কত–কতদিন হইয়া গেল তারপর। সে পাখি আর বাঁচিয়া নাই।
পথের ধারে ফুটিয়া থাকা হলুদ রঙের বুনোফুল তুলিয়া স্বামী তাহার চুলে পরাইয়া দিয়াছিল। পর্বতসানুর অরণ্যে জ্যোৎস্নারাত্রে দাঁড়াইয়া তাহাকে বলিযাছিল—শক্তিমতী হও, এই বিশ্ব, এই প্রকৃতির প্রসাদ তোমার অন্তরে নেমে আসুক। স্রষ্টাকে জানো, আদিত্যবর্ণ সেই পুরুষকে, অন্ধকারের পরপাবে যার স্থিতি, ত্বমেব বিদিত্বাতি মৃত্যুমেতি–
প্রতিদিনের আপাততুচ্ছতা দিয়া তৈরি জীবনের মহৎ স্থাপত্যের কথা সে বলিয়া যাইবে।
খুব জেদের সঙ্গে কোনো কাজ করিবার সময় মানুষ নিজেকে ভুলিয়া তাহা করে। হৈমন্তী অপুর জীবনী সেই জেদ লইয়া লিখিতেছিল। লেখা শেষ হইতে কাজল যেদিন পাণ্ডুলিপি দ্বিজেনবাবুর কাছে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিল, তাহার দিন সাতেক পরেই হৈমন্তী গুরুতর অসুখে পড়িল। আগে হইতেই তাহার শরীর ভালো যাইতেছিল না, কেবল মনের জোরে সে আসন্ন অসুস্থতাকে ঠেকাইয়া রাখিয়াছিল। এবার সে শয্যা নিল। ক্ষুধা নাই, শরীরে শক্তি নাই, চোখে কেমন একটা উদাসীন নিস্পৃহ দৃষ্টি। কলিকাতা হইতে বড়ো ডাক্তার আসিয়াও দেখিলেন। বিশেষ কিছু উপকার হইল না। ডাক্তারকে কাজল জিজ্ঞাসা করিল—কেমন বুঝছেন ডাক্তারবাবু? কী হয়েছে মায়ের?
চিকিৎসক বলিলেন–ইন ফ্যাক্ট, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। ওঁর শরীরের যন্ত্রপাতি সবই ঠিকঠাক ফাংশান করছে। প্ৰেশার নেই, ব্লাড সুগার নেই, হার্ট এই বয়েসের তুলনায় মোটামুটি ভালো। আসলে আমার মনে হয় ওঁর বাঁচার ইচ্ছেটাই যেন কমে গিয়েছে। এ রকম হয়। ইনভলভূমেন্ট নেই, কিছুর সঙ্গে উনি আর তেমন যোগাযোগ অনুভব করছেন না–
-এর চিকিৎসা কী? কিছু নিশ্চয় করার আছে?
–পেসেন্টকে আনন্দে রাখুন, কাছে বসে গল্পগুজব করুন। আমি একটা বলকারক ওষুধ দিয়ে যাচ্ছি, তাতে হয়তো কিছুটা কাজ হবে। অবশ্য আপনি আরও সিনিয়র কারও মত নিতেই পারেন–
বাহিরে আসিয়া কাজল বলিল—ডাক্তারবাবু, আপনার দক্ষিণা কত ঠিক জানি না। একটু যদি–
ডাক্তার বলিলেন—দক্ষিণা দিতে হবে না। আপনার বাবা আমাদের দেশের গর্ব। অপূর্ব রায়েব স্ত্রীর চিকিৎসা করে পয়সা নিতে পারব না। যে যাই বলুক, ডাক্তাররা একেবারে চামার নয়–
কাজলের চোখে জল আসিল। কত শ্রদ্ধা করে মানুষ তাহার বাবাকে! ধরা গলায় সে বলিল—ধন্যবাদ ডাক্তারবাবু, অনেক ধন্যবাদ
ঘরে আসিয়া সে হৈমন্তীর পাশে বসিল। বলিল–মা, ডাক্তারবাবু তো বললেন তোমার কোনো অসুখই নেই। একটু দুর্বলতা আছে, তার জন্য ওষুধ দিয়েছেন, সেটা খেলে দুর্বলতা কেটে যাবে। এবার মনে জোর এনে উঠে পড় দেখি, আমাদের আর চিন্তায় রেখো না
হৈমন্তী ম্লানভাবে হাসিল। ছেলের গায়ে হাত বুলাইয়া বলিল—তুই কিন্তু বড়ো বোগা হয়ে যাচ্ছিস–
কাজল বলিল—মা না দেখলে ছেলে তো রোগা হবেই।
হৈমন্তী বলিল–তা কেন, মা কি কারও চিরদিন থাকে? কেমন লক্ষ্মীর মতো বৌমা এসেছে, বৌমার হাতে সব ভার দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি
—সে ছেলেমানুষ। তোমাকেই সব আবার বুঝে নিতে হবে। আমি বুঝতে পেবেছি, তোমার হচ্ছে আমার আর বৌমার ঘাড়ে কাজ চাপিয়ে দেবার ফন্দি। ওসব চলবে না, চটপট সেরে ওঠো–
হৈমন্তী কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া তাকাইয়া থাকিল।
মায়ের বইখানা তাড়াতাড়ি প্রকাশ কবিবার জন্য কাজল খুব খাঁটিতে লাগিল। প্রায়দিনই বিকালে দ্বিজেনবাবুর দোকানে গিয়া প্রুফ দেখিয়া দেয়, প্রচ্ছদ সম্বন্ধে পরামর্শ করে। ছবি থাকিবে কী না সে বিষয়ে আলোচনা হয়।
সে ডাক্তার নয়, চিকিৎসাশাস্ত্রের কিছু বোঝেও না। কিন্তু মায়ের চোখের দিকে তাকাইয়া সে বুঝিতে পারিয়াছে মা আর বাঁচিবে না। সংসার হইতে মায়ের মন উঠিয়া গিয়াছে। বড় সাধের বই মায়ের, বইখানা যেন মা দেখিয়া যাইতে পারে–
বইখানা যেদিন প্রকাশ হইবার কথা সেদিন কাজল স্কুল কামাই করিয়া প্রায় সকাল হইতে দ্বিজেনবাবুর দোকানে গিয়া বসিয়া থাকিল। বেলা একটা কী দেড়টা নাগাদ দপ্তরীখানা হইতে প্রথম লট বাঁধাইয়া আসিল। দপ্তরীর লোক ঝাকাটা মাথা হইতে নামাইয়া রাখিতেই দ্বিজেনবাবু এককপি বই হাতে তুলিয়া লইয়া বলিলেন–বাঃ, বেশ হয়েছে। নাও, দেখ—
প্রখ্যাত এক শিল্পীর আঁকা অপুর ছবি দিয়া কভার ইয়াছে। বিস্কু রঙের জমির ওপর গাঢ় খয়েরি রঙ দিয়া আঁকা রেখাচিত্র। বেশ হইয়াছে বই।
পাঁচকপি বই লইয়া বিকালে কাজল বাড়ি ফিরিল। তাহার অপেক্ষায় তুলি বারান্দায় বসিয়াছিল, তাহাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল—কী হল? বেরিয়েছে বই? কই, দেখি—
তাহার পর দুইজনে হৈমন্তীর ঘরে গিয়া তাহার বিছানার পাশে দাঁড়াইল। কাজল বলিল—মা, এই দেখ, তোমার লেখা বই বেরিয়েছে। দেশ—
হৈমন্তী বইখানা হাতে লইল। কাজল গিয়া ঘরের আলো জ্বালিয়া দিল। তুলি একটু আগে ঘরে ধূপকাঠি জ্বালিয়া দিয়া গিয়াছে। মা চন্দন ধূপ ভালোবাসে। ঘরের বাতাসে চন্দনের মৃদু সৌরভ।
হৈমন্তী বইয়ের প্রচ্ছদের দিকে অনেকক্ষণ তাকাইয়া থাকিল। তারপর বই খুলিয়া উৎসর্গপত্রটা ভালো করিয়া পড়িল। জীবনের প্রথম এবং সম্ভবত শেষ বইখানি সে স্বামীকে উৎসর্গ করিয়াছে। যাহার জীবনী তাহাকেই।
বই মুড়িয়া বালিশের পাশে রাখিয়া হৈমন্তী বলিল–সুন্দর বই হয়েছে। মলাটে তোর বাবার ছবি কে এঁকেছে রে? আমার নাম করে বলিস—ছবি ঠিকঠাক আঁকা হয়েছে। বৌমা, ওকে কিছু খেতে দাও। সেই সকালে খেয়ে বেরিয়েছে—
২৫. বিসর্জনের বাজনা বাজিতে শুরু করিয়াছে
পঞ্চবিংশতি পরিচ্ছেদ