক দর্শনের মূল কথাটাই মানুষ ভুলিয়া গেল। বিশাল বাড়ি, দামি পোশাক, সুখাদ্যের দীর্ঘ তালিকা, ক্ষমতার মাদকতা—সব হইতেছে, কিন্তু জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা কীসে পূর্ণ হইবে?
বাবার সঙ্গে বাহির হইতে পাইয়া সপ্তর্ষি খুব খুশি। সে বলিল—আমরা কোথায় যাব বাবা?
–চল না, দেখবি এখন। আমার অল্পবয়েসে যেখানে বেড়াতে যেতাম, সেখানে নিয়ে যাব। দেখবি কত পাখি, বড়ো বড়ো মাঠ, বাঁশবন। তুই ফিঙে পাখি দেখেছিস? মাছরাঙা?
-হুঁউ-উ। মা চিনিয়ে দিয়েছে। যেখানে যাচ্ছি সেখানে ফিঙে আছে?
—আছে তো। তালচড়াই আছে, দোয়েল ছাতারে বসন্তবৌরি আছে—
সপ্তর্ষি বলিল—প্যাঁচা নেই?