দ্বিজেনবাবু বলিলেন—আমরা ভেবে দেখেছি। অপূর্বাবুকে আমরা ভালোবাসি ঠিকই কিন্তু এই ব্যবসাটাও আমাদের চালাতে হয়। বাজারে চলবে না এমন বই আমরা ছাপাই না। তোমার বাবার যুগ এসে গিয়েছে কাজল। আধুনিক লেখকদের মধ্যে ওঁরই প্রথম রচনাবলী হবে–
প্রমথবাবু বলিলেন—দশ খণ্ডে কী থাকবে তা আমরা ছকে ফেলেছি। দেখাচ্ছি তোমাকে–
দেয়ালের গায়ে বইয়ের তাকে রাখা ব্যাগ হইতে কাগজখানি বাহির করিবার জন্য তিনি উঠিতেই টুক করিয়া দ্বিজেনবাবু চেয়ারে বসিয়া পড়িলেন। কাগজ বাহির করিয়া পেছন ফিরিয়া প্রমথবাবু বলিলেন—এই যে, দেখ—উপন্যাসগুলো ক্রোনোলজি ফলো করে—এ কী! এ তো ভারি–যাঃ!
দ্বিজেনবাবু নির্বিকার। পৃথিবীতে কোথাও কোনো অশান্তি নাই। তিনি কাগজ পড়িতেছেন।
সমস্ত পরিকল্পনাটা কাজল বুঝিয়া লইল। মা কখনওই আপত্তি করিবে না। তবু সে বলিল মাকে জিজ্ঞাসা করিয়া সে সামনের সপ্তাহেই আবার আসিবে।
মাসখানেকের মধ্যে সমস্ত বাংলা সংবাদপত্র আর সাময়িকপত্রে অপূর্বকুমার রায়-এর রচনাবলীর বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হইল। সকলেই যে খুশি হইল এমন নহে, তবে কাজল পৃথিবীর আসল রূপ অনেকটা দেখিয়া ফেলিয়াছে, সে অবাক হইল না।
বিজ্ঞাপন বাহির হইবার কিছুদিন পরে কাজল বসু ও গুহ পাবলিশার্সে গেল। তাহাকে দেখিয়া দ্বিজেনবাবু খুশি হইয়া বলিলেন—এই যে, এসো এসো। আবার তোমাকে একটা চিঠি দেব ভাবছিলাম। তা তুমি এসেই পড়েছ
–কেন কাকাবাবু?
দ্বিজেনবাবু আনন্দের হাসি হাসিয়া বলিলেন—আমাদের ধারণাই ঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে। সবাই বলেছিল অপুর্ববাবুর রচনাবলী ছাপছেন, আপনাদের কি পয়সা বেশি হয়েছে? কী দেখেছেন মশাই ও লেখকের মধ্যে? হ্যাঁ, একটা দুটো বই দাঁড়িয়ে গিয়েছে তা স্বীকার করি। কিন্তু তা বলে রচনাবলী? ও জিনিস বাজারে কাটবে না—
কাজল ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করিল বিজ্ঞাপনের ফিডব্যাক কী রকম কাকাবাবু?
-ভালো। খুব ভালো। এর মধ্যেই আমরা পাঁচহাজার গ্রাহক পেয়েছি। শুধু মুখে নয়, রীতিমত টাকা জমা দিয়ে নাম লিখিয়েছে। প্রথম খণ্ড বেবুবার আগে আরও কিছু পাব আশা রাখি। এইবাব বুঝলে এই সবজান্তা পণ্ডিতেরা কত মূখ? দু একজন এসে গ্রাহকদের লাইন দেখে পালিয়ে গিয়েছে, আমাদের সঙ্গে আর দেখা করেনি।
অপুর রচনাবলীর প্রথম খণ্ড বাহির হইবার দিন বসু ও গুহ পাবলিশার্স একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করিলেন। বাংলা সাহিত্যের নামি লেখকেরা ছাড়াও অনেক সাধারণ পাঠকের দল আসিয়া ভিড় জমাইল। কাজল হৈমন্তী আর তুলিকেও সঙ্গে আনিয়াছিল। মানুষের ভিড় দেখিয়া তুলি চুপি চুপি স্বামীকে বলিল–উঃ! অনেক লোক হয়েছে, তাই না?
হৈমন্তীর চোখে জল। সে সভা দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছিল। এতটা সে আশা করে নাই।
অপুর একটা ভালো ছবি দ্বিজেনবাবু কাজলের কাছে চাহিয়া লইয়াছিলেন। সেটি বড়ো করিয়া বাঁধাইয়া মঞ্চে রাখা হইয়াছে। সভাপতি একজন প্রবীণ সাহিত্যিক, তিনি অর ছবিতে মালা দিয়া পাশে রাখা প্রদীপ জ্বালাইয়া সভার উদ্বোধন করিলেন।
কাজলের মনে হইল মালা পরিয়া বাবা যেন হাসিতেছে। কী সুন্দর দেখাইতেছে বাবাকে। কত লোক তো সে জীবনে দেখিল, তাহার বাবার মতো কি কেহ দেখিতে সুন্দর
একের পর এক বক্তা উঠিয়া অপুর সাহিত্য সম্বন্ধে বলিতেছেন। শনিতে শুনিতে কাজলের যেমন ভালো লাগিতেছিল, আবার এ কথাও মনে হইতেছিল-সবটা এরা ঠিক বুঝতে পারেন নি। বাবার ব্যক্তিগত জীবনকেও আলোচনার মধ্যে ধরতে হবে। এঁরা যা বলছেন বাবা তার চেয়েও অনেক বড়ো। যাক, একজন সাহিত্যিকের যথার্থ মূল্যায়ন হতে তো সময় লাগেই–
তবে এ কথা সে বুঝিল যে, বাংলা সাহিত্যের জগতে তাহার বাবার আসন পাকা হইয়া গিয়াছে। আলোচনা হয়তো অনেক হইবে, কিন্তু তাহার বাবার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে কেহ প্রশ্ন তুলিবে না।
সভা শেষ হইলে লেখকেরা অনেকেই আসিয়া হৈমন্তীর সঙ্গে আলাপ করিলেন। দ্বিজেনবাবু বলিলেন—বৌদি, একটা কথা আপনাকে বলব ভাবছিলাম। আজ দেখা হয়ে ভালো হল। আপনি অপূর্ববাবুর একটা স্মৃতিকথা লিখুন না, সমালোচনা বা মূল্যায়ন নয়, কীভাবে আপনাদের পরিচয়, জীবনের ছোট ছোট ঘটনা—এই আর কী। অনেক খদ্দের কাউন্টারে জিজ্ঞাসা করে—অপূর্বকুমার রায়ের কোনো জীবনী পাওয়া যায় না? বাজার তৈরি আছে বৌদি, আপনি লিখুন—
হৈমন্তী বলিল–আমি কি পারব ঠাকুরপো? উনি অনেক বড়ো মানুষ ছিলেন–
—আপনিই পারবেন, আর কেউ এ কাজ পারবে না। পাঠক অধ্যাপকের তাত্ত্বিক আলোচনা চায় না, মানুষটার জীবনের গল্প জানতে চায়। সে আর আপনি ছাড়া কে পারবে?
অপুর জীবনী হৈমন্তী এমনিতেই একখানা লিখিতেছিল, এইবার উৎসাহ পাইয়া দ্রুত শেষ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। আগে সে গল্প-কবিতা লিখিয়াছে, লিখিয়া উপার্জনও করিয়াছে, কিন্তু নিজের সহজ বুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া সে বুঝিতে পারিল এইবার কাজ অনেক কঠিন। যাহার জীবনকাহিনী সে লিখিতে বসিয়াছে তাহার কথা সম্ভবত আগামী অনেক শতাব্দী মনে রাখিবে। কিন্তু বাদ দিলে চলিবে না। যতই তুচ্ছ হোক, সবকিছু লিখিয়া রাখিতে হইবে। তাহার চাইতে ভালো করিয়া তাহার স্বামীকে কেহ চেনে না, একদিন হয়তো তাহার লেখা হইতেই গবেষকরা উপাদান সংগ্রহ করিবে।
সাদা পটভূমিতে হালকা জলরঙের কাজ যেমন একটু একটু করিয়া শিল্পীর তুলির স্পর্শে ফুটিয়া ওঠে, তেমনি হৈমন্তীর কলমে মূর্ত হইয়া উঠিল পেছনে ফেলিয়া আসা বাসন্তী দুপুর, দিনের কাজের ফাঁকে অকারণ চকিত চাহনি, ঘন বর্ষার দিনে জানালার পাশে চেয়ার পাতিয়া কবিতা পড়া, গান গাওয়া। লিখিতে লিখিতে মনে পড়িয়া গেল স্বামীর পাশে ঘুম ভাঙিয়া জানালার পাশে ছোট রাধাচূড়া গাছটার দিকে তাকাইয়া থাকিবার কথা। সূর্য ওঠে নাই, মেঘলা আকাশের পটে লাল ফুলের গুচ্ছ। তাকাইয়া থাকিতে থাকিতেই একটা টুনটুনি পাখি আসিয়া গাছের ডালে বসিয়াছিল। জানালার তিন হাতের মধ্যে গাছটা। অত কাছ হইতে সে আর কখনও টুনটুনি দেখে নাই। অসম্ভব রকমের ছোট আর ক্ষিপ্র পাখিটা। সকালবেলা জাগিয়া উঠিবার আনন্দে কী কবিবে ভাবিয়া পাইতেছে না।